সঙ্গানুষঙ্গ I রুবি রোমান্স
প্রিয় মানুষের হৃদয়ের রঙের বিচ্ছুরণ এতে। তার ছটাতেই ঝিলমিলিয়ে উঠবে চারপাশ। এমনই নজরকাড়া যা বদলে দিতে পারে যেকোনো সাজের ব্যাকরণ
ভালোবাসার জন্য কী না করেছে মানুষ! বিশ্বসংসার তন্নতন্ন করে ১০৮টি নীল পদ্ম এনে দেওয়ার চেষ্টাও করেছে! বাদ যায়নি পাথরও। না, পাথরে প্রিয়জনের নাম লেখার কথা বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে জেম স্টোনের কথা। একটি বিশেষ জেম স্টোন। রুবি। বাংলায় ‘সূর্যকান্তমণি’। সংস্কৃতিতে পদ্মরাগ। ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে যা এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত। রং তীব্র লাল। শিরায় শিরায় ছুটে চলা রক্ত যেন স্ফটিক হয়ে ধরা দিয়েছে। বিজ্ঞানের দিক থেকে এর কারণ ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি। একটি প্রবাদ বলি, ‘শি ইজ মোর প্রেশাস দেন রুবিস!’ অর্থাৎ, ‘সে রুবি পাথরের থেকেও দামি!’ যত দামি পাথর-ই হোক না কেন, তার সঙ্গে কি মানুষের তুলনা চলে? কিন্তু এখানে প্রতীক অর্থে বোঝানো হয়েছে, ভালোবাসার মানুষটি বহুমূল্য রত্ন রুবির চেয়েও মূল্যবান।
বাইবেলে চারবার এসেছে ‘রুবি’ শব্দটি। বলা হয়েছে, সৃষ্টিকর্তার তৈরি ১২টি বহুমূল্য পাথরের মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই রুবি। সনাতন ধর্মেও আছে রুবির বয়ান। অভিহিত করা হয়েছে রত্নরাজ বলে। এই রত্ন প্রেম, সম্পদ ও প্রাণশক্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।
অনেক জহুরির বিশ্বাস অনুযায়ী রুবির রয়েছে আরোগ্য গুণ। সে কেমন? রুবি হৃদয়ের দ্বার খুলে দেয়। মনঃকষ্ট দূর করতে সাহায্য করে। রুবির স্পর্শে মুছে যায় মনের দাগ—এমন আবেগের কথাও শোনা গেছে বহুবার। এমনকি ঘুমের মাঝে সুন্দর স্বপ্ন দেখাতেও নাকি ভূমিকা রাখে এটি। প্রাণশক্তি বাড়াতেও কার্যকরী। উদ্দামহীনতা মনকে ভারাক্রান্ত করলে রুবি হতে পারে উদ্দীপনার প্রভাবক। এই সবই জরুরি—ভালোবাসায়, ভালো থাকায়!
তাই তো প্রিয়জনের অনামিকায় রুবির রশ্মির চাহিদা তৈরি হয়েছে। ভালোবেসে ভালো রাখার তাড়নায় মণিমাণিক্যের ব্যবহার আজকের নয়। বহু আগের! বিখ্যাত জেম অনুসন্ধানকারী জর্জ ফ্রেডরিখ কুনজের এ বিষয়ে মতামত পাওয়া যায় অন্তর্জালে। রুবির ‘হিলিং বেনিফিটস’-এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, এটি রাগ দূর করার জন্য কার্যকরী। আবার প্রিয়জনের সঙ্গে মতভেদ, বৈসাদৃশ্য মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখে। আবেগের সম্পর্কে রাগ পজিটিভ ইমোশন হিসেবে গণ্য হয় না। কারণ, রেগে গেলে যৌক্তিক ভাবনার শক্তি হারায় মন। প্রিয়জনকে মনের অজান্তে কষ্ট দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। রাগ সংবরণ এবং এর মাধ্যমে মন নিয়ন্ত্রিত না হওয়া তাই গুরুত্বপূর্ণ। ভালোবাসার সম্পর্কে রাগ সংবরণকে দেওয়া হয় আলাদা গুরুত্ব। অ্যাঙ্গার ইস্যুতে ভুক্তভোগী হয় না আর কোনো প্রেমিক-প্রেমিকা। যা ‘হেলদি রিলেশন’-এর জন্য আবশ্যক। প্রেমে অভিমান ভাঙাতে ভালো লাগতে পারে, কিন্তু চণ্ডাল রাগ? সে তো বিগ নো!
কালার সাইকোলজিতেও পাওয়া যায় দারুণ এক তথ্য। তা হচ্ছে, রুবির লাল রং মনকে রাঙায় কয়েক রঙে। লাস্য, উদ্দীপনা আর ভালোবাসায়। সহ-অবস্থানে আছে শক্তিও! এই তালিকার কোনোটিই কি প্রেমের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অগ্রাহ্য করার মতো? না তো! প্রেম তো উত্তাল হয় এসবেই। দুর্নিবার শক্তি নয়তো কোথা থেকে আসে!
মনের আবেগকে এক পাশে রেখে যদি রুবি পাথরের বৈশিষ্ট্য বলি, তাহলে বলতে হবে এর দীর্ঘস্থায়িত্ব, দৃঢ়তার কথা। হীরা যেমন শক্ত জেম স্টোন হিসেবে পরিচিত, রুবিও কিন্তু কম নয়। অবস্থান হীরার পরেই। অর্থাৎ টিকে থাকবে দীর্ঘদিন।
শুধু এনগেজমেন্ট রিংয়ের সেন্টার স্টোন হিসেবেই রুবি দেওয়া যাবে, এমন কোনো নিয়ম নেই। দিতে পারেন ভালোবাসা দিবসেও। একই সঙ্গে অ্যানিভারসারিও গুরুত্বপূর্ণ একটি উপলক্ষ হতে পারে। অনেক দেশে ১৫তম এবং ৪০তম বার্ষিকীর উপহার হিসেবে গুরুত্ব পায় রুবি।
মিয়ানমারের মোগক অঞ্চলে সেরা মানের রুবির খনির অবস্থান। পাওয়া যায় ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায়। মিয়ানমার বিয়ের উপহার হিসেবে রানি এলিজাবেথকে দিয়েছিল ৯০টি রুবিসংবলিত একটি মুকুট। সেখানকার মানুষের বিশ্বাস অনুযায়ী, সুস্বাস্থ্য, ভালোবাসা, ভালো থাকার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয় এই রত্ন। মিয়ানমার বিশ্বের ৮০ ভাগ রুবির জোগান দেয়; যা নিয়ে কালোবাজারিদের মধ্যেও আগ্রহ তৈরি হয়েছে। তাই অনৈতিকভাবে সে দেশ থেকে এই রত্নপাথর পাচার হচ্ছে থাইল্যান্ডে। সীমান্ত দিয়ে। দুর্নীতি-সন্ত্রাসের প্রলেপ লাগছে রুবি রোমান্সে। গবেষণাগারে তৈরি রুবির ব্যবহার এ ক্ষেত্রে সমাধান হিসেবে গণ্য হতে পারে। কারণ, এতে পরিবেশ, মানুষ, কোনো জাতি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, তেমনি লাভ জেম রুবিতেও লুকিয়ে থাকবে না কোনো করুণ আর্তনাদ। ল্যাব গ্রোন হওয়ায় লাভ কমে যাবে—বিষয়টা মোটেই এমন নয়। তাই প্রিয়জনের জন্য কেনা যেতেই পারে ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে। প্রণয়ের রং মিশে থাকতেই পারে একটুকরো পাথরে!
সারাহ দীনা
মডেল: মৃদুলা
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: র নেশন
জুয়েলারি: স্বস্তিক
ছবি: কৌশিক ইকবাল