তনুরাগ I পুষ্পস্নান
চিরন্তন প্রক্রিয়া। পুরোপুরি প্রকৃতিপ্রাণিত। সরাসরি যোগ রয়েছে শরীর ও মন ভালো রাখার সঙ্গে
গোসলের পানিতে দু-একটা ফুল ছড়িয়ে দেওয়া, তারপর গোসল সেরে ফেলা। ব্যস, হয়ে গেল ফ্লাওয়ার বাথ। তা-ই মনে হচ্ছে! ব্যাপারটা কিন্তু অত সহজ নয়। থেরাপিউটিক এ গোসল শরীর, মন—দুটোকেই তরতাজা করে তুলতে পারে মুহূর্তেই। সারা দিনের দৌড়ঝাঁপের পরে, ফ্লাওয়ার বাথ শরীরকে শুদ্ধ করার পাশাপাশি একঘেয়েমি ভাঙার একটি দুর্দান্ত উপায়। কীভাবে? ফুল এবং ফুলের ভেষজগুলোর অসাধারণ থেরাপিউটিক ক্ষমতার গুণে। যা ডিটক্সের কাজ করে। মানসিক অস্থিরতা বা শারীরিক দুর্বলতায় নিজেকে পুনরায় সেট করার জন্য সময় দেওয়া জরুরি। পুষ্পস্নান, যুগে যুগে বিশ্বের নানা সংস্কৃতিতে নিরাময়ক প্রথা হিসেবে উল্লেখিত আছে। পদ্ধতিটি ঐতিহাসিকভাবে ভারত, মিসর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পেরুসহ প্রাচীন বিশ্বের নানা দেশে আধ্যাত্মিক এবং নিরাময় কার্যক্রমে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গবেষকেরা বলেছেন, ফুলের ফ্রিকোয়েন্সি বা শক্তিতে স্নান, আক্ষরিক অর্থে জীবনের প্রস্ফুরণ ও বিকাশকে উৎসাহিত করে; যা একরকম নিরাময় শক্তি হিসেবে প্রশান্তি আনে শরীরে। ফ্লাওয়ার বাথ ট্রেন্ডের জনপ্রিয়তাও বাড়ছে সে কারণেই। জীবনের জটিলতা যেমন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, সেটি কমানোর জন্যও তো চেষ্টা করা চাই। তাই না? সে কাজে কিন্তু এটি ভীষণভাবে সফল পদ্ধতি। কীভাবে?
নিশ্ছিদ্র নিদ্রায় সহায়ক
কর্মক্লান্ত একটি কঠিন দিনের পর সুগন্ধি ফুলে পূর্ণ পানিতে গোসল শরীরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শিথিলতার অনুভূতি তৈরি করে। যাতে সারা দিনের মানসিক চাপ ও যন্ত্রণাগুলো ভুলে যাওয়া সহজ হয়। মন সব নেতিবাচক চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে শান্তিতে ঘুমাতে সহায়তা করে।
রূপ রুটিনে দুর্দান্ত
গোলাপ, ক্যামোমাইল ও জেসমিনের মতো ফুলগুলো সাধারণত ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে বিউটি ক্রিমে ব্যবহৃত হয়। এসব ফুলের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বককে আর্দ্র, মসৃণ ও পুনরুজ্জীবিত করতে সাহায্য করে। আর ফ্লাওয়ার বাথের মাধ্যমে এই পরিচর্যা শুধু মুখে সীমাবদ্ধ না থেকে পুরো শরীর থেকেই টক্সিন দূর করার জাদু দেখাতে সক্ষম!
পেশি শিথিল ও স্নায়ু প্রশমনে সহায়ক
পুষ্পস্নান পেশি গভীর থেকে শিথিল করতে সাহায্য করে। ফুলের সহজাত নিরাময় ক্ষমতা রয়েছে। ফলে পেশি, জয়েন্ট ও স্নায়ুর জন্য উপকারী। ফ্লাওয়ার বাথে শরীর ভিজিয়ে রাখলে স্নায়ুগুলো স্থির হয়। ফলে পেশিগুলোতে আরাম মেলে। পরবর্তী সময়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠে।
প্রাকৃতিক ছন্দে সংযুক্তি
এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হয়, যা মনের শান্তি ও ভারসাম্য রক্ষায় খুব জরুরি। প্রকৃতির সঙ্গে এই পুনঃসংযোগ দ্রুতগতির, সংযোগ বিচ্ছিন্ন আধুনিক জীবনে সুস্থতার ওপর অসাধারণ প্রভাব ফেলে।
যেকোনো ফুল ব্যবহার করেই এ স্নান করা যাবে, ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়। কোন ফুলগুলো আসলে ফ্লাওয়ার বাথের জন্য সবচেয়ে উপযোগী?
গোলাপ: সবচেয়ে উপযোগী ফুল। সুবাস তো ছড়ায়ই, ত্বকের জন্য রীতিমতো ম্যাজিক্যাল। এর পাপড়িতে প্রাকৃতিক তেল রয়েছে, যা শুষ্ক, ক্ষতিগ্রস্ত ত্বককে পরিপুষ্ট ও ময়শ্চারাইজ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। তা ছাড়া প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা ত্বকের সুস্থতা বজায় রাখতে এবং ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু মেরামতে সহায়তা করে। তাই নরম ও কোমল ত্বকের জন্য প্রয়োজন গোলাপমিশ্রিত স্নান।
ক্যালেন্ডুলা: এটি অ্যান্টিফাঙ্গাল ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল হিসেবে কাজ করে, যা সামগ্রিকভাবে ত্বকের প্রদাহ কমাতে উপকারী। ত্বক যদি খসখসে বা সংবেদনশীল হয়ে থাকে, তাহলে ক্যালেন্ডুলাযুক্ত স্নান একে প্রশমিত ও শান্ত করতে সাহায্য করবে। মৃদু, নিরাময় প্রভাবের কারণে একজিমা এবং ডার্মাটাইটিসযুক্ত ত্বকের সারাইয়ে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়।
ল্যাভেন্ডার: অ্যারোমাথেরাপিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ফুলগুলোর মধ্যে একটি। এর সুগন্ধি মন ও শরীরের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। এটি উত্তেজনা ও উদ্বেগ কমায়। তাই একটি দীর্ঘ, ক্লান্তিকর দিনের পরে ল্যাভেন্ডার স্নান অত্যন্ত প্রশান্তিদায়ক।
সূর্যমুখী: পাপড়িতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, সি, ই-এর মতো পুষ্টি উপাদানের পাশাপাশি ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে। এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পরিবেশগত ক্ষতি থেকে ত্বককে রক্ষা করে। সূর্যমুখী স্নান বিশেষত সূর্যের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ত্বকের জন্য ভালো। এটি ত্বককে পুনরুজ্জীবিত ও পরিপুষ্ট করতে সহায়তা করে।
জুঁই: একে বলা হয় বিস্ময়কর ফুল। বাহ্যিক ও মনোমুগ্ধকর সুবাসের জন্য সুপরিচিত। তবে এর ঔষধি উপকারিতাও রয়েছে। জুঁইয়ের সুগন্ধি স্বাভাবিকভাবে মানসিক উদ্বেগকে শান্ত করতে এবং মেজাজকে ইতিবাচক করতে সাহায্য করে।
রোজমেরি: স্নানে ব্যবহারকালে এটি উদ্দীপক ভেষজ হিসেবে রক্তসঞ্চালন বাড়াতে পারে। ফলে ত্বকের কোষে পুষ্টির সরবরাহ বৃদ্ধি পায় এবং ডিটক্সিফিকেশন ভালো হয়। অধিকন্তু, রোজমেরির শক্তিশালী সুবাস মনকে সতেজ করতে এবং মানসিক স্বচ্ছতা দিতেও সক্ষম।
পুদিনা: ত্বককে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ভালো। পাশাপাশি ত্বকে সতেজ ও শীতল প্রভাব ফেলে। পুদিনায় আছে প্রাকৃতিক মেনথল, যা ত্বককে প্রাণবন্ত করে তোলে অনায়াসে। পুদিনা-স্নান গরম আবহাওয়ায় বা চটজলদি পিক-মি-আপের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর।
জবা: এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বক সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে। এটি গোসলের পানিতে দারুণ রং যোগ করে। যা স্নানের অভিজ্ঞতাকে আরও দৃষ্টিনন্দন ও প্রাণবন্ত করে তুলতে সক্ষম।
ক্যামোমাইল: আরেকটি চমৎকার ভেষজ। এতে প্রদাহবিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। পেশির টান ও ব্যথা উপশমেও সহায়ক। ক্যামোমাইল ফুল বা ক্যামোমাইল এসেনশিয়াল অয়েল দিয়ে গোসল প্রশান্তি ও আরামের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে।
বলে রাখা ভালো, গোসলে ফুল ব্যবহার করার আগে এবং এর উপকারিতা উপভোগের জন্য সঠিক প্রস্তুতি প্রয়োজন। ফুল শুকনো হোক বা তাজা, এর সহজলভ্যতা ও পছন্দের ওপর নির্ভর করে এ থেকে প্রাপ্ত তেলও ব্যবহার করা যেতে পারে। যদি অ্যালার্জি বা ত্বকের সংবেদনশীলতা থাকে, তাহলে স্নানে ফুল ব্যবহারের আগে অবশ্যই প্যাচ টেস্ট করা চাই; ত্বকে যেকোনো ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া এড়াতে।
রত্না রহিমা
ছবি: ইন্টারনেট