টেকসহি I লেবেল ল্যাঙ্গুয়েজ
বাক্হীন পোশাকের ভাষা বুঝতে চাই লেবেল-সম্পর্কিত সম্যক জ্ঞান। খুব কঠিন নয় কিন্তু
নতুন পোশাক কেনার সময় তার লেবেল ঠিকমতো খেয়াল করেন কজন? সংখ্যাটা একদমই অল্প। দাম জানার জন্য একনজর পড়া হয়। ব্যস, ওই পর্যন্তই। সবাই মোটামুটি ওই একই দলের। লেবেল বা ট্যাগে ছোট ছোট অক্ষরে পোশাকসম্পর্কিত যেসব তথ্য থাকে, সেগুলো খুঁটিয়ে পড়ার মানুষ বিশ্বজুড়ে হাতে গোনা। ফুড অ্যালার্জি সম্পর্কে জানা আছে নিশ্চয়ই। অনেকের তা থাকে। যে খাবারে অ্যালার্জি আছে, সেটি সংমিশ্রিত কিছু খেয়ে ফেললে ভয়ংকর অবস্থা হয়, এমনকি মারা যাওয়ার নজিরও আছে। একইভাবে ক্লথ অ্যালার্জি বলেও একটা টার্ম আছে। সেটিও কম ভয়ংকর নয়। যেটি থেকে কয়েক ঘণ্টার জন্য খুব চুলকানি এবং অস্বস্তিবোধ থেকে শুরু করে শরীরে নানা রকম বিপজ্জনক প্রভাব পড়তে পারে। ব্যাপারটি ফুড অ্যালার্জির মতো সচরাচর না হলেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাবারের মতো পোশাকের লেবেল সম্পর্কেও সচেতন হওয়া উচিত। কিন্তু সমস্যা হলো, আজকাল সবাই যখন ‘বাই ওয়ান, গেট ওয়ান ফ্রি’-এর মতো চটকদার বিজ্ঞাপনে আটকে গেছে, সেখানে লেবেলগুলোতে শুধু মূল্যটাই চোখে পড়া স্বাভাবিক। বাকি বিশদ বিবরণে কী লেখা আছে, তা দেখার সময় কোথায়? এক দামে দুটি পোশাক নিঃসন্দেহে একটি ভালো অফার; কিন্তু এই ‘ভালো’ ডিলগুলো আসলে যে এতটা ভালো নয়, তা জানার সময় এসেছে।
ফ্যাব্রিক সম্পর্কে খোঁজ করলে যে ব্র্যান্ড থেকে পোশাক কেনা হচ্ছে, তার নীতিশাস্ত্র সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। যেমন এটি কোথায় তৈরি করা হয়েছে, সেটি প্রাকৃতিক নাকি কৃত্রিম ইত্যাদি। টেকসই ফ্যাশনের চাহিদা তুঙ্গে বলে ব্র্যান্ডগুলো পলিয়েস্টার বা তুলা থেকে জৈব তুলা, বাঁশ, সিল্ক, উল বা পুনর্ব্যবহৃত পলিয়েস্টার ফাইবারে পরিবর্তন করছে। যা দেখে সাধারণ ক্রেতা বুঝতেও পারবেন না, কী ফ্যাব্রিক তিনি কিনছেন। কারণ, কাপড় কেনার সময় যে বিষয়গুলো বিবেচনা করতে বলা হয়, তার প্রথমটি হচ্ছে পলিয়েস্টার থেকে দূরে থাকার ব্যাপারটা। তুলা, সিল্ক, লিনেন বা উলের মতো প্রাকৃতিক কাপড় বেছে নিতেও উদ্বুদ্ধ করা হয়। তাই সার্টিফিকেশনের জন্য লেবেল দেখা জরুরি, যা বলতে পারে উপাদানটি জৈব কি না কিংবা পোশাকটি তন্তুর মিশ্রণে তৈরি কি না। ব্র্যান্ডের লেবেল ও স্বচ্ছতা সম্পর্কে অনিশ্চিত হলে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা এবং উত্তর দাবি করারও সময় এসেছে। লেবেল পড়ার জন্য অতিরিক্ত কয়েক সেকেন্ড ব্যয় করতে পারলে, পরবর্তীকালে তা অনেক সময় ও শ্রম বাঁচিয়ে দেবে। পছন্দের পোশাকটি নিজের জন্য, পরিবেশ ও উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের জন্য ভালো হলে মানুষ ও পৃথিবী—দুটোই বাঁচবে। ফ্যাশন গবেষকদের মতে, পোশাকের লেবেল কীভাবে পড়তে হয়, তা যদি কেউ শিখতে পারেন, সেটি পৃথিবীর জন্য একটি বিশাল সঞ্চয়। কারণ, সেখানে লেখা থাকে কীভাবে কাপড়গুলোর যত্ন নেওয়া বা ধোয়া উচিত; তাতে পোশাকটি সহজে নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে না, টেকসই হয়।
প্রথমে ওয়াশ থেকে শুরু করা যাক। যদি একটি প্রতীকসহ লেবেল দেখা যায়, যার ওপরে তরঙ্গায়িত লাইনসহ একটি তিন-পার্শ্বযুক্ত পাত্র রয়েছে; তার মানে হলো, নিরাপদে কাপড় ওয়াশিং মেশিনে দেওয়া যাবে। তবে সেটিরও ডিটেইলিং আছে। যেমন এটির অধীনে একটি লাইন মানে স্থায়ী প্রেসওয়াশ চক্র ব্যবহার করুন। এর নিচে দুটি লাইন মানে মৃদু ধোয়া চক্র ব্যবহার করুন। কেন্দ্রে একটি বিন্দু, অর্থাৎ ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে নিন। কেন্দ্রে দুটি বা তিনটি বিন্দু, অর্থাৎ গরম পানিতে ধুয়ে ফেলুন। কেন্দ্রে একটি সংখ্যার মানে হলো সেই তাপমাত্রাতেই ধুয়ে নিন (40oC = 104oF)।
হাতে ধোয়ার জন্য, সাধারণত লেবেলে উল্লেখ থাকে যে ফ্যাব্রিকটি তার উপযুক্ত। ওয়াশিং মেশিনের জনপ্রিয়তা বাড়লেও হাত ধোয়া প্রায় সব সময় সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি বলে ধারণা করা হয়। আবার ওয়াশিং চিহ্নে যদি X এর চিহ্ন থাকে, তাহলে এর অর্থ হচ্ছে পোশাকটি মেশিনে বা হাতে ধোয়া যাবে না। তার পরিবর্তে ড্রাই ক্লিনিংয়ের জন্য নিয়ে যাওয়া উচিত।
ড্রাই ক্লিনিংয়ের জন্যও জামাকাপড়ের ট্যাগগুলো কীভাবে পড়তে হয়, তা জানা চাই। যেমন একটি সরল বৃত্ত মানে শুকনো কাপড়ই পরিষ্কার করা যাবে। X সহ একটি বৃত্ত হলো, শুকনো পরিষ্কার করবেন না। কেন্দ্রে A সহ একটি বৃত্ত, অর্থাৎ যেকোনো দ্রাবক ব্যবহার করা যেতে পারে, কেন্দ্রে একটি P সহ একটি বৃত্ত—ট্রাইক্লোরিথিলিন ছাড়া যেকোনো ডিটারজেন্ট ব্যবহার করা যাবে। কেন্দ্রে একটি F সহ একটি বৃত্ত মানে শুধু পেট্রোলিয়ামযুক্ত ডিটারজেন্ট ব্যবহার্য। যেহেতু যেকোনো ফ্যাব্রিক শুকনো পরিষ্কার করা মানুষ ও পৃথিবীর জন্য ক্ষতিকারক, তাই যথাসম্ভব এটি এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়।
এবার জানা যাক, কখন ড্রায়ার ব্যবহার করা যাবে। যদি লেবেলে কেন্দ্রে একটি বৃত্তসহ একটি বর্গাকার প্রতীক দেখা যায়, তার মানে হলো নিরাপদে ড্রায়ার ব্যবহার সম্ভব, সেখানে বিশেষ বিবেচনার প্রয়োজন নেই। তবে সেখানেও কথা আছে। গাঢ় কালো বৃত্ত—তাপ ব্যবহার করবেন না, এক বিন্দু—কম তাপমাত্রায় শুকিয়ে নিন, দুটি বিন্দু—মাঝারি তাপমাত্রায় শুকিয়ে নিন, তিনটি বিন্দু—উচ্চ তাপমাত্রায় শুকাতে হবে। আবার ড্রায়ার চিহ্নের মাঝখানে যদি একটি X থাকে, তার মানে হলো ড্রায়ার ব্যবহার করা যাবে না। যদি শুধু একটি বর্গক্ষেত্রের চিহ্ন থাকে, যার মাঝখানে কোনো বৃত্ত নেই, সেটি ইঙ্গিত দেয় যে ফ্যাব্রিকটিতে ‘প্রাকৃতিকভাবে শুকানোর’ পদ্ধতি ব্যবহার করা উচিত; যাকে সর্বকালের সেরা পদ্ধতি বলা হয়।
ব্লিচ করার জন্য কাপড়ের ট্যাগগুলো কীভাবে পড়তে হয়, তারও রয়েছে নানা উপায়। একটি সরল ত্রিভুজ: যেকোনো ব্লিচ ব্যবহার করা যেতে পারে, একটি X সহ একটি কালো ত্রিভুজ: ব্লিচ করবেন না, দুটি তির্যক রেখাসহ একটি ত্রিভুজ: নন-ক্লোরিন ব্লিচ ব্যবহার করুন, মাঝখানে CL সহ একটি ত্রিভুজ: ক্লোরিন অনুমোদিত, মাঝখানে একটি CL এবং এর মধ্য দিয়ে একটি X সহ একটি ত্রিভুজ: নন-ক্লোরিন ব্লিচ ব্যবহার করুন। তবে তার সঙ্গে এ-ও বলা হয়, ব্লিচ যতটা সম্ভব এড়াতে পারলেই ভালো।
ইস্ত্রি করার দিকনির্দেশের জন্যও পোশাকের লেবেল পড়া চাই। কীভাবে আপনার পোশাক সঠিকভাবে ইস্ত্রি করা হবে, তা জানতে আয়রন-আকৃতির প্রতীক এবং এর যেকোনো বৈচিত্র্যের দিকে নজর দিন। যেমন লেবেলে চিহ্নিত বিন্দু: কোন তাপমাত্রা ব্যবহার করা যেতে পারে, সেটির ইঙ্গিত দেয়। এক বিন্দু: নিম্ন-তাপমাত্রা সেটিং ব্যবহার্য (সিনথেটিকস), দুটি বিন্দু: মাঝারি তাপমাত্রার সেটিং ব্যবহার্য (উল বা সিল্ক), তিনটি বিন্দু: উচ্চ তাপমাত্রা সেটিং (তুলা বা লিনেন) ব্যবহার্য। কেন্দ্রের মাধ্যমে ক্রস চিহ্ন: ইস্ত্রি করবেন না। নিচে তিনটি লাইন: স্টিম বা বাষ্পসহ আয়রন, নিচে তিনটি লাইনের ওপরে X: স্টিম করবেন না।
পুরোটা পড়ে মাথা ঘুরে যাচ্ছে। কিছু করার নেই! দামি পোশাকের যত্ন এবং তা টেকসই করে তুলতেই এত কষ্ট করে উৎপাদকেরা লেবেল দিয়ে থাকেন; একটু হ্যাপা নিয়ে তা পড়লে তাতে আখেরে লাভ কিন্তু ভোক্তারই।
রত্না রহিমা
ছবি: ইন্টারনেট