এডিটর’স কলাম I মনোজগতে ফুলের প্রভাব
ফুল শুধু আনন্দের অনুভূতিই দেয় না; বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন, সহকর্মী—জীবনের সর্বস্তরের অন্য সব মানুষের সঙ্গে একজন ব্যক্তিমানুষের সম্পর্কগুলোকে আরও গভীর করে তোলার নেপথ্যেও ভূমিকা রাখে
‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।/ তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে/ কোরো না বিড়ম্বিত তারে।/ আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো,/ আজি ভুলিয়ো আপন-পর ভুলিয়ো,/ এই সংগীত-মুখরিত গগনে/ তব গন্ধ তরঙ্গিয়া তুলিয়ো…’। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এমন আহ্বান দোলা দিয়ে যায় সৃজনশীল মানব মনে। তাতে তাল মিলিয়ে, বাংলার প্রকৃতিতে নজর রাখলে টের পাওয়া যায়, ঋতুরাজের আগমন আসন্ন। শুভ্র কুয়াশার চাদর এখনো আদিগন্ত ছড়ানো যদিও, তবু গাছে গাছে নতুন ফুলের আভাস দিনে দিনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বসন্ত সামনে রেখে মনের চাদরেও তাই ফুল ছড়াতে শুরু করেছে সৌরভ। ফুলের সঙ্গে মানুষের মনোজগতের সম্পর্ক বেশ গভীর। বলা হয়ে থাকে, ফুলের রূপ ও গন্ধের বৈচিত্র্য যেকোনো পাষাণ হৃদয়কেও মুহূর্তে কোমল করতে সক্ষম।
দুই
কিছু বিষয় গ্রন্থ কিংবা অন্য কোনো সূত্র বা মাধ্যম থেকে নয়, বরং নিজের অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। আর সেই উপলব্ধি প্রত্যেকের নিজ নিজ মতো হলেও কিছু বিষয়ে তা সর্বজনীন এবং চিরকালই ইতিবাচক। ফুল এমনই এক উৎস। মানবজীবনে এর প্রভাব ঘিরে এরই মধ্যে হয়েছে বিস্তর গবেষণা। তাতে দেখা গেছে, চরম দুঃসময়েও ফুলের সান্নিধ্য মানুষের মনে এনে দেয় নির্মল অনুভূতি। সময়ে সময়ে যেকোনো ব্যক্তিমানুষেরই জীবন হয়ে ওঠে যন্ত্রণাকাতর ও দুর্বিষহ। সেসব যাতনা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে বেড়ায় মন। আর মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানোর এক দারুণ নিয়ামক হয়ে ধরা দেয় ফুল। চোখের সামনে ফুল ভেসে উঠতেই আপনাআপনি আনন্দে নেচে ওঠে মন। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শীর্ষ জন-গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় রাটগারস ইউনিভার্সিটির (দ্য স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউজার্সি) একদল গবেষক প্রমাণ পেয়েছেন, মানুষের মন-মেজাজে ফুলের রয়েছে ইতিবাচক প্রভাব। গবেষণাটির সব অংশগ্রহণকারী একবাক্যে স্বীকার করেছেন, উপহার হিসেবে ফুল পাওয়ামাত্রই তার রূপে ও ঘ্রাণে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছেন তারা। সেই প্রভাব একটি দীর্ঘ সময় ধরে বজায় থেকেছে তাদের জীবনে। তা ছাড়া ফুল শুধু আনন্দের অনুভূতিই দেয় না; বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন, সহকর্মী—জীবনের সর্বস্তরের অন্য সব মানুষের সঙ্গে একজন ব্যক্তিমানুষের সম্পর্কগুলোকে আরও গভীর করে তোলার নেপথ্যেও ভূমিকা রাখে।
তিন
মানুষের মনে অপরের যত্ন নেওয়ার, যথাযোগ্য খেয়াল রাখার প্রেরণা জোগায় ফুল। হলুদ, উষ্ণ গোলাপি, দুধ-সাদা, সূক্ষ্ম সবুজাভ…নানা কোমল রঙের ফুল একজন ব্যক্তিমানুষের অন্তস্তলে ছড়িয়ে দেয় মমত্বের বারতা। ফুল যেহেতু হয়ে থাকে ভঙ্গুর, নরম ও কোমল; তাই এর সঙ্গে চলে না জোরজবরদস্তি। বরং সত্যিকারের শোভা উপভোগ করতে চাইলে সযত্নে সামলাতে হয় একে। আর তা মানুষকে শিক্ষা দেয় যেকোনো সম্পর্ককে সযতনে লালনের। অন্যদিকে, কোনো নতুন মা, অসুস্থ ব্যক্তি কিংবা শোকার্তের জন্য ফুল হতে পারে জীবনদায়ী প্রেরণার নামান্তর।
তা ছাড়া ফুলের সূক্ষ্ম উষ্ণ ও শীতল রঙের সংমিশ্রণ ব্যক্তিমানুষের মনে অন্তরঙ্গতা, স্মৃতিকাতরতা ও স্বস্তির অনুভূতি উসকে দেয়। গবেষণা বলে, এ ক্ষেত্রে গোলাপের সুনামই বেশি! শুধু তা-ই নয়, ফুল একই সঙ্গে জাগিয়ে তোলে সংবেদনশীলতার আখ্যান। বিশেষত গাঢ় লাল, বেগুনি, উষ্ণ গোলাপি ও কমলা রঙা ফুলগুলো পরিশীলতা, আবেগ; এমনকি প্রলোভনের মেজাজ নির্ধারণ করে দেয় অনেক সময়। আবার পুষ্পশোভিত বিন্যাস যে কারও জন্য হয়ে উঠতে পারে নির্মলতা ও শিথিলতার মহৌষধ। এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছ ও হালকা সবুজ এবং কুয়াশাচ্ছন্ন নীল রঙের ফুলগুলোর অবদান অগ্রগণ্য বলেই অভিমত বিশেষজ্ঞদের। এককথায়, মানুষের জীবনের নানা পর্যায়ে প্রকৃত স্বজন হয়ে ফুটে থাকে ফুল।
চার
মানুষের অনুভূতির সঙ্গে ফুলের সম্পর্ক সবিশেষ। এর প্রতি মানুষ সব সময় এক অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করে; আর তা সুদূর অতীত থেকেই। জ্যানেট হেভিল্যান্ড জোনস, হলি হেল রোজারিও এবং টেরি আর ম্যাকগুয়ের যৌথ গবেষণাপত্র ‘অ্যান এনভায়রনমেন্টাল অ্যাপ্রোচ টু পজিটিভ ইমোশন: ফ্লাওয়ারস’ সূত্রে জানা যায়, এক লাখ বিশ হাজার বছর আগেকার প্রাচীন মিসরীয় সমাধিগুলোতে পাথরে আঁকা ফুলের নকশার সন্ধান মিলেছে; দুই হাজার বছর আগের সময়ে, রোমান সাম্রাজ্য ও চীনা সংস্কৃতিতে ফুল ঘিরে উৎসবের খোঁজ পেয়েছেন ইতিহাসবিদেরা। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির সব স্তরে ফুল ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে অগুনতি সৃজনকর্ম। ফুল শুধু নান্দনিকতার বার্তাই নয়; সহনশীলতার মহিমাও ছড়িয়ে দেয়। সৌভাগ্যক্রমে, প্রাকৃতিকভাবে ঋদ্ধ আমাদের এই জন্মভূমিতে রয়েছে বিচিত্র ফুলের সমাহার। বসন্তে তা হয়ে পড়ে বাঁধনহারা।
পাঁচ
‘ঘুম থেকে জেগে দেখি টেবিলে সাজানো কিছু ফুল,/ যে-ফুল দেখেছি স্বপ্নে অচিন উপত্যকার গাছে।/ জানি, সে নীরবে রেখে গ্যাছে ফুল হৃদয়ের কাছে/ অগোচরে, ফুলগুচ্ছ ঘিরে গীত হয় বুলবুল/ ক্ষণে ক্ষণে কে জানে কী সুখে! পৃথিবীতে কোনো ভুল/ কোথাও হয়নি যেন আজ; হতাশ মুমূর্ষ বাঁচে,/ এমনকী ধূমায়িত আমারও সত্তায় আলো নাচে/ অমেয় সৌরভে…’ মনোজগতে ফুলের প্রভাবের এমন বন্দনা লিখে গেছেন কবি শামসুর রাহমান। তাতে তাল মিলিয়ে ফুলের প্রকৃত তাৎপর্য ছড়িয়ে পড়ুক সবার জীবনে।
জীবন ছড়াক রূপ ও সৌরভ।