দেহযতন I বেডটাইম এক্সারসাইজ
ঘুম থেকে উঠে শরীরচর্চায় রত হন স্বাস্থ্যসচেতন অনেকে। তা ভালো! কিন্তু ঘুমের আগের চর্চা বাদ দিলে চলবে?
কে না জানে, পর্যাপ্ত ঘুম পরবর্তী দিনে আমাদের ভেতর থেকে কর্মক্ষেত্রে সেরাটা বের করে আনতে কাজে দেয়। কিন্তু দিনের শেষে শরীর ও মনকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দেওয়া অনেক সময় চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। বিছানায় গেলেও যথাসময়ে ঘুম আসে না কারও কারও। শরীর ব্যথাসহ নানা ভোগান্তিতে পড়েন বিড়ম্বনায়। কেউ কেউ মনে করেন, শুয়ে থাকাই রিলাক্সেশনের একমাত্র উপায়। অথচ বিশেষজ্ঞদের মত ভিন্ন। তাদের মতে, রাতে স্ট্রেচিং আপনাকে ব্যথা এড়াতে এবং দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে সাহায্য করবে।
তাই প্রতি রাতে উইন্ড-ডাউন রুটিনে কিছু হালকা স্ট্রেচিং অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার পরামর্শ ইন্টারন্যাশনাল সার্টিফাইড ইয়োগা অ্যান্ড মেডিটেশন কোচ এবং নাতজেন ইয়োগার প্রতিষ্ঠাতা নাতাশা সানজিদার। তিনি বলেন, ‘আমি আমার স্টুডেন্টদের বলেছি নিজেদের ম্যারাথন রেসে থাকা কারও সঙ্গে তুলনা করতে। ধরুন, আপনার দিনটি ম্যারাথনের মতো। আপনি হাঁটছেন, দাঁড়াচ্ছেন কিংবা ডেস্কে বসে আছেন; যা-ই করুন না কেন, তাতে আপনার পেশি পরীক্ষার মুখোমুখি হচ্ছে। স্ট্রেচিং হচ্ছে শরীর শিথিল করার একটি উপায়, যাতে পরবর্তীকালে আরও আরামে ও নির্বিঘ্নে বিশ্রাম নিতে পারেন।’
মানবদেহের রক্তপ্রবাহে উন্নতি ঘটানো এবং পেশির টান উপশম করতে স্ট্রেচিং বেশ উপকারী। আর তা পেশি পুনরুদ্ধার এবং ঘুমের গুণমানে সহায়তা করে। তাই ঘুমের আগে নিজের শরীরকে যত বেশি শিথিল করতে পারবেন, ঘুম তত ভালো হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে বলে অভিমত এই এক্সপার্টের। তিনি বলেন, ‘ঘুমের সময় শরীর পূর্ণাঙ্গ বিশ্রামে থাকে; তখন কোনো পেশি বা জয়েন্টের ব্যবহার সাধারণত হয় না। তাই বিছানায় যাওয়ার আগে স্ট্রেচিং আপনার শরীরকে ঘুমের সময় ইতিবাচক রাখবে।’
বিশেষ করে আপনি যদি এমন কেউ হন, যিনি দিনের বেলায় পেশিতে খিঁচুনি অনুভব করেন; তাহলে ঘুমের সময় অস্বস্তি এড়াতেও স্ট্রেচিং আপনাকে সাহায্য করবে। ‘দিনে যে পেশিগুলো অতিরিক্ত ব্যবহার করেন, বিশেষ করে ঘাড়, কাভস, হ্যামস্ট্রিং ও কোয়াডস, সেগুলোতে ঘুমানোর সময় খিঁচুনি হতে পারে। আপনি যদি সক্রিয় অবস্থা থেকে সরাসরি বিছানায় শুয়ে পড়েন, তাহলে এমন খিঁচুনি হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে, যা আপনার ঘুম ভাঙার কারণ হতে পারে,’ বলেন নাতাশা।
কখন, কীভাবে
রাত্রিকালীন স্ট্রেচিং করার সময় ও স্থানে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা জরুরি। শোয়ার আগে প্রায় ৩০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা স্ট্রেচিং করার পরিকল্পনা রাখা শ্রেয়। নাতাশা বলেন, ‘স্ট্রেচিং এতটাও বেশি করা ঠিক নয়, যাতে অতিরিক্ত ক্লান্তি চলে আসবে; এতে হতে পারে হিতে বিপরীত এবং আপনি একসময় এই চর্চা ছেড়ে দিতে পারেন। তাই শুতে যাওয়ার আগে স্ট্রেচিংই শেষ কাজ না হওয়া ভালো।’
তার পরামর্শ শুরুতে কিছুক্ষণ গভীর শ্বাস নেওয়ার। ‘আপনি যদি উৎকণ্ঠা ও মানসিক চাপে ভোগেন, তাহলে আপনার পুরো সিস্টেমকে শিথিল করতে পাঁচ থেকে দশ মিনিট সময় নিন। এর ফলে স্ট্রেচিং থেকে আরও সুবিধা পাবেন,’ বলেন তিনি।
বলে রাখা ভালো, যেকোনো স্ট্রেচিংয়ের লক্ষ্য হওয়া চাই পেশি সামান্য প্রসার করা; তবে তা যেন অতিরিক্ত না হয়। নাতাশার মত, ‘স্ট্রেচিং করার সময় খেয়াল রাখা চাই, নিজ সামর্থ্যের চেয়ে বেশি কিছু না করা।’ প্রথমাবস্থায় কিছুটা অস্বস্তি হতে পারে; তবে ব্যথা হয়—এমন কিছু করা ঠিক নয় মোটেই।
বেডটাইম স্ট্রেচিং অনেক রকম হতে পারে। তবে যেগুলো রাখতে পারেন লিস্টে:
ঘাড় স্ট্রেচ
এই স্ট্রেচিং ঘাড় ও ওপরের ট্রেপিজিয়াস পেশির ওপর কাজ করে। দিনের বেশির ভাগ সময় ঘাড় ও কাঁধের এই পেশিগুলোতে একধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়, বিশেষ করে ডেস্কে বসে দীর্ঘক্ষণ কাজ করলে। তাই শোয়ার আগে ধাপে ধাপে করতে পারেন এই দেহচর্চা—
ভালো ভঙ্গিতে বসুন বা দাঁড়ান;
মুখ সামনে রেখে, ডান কানটি ডান কাঁধের দিকে নিন। এ সময় বাম হাতটি মেঝের দিকে রাখুন;
ডান হাত দিয়ে আলতো করে ডান কাঁধের দিকে মাথা মুভ করুন;
২০ থেকে ৩০ সেকেন্ড ধরে রাখুন;
ডান দিকে দুই থেকে তিনবার পুনরাবৃত্তি করে তারপর পাশ পরিবর্তন এবং পুনরাবৃত্তি করুন।
এই চর্চার ক্ষেত্রে নাতাশার পরামর্শ: ‘শরীরের মাঝামাঝি অবস্থান থেকে শুরু করছেন কি না, তা নিশ্চিত হতে একটি আয়না ব্যবহার করুন। মনে রাখবেন, ঘাড়ের সঙ্গে পুরো শরীরের সামঞ্জস্য রাখা গুরুত্বপূর্ণ।’
ঘাড় মোচড়
এই স্ট্রেচ স্ক্যাপুলাকে লক্ষ্য করে করা হয়। সারা দিন যারা বসে থাকেন, তাদের জন্য বেশ উপকারী। যেভাবে করবেন—
ডান হাতটি টেইলবোনের ওপর এবং তালু শরীরের বিপরীতে রাখুন;
ঘাড় বাম দিকে এবং মাথা বাম নিতম্বের দিকে বাঁকা করুন;
বাম হাত দিয়ে মাথাটি বাম নিতম্বের দিকে ধরে রাখুন;
এভাবে ২০ থেকে ৩০ সেকেন্ড থাকুন;
বাম দিকে দুই থেকে তিনবার পুনরাবৃত্তি শেষে পাশ পরিবর্তন এবং পুনরাবৃত্তি করুন।
এই চর্চায় নাতাশার পরামর্শ: ‘টেইলবোনে হাত রাখলে স্ট্রেচিং থেকে ভালো ফল পাওয়া সম্ভব।’
লাইং ‘টি’ টুইস্ট
এই রোটেশন থোরাসিক মেরুদণ্ড বা ওপরের পিঠকে লক্ষ্য করে চর্চা করা হয়। নাতাশা বলেন, ‘এটি পুরো মেরুদণ্ডকে কাজ করানোর একটি দুর্দান্ত উপায়। পাশাপাশি নিতম্ব ও ঘাড় শক্ত করতে সাহায্য করে।’ চর্চার উপায়—
ডান দিকে শুয়ে এক হাতের ওপর আরেক হাত এবং পা বাঁকিয়ে এক হাঁটুর ওপরে অপরটি রাখুন;
শরীরের ওপরের অংশ ও মাথা বাম দিকে ঘোরান;
১০ সেকেন্ডের জন্য ইংরেজি ‘টি’ অক্ষরের মতো অবস্থানে ধরে রাখুন, তারপর স্ট্যাক করা অবস্থানে ফিরে যান;
বাম দিকে তিন থেকে পাঁচবার পুনরাবৃত্তি শেষে পাশ পরিবর্তন এবং পুনরাবৃত্তি করুন।
ক্যাট-কাউ
এই স্ট্রেচ নিচের পিঠকে লক্ষ্য করে করা হয়, যা বসা, দাঁড়ানো কিংবা হাঁটার সময় নমনীয় হতে সাহায্য করে। নাতাশার মতে, ‘বেশির ভাগ মানুষ সামনে বা পেছনে সঠিকভাবে বাঁকা হবেন না, এটাই স্বাভাবিক। তবে আপনি যখন হাত ও হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে ওজনহীন অবস্থানে থাকেন, তখন এ ধরনের ভুল করার শঙ্কা থাকে না।’ এই দেহচর্চার পদ্ধতি—
কাঁধের নিচে হাত এবং নিতম্বের নিচে হাঁটু রেখে ওপরে উঠুন (এটি আপনার নিরপেক্ষ অবস্থান);
পেটের পেশি শক্ত করে, নিতম্ব সামান্য ওপরের দিকে রেখে, টেইলবোনের দিকে গুঁজো হয়ে বসে থাকুন (অনেকটা ক্যাট বা বিড়ালের ভঙ্গিমায়);
১০ সেকেন্ডের জন্য এই অবস্থান ধরে রাখুন;
এরপর পিঠের নিচের অংশটি মেঝের দিকে, টেইলবোন ওপরের দিকে এবং ঘাড়ের সামনের দিক প্রসার করুন (কাউ বা গরুর ভঙ্গিমায়);
১০ সেকেন্ডের জন্য এই অবস্থান ধরে রাখুন;
এবার নিরপেক্ষ অবস্থানে ফিরে যান এবং পাঁচ থেকে দশবার পুনরাবৃত্তি করুন।
সহায়ক বুক স্ট্রেচ
অনেকের অঙ্গভঙ্গি আপনাআপনি সুন্দর হলেও কাঁধ সেভাবে নমনীয় হয় না। তাদের জন্য এই স্ট্রেচিং বেশ কাজের বলে অভিমত নাতাশার। এটি পেক্টোরাল ও ডেল্টয়েড পেশি—বুক ও কাঁধে কাজ করে। চর্চার উপায়—
দরজার ফ্রেমে বাহু সমতলভাবে রাখা চাই; কাঁধ ও কনুই সমকোণে রেখে দরজার ফ্রেমে দাঁড়ান;
সামনের দিকে ঝুঁকুন—যতক্ষণ না বুক ও ওপরের কাঁধের সামনে স্ট্রেচ অনুভব করেন;
৩০ সেকেন্ড এভাবেই থাকুন;
দুই থেকে তিনবার পুনরাবৃত্তি করুন।
নাতাশা বলেন, ‘এই চর্চার ক্ষেত্রে নিচের পিঠে কোনো চাপ নেওয়া একদম উচিত নয়।’
এ ছাড়া শিশু ভঙ্গি, লাইং সিঙ্গেল নি টু চেস্ট, সুপাইন হ্যামস্ট্রিং স্ট্রেচ, স্ট্যান্ডিং কোয়াড স্ট্রেচ, স্ট্যান্ডিং কাফ স্ট্রেচসহ বিভিন্ন ধরনের স্ট্রেচের চর্চা করতে পারেন। অনলাইনে টিউটোরিয়াল দেখে চালাতে পারেন প্রচেষ্টা; তবে কোনো বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া শ্রেয়।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট