ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I ক্যানসেল কালচার
বর্তমানে বহুল চর্চিত। বিতর্কিতও কম নয়। বিশ্বজুড়ে কতটা প্রভাবিত করছে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে, তারই খোঁজ করেছেন সারাহ্ দীনা
ফ্যাশনে ‘ক্যানসেল কালচার’ বলতে বোঝায় কোনো একটি ফ্যাশন আইটেম বর্জন করার উদ্দেশ্যে শুরু করা আন্দোলন। মূলত নন-ভায়োলেন্ট প্রোটেস্ট। নিকট অতীতে, গেল বছরের শেষের দিকে জেনারেশন জি, রেগুলার বটমওয়্যার লেগিংসের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান জানান দিয়েছে। এর আগেও তারা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেটি ছিল ওয়্যারড্রোব থেকে স্কিনি জিনস বাতিলের। এরপর এসেছে লেগিংসের পালা।
সেলফ টাইটেলড ‘হট গার্ল অ্যানথ্রোপোলজিস্ট’ হ্যানা ব্রাউন জেন জি দের ফেভারিট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘টিকটক’-এ একটি ভিডিও কনটেন্টের মাধ্যমে বার্তা দেন, লেগিংস বর্তমানে আউটডেটেড বটমওয়্যার। একদমই ট্রেন্ডি নয়! সঙ্গে আহ্বান জানান লেগিংসের পরিবর্তে ইয়োগা প্যান্ট অথবা ফ্লেয়ারড লেগিংস ব্যবহারের। মিলিনিয়ালদের আন-অফিশিয়াল ইউনিফর্মে পরিণত হওয়া এই পোশাককে এককথায় বর্তমান ফ্যাশন দুনিয়ায় অচল বলে ঘোষণা দিয়ে দেন জেন জি ফ্যাশন এক্সপার্ট। লেগিংস পরে তার সঙ্গে ওভারসাইজড নিটেড সোয়েটার পেয়ারআপ করে, পায়ে মোজা আর কাঁধে টোট ব্যাগ ঝুলিয়ে হ্যানা যে ভিডিও বার্তা শেয়ার করেছিলেন, এখন অব্দি প্রায় ৭০ হাজারের বেশি মানুষ তাতে লাভ রিঅ্যাকশন দিয়ে সমর্থন জানিয়েছেন। তিন হাজারের বেশি কমেন্ট মূল ভিডিও বার্তাটিতে। আলোচনা, পরামর্শ, সিদ্ধান্ত—সবই উঠে এসেছে সেখানে।
ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে ক্যানসেল কালচার নতুন না হলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আগ্রাসন একে যতটা শক্তিশালী করে তুলেছে, আগে ততটা ছিল না। একই সঙ্গে বর্তমান সময়ের মানুষের মাঝে তথাকথিত ‘ট্রেন্ড’ ফলো করার প্রবণতাও বেড়েছে। ফ্যাশন ইনফ্লুয়েন্সারদের বার্তা প্রবাদতুল্য হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৮ সালে অহিংস সামাজিক আন্দোলন হয়। এতে অংশ নেন পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের তরুণেরা। ‘বেবি বুমারস’ জেনারেশন বলা হয় তাদের। সময়ের বিভিন্ন বাঁকে বহুবার সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত অসংগতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলার বিষয়ে উৎসাহিত হতে দেখা গেছে তরুণদের। ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সহজলভ্যতা এ ধরনের গণজাগরণকে বর্তমানে বৈশ্বিক বিষয়ে পরিণত করতে ভূমিকা রাখছে। খুবই অল্প সময়ে খবর পৌঁছে যাচ্ছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। এর মধ্যে আলোড়ন তুলেছিল ‘কল-আউট-কালচার’। পপ কালচারের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিল একসময়। সেখান থেকেই ক্যানসেল কালচার প্রসূত বলে ধারণা করা হয়।
ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডে ক্যানসেল কালচার দুর্দান্ত ভূমিকা রাখতে পারে। বলা যেতে পারে হাই এন্ড ব্র্যান্ড ব্যালেন্সিয়াগার একটি ক্যাম্পেইনের কথা। ২০২২ সালে তাদের সেই ক্যাম্পেইনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। সেখানে শিশুদের বিকৃতভাবে উপস্থাপনের বিষয়ে রেড ফ্ল্যাগ দেখানো হয়। তিনটি ছবিকে চিহ্নিত করা হয় চাইল্ড সেক্সুয়ালাইজেশনের জন্য। একটিতে দেখা যায়, বিয়ার ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক শিশু। যৌন সম্পর্কের হিংসাত্মক কৌশলের জন্য ব্যবহৃত কিছু সরঞ্জাম শিশুটির আশপাশে ছড়িয়ে আছে। আরেক ছবিতে দেখা যায় শিশুর হাতে একটি পুতুল বিয়ার। সামনের টেবিলে ওয়াইন গ্লাসসহ প্রাপ্তবয়স্কদের ব্যবহার্য নানান কিছু। দুটি ছবিতেই মডেল হিসেবে উপস্থিত শিশুর পরনে বিডিএসএম—অর্থাৎ বন্ডেজ, ডিসিপ্লিন, স্যাডিসম, ম্যাসোকিজম নামে পরিচিত ইরোটিক প্র্যাকটিসের ইঙ্গিতপূর্ণ পোশাক। এই ক্যাম্পেইনে অন্য একটি ছবিতে দেখা যায় একজন পূর্ণবয়স্ক মডেলকে। সেই নারীর গায়ে ব্র্যান্ড লোগো-সংবলিত একটি টি-শার্ট। সামনে এলোমেলো বিভিন্ন কিছুর মাঝে উঁকি দিচ্ছে কিছু কাগজ। সেগুলো আদতে সাধারণ কিছু নয়; বরং কোর্ট ডকুমেন্ট। কাছ থেকে দেখলে দৃশ্যমান হয় লেখাগুলো। বোঝা যায় শিশু পর্নোগ্রাফি কেইসের ডকুমেন্ট এগুলো। হাই এন্ড ফ্যাশন ব্র্যান্ড ব্যালেন্সিয়াগার এহেন আচরণে ক্ষুব্ধ হন ফ্যাশন ও সমাজসচেতনেরা। ইন্টারনেটজুড়ে শুরু হয় হ্যাশট্যাগ ‘বয়কট ব্যালেন্সিয়াগা’ এবং ‘ক্যানসেল ব্যালেন্সিয়াগা’র পোস্ট। একই সঙ্গে কোম্পানিটির ব্যবহারকারীদের একটি অংশের ভিডিও পোস্টে ছেয়ে যায় অন্তর্জাল। যেখানে তারা আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছেন নিজের সংগ্রহে থাকা ব্যালেন্সিয়াগার পণ্য। এটি ক্যানসেল কালচারের উদাহরণ।
আরও কিছু ঘটনা উদাহরণ হিসেবে টানা যেতে পারে, যেখানে কোনো ট্রেন্ডকে বাতিল করা হয়েছে অথবা চেষ্টা চলছে। যেমন ফাস্ট ফ্যাশনের বিরুদ্ধে হয়ে যাওয়া প্রচারণা। নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইকের এবারের প্রদর্শনীর সময় একজন দর্শক প্ল্যাকার্ড নিয়ে উঠে আসেন র্যাম্পে। দৃপ্ত পায়ে হেঁটে বেড়ান রানওয়েতে। উদ্দেশ্য—মানুষকে জানান দেওয়া। সম্পূর্ণ কার্বন এমিসনের ৮ থেকে ১০ শতাংশের জন্য দায়ী ফাস্ট ফ্যাশনের বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরির জন্যই এই মুভমেন্ট।
আবার, ২০২৩ সালের ব্ল্যাক ফ্রাইডের সময় অস্ট্রেলিয়ায় একটি মলের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। শরীরে শুধু উজ্জ্বল গোলাপি কাপড় জড়িয়ে কণ্ঠে জোরালো স্লোগান, ‘উই আর ন্যুড, উই আর রুড। ফাস্ট ফ্যাশন মিনস উই আর স্ক্রুড’।
আন্দোলন, প্রতিবাদ কিংবা বর্জন, ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক—দুই-ই হতে পারে। ক্যানসেল কালচারের ক্ষেত্রেও এই সূত্র সত্যি। ব্র্যান্ড ব্যালেন্সিয়াগার মতো সংবেদনশীল ইস্যুর ক্ষেত্রে বাতিলের ঘোষণার মতো যুক্তিযুক্ত প্রতিবাদ এই দর্শনের মাধ্যমেই সফল হয়েছে। তবে সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে খুব সহজে একজনের বার্তা অন্যজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব, আর এই সুযোগ সব থেকে বেশি ইনফ্লুয়েন্সারদের। ফলোয়ার অপশনের বদৌলতে অনুসারীদেরকে সহজেই তাদের দর্শন সম্পর্কে জানানোর সুযোগ তৈরি হয়; যা ক্ষেত্রবিশেষে নেতিবাচক প্রভাবও তৈরি করে। অনেক ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মাঝেই খুব অল্প সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, রেগে যাওয়া, ব্লক করার অভ্যাস দেখা যায়; যার কারণে বিপরীত দিকে অবস্থানকারীর পক্ষে তার যুক্তি প্রদর্শন সম্ভব হয় না। ফ্যাশন দুনিয়ার ক্যানসেল কালচার যদি এমন কোনো দ্রুত সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপকারের চেয়ে এই শিল্পের ক্ষতির শঙ্কাও তৈরি হয়। কারণ, ফ্যাশন আর্টের একটি ফর্ম। ডিজাইনার তার ফিলোসফি ব্যবহার করে নকশা সম্পন্ন করেন। সব প্যাটার্ন, অর্নামেন্টেশনের মূলকথা সাধারণ ক্রেতাদের কাছে সব সময় পরিষ্কারভাবে প্রকাশিত হবে, তা নয়। তাই অতিদ্রুত কোনো ফ্যাশন আইটেমকে বাতিল ঘোষণা করা ডিজাইনারের জন্য অপমানজনকও মনে হতে পারে; যা তাকে পরবর্তী কাজের ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসী হতে বাধা দিতে পারে।
আবার, অনেক ক্ষেত্রে এমন বিক্ষোভের ফলে সহজ টার্গেটে পরিণত হন ক্যাম্পেইন-সংশ্লিষ্ট নির্বাহী। কারণ দর্শানোর নোটিশসহ চাকরি থেকে বরখাস্ত করার উদাহরণও আছে। ব্যালেন্সিয়াগার ক্ষেত্রে এ ধরনের সিদ্ধান্ত প্রয়োগের নজির রয়েছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিক রোনান ফারো ‘ইনসাইড দ্য হাইভ ইন্টারভিউ ২০১৯’-তে এ বিষয়ে বলেন, ‘আমার মনে হয় ক্যানসেল কালচার শুধু শব্দের ব্যবহার এবং এর উপস্থাপনার ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়। ফ্যাশন আইটেমটি তৈরির উদ্দেশ্য কিংবা উপযোগিতার প্রতি একদমই নয়।’
ফ্যাশন একটি শিল্প হওয়ার কারণে এর সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি সৃষ্টির প্রতি ভিন্নমত ও দর্শনের প্রভাব থাকে। শিল্পী যেমন করে নিজের আর্টওয়ার্ক বর্ণনায় চিন্তার বয়ান করেন, তেমনি ফ্যাশনের ক্ষেত্রেও ডিজাইনারের, ব্র্যান্ড কর্মকর্তাদের নিজস্ব ফিলোসফি থাকতে পারে। ক্যানসেল কালচার আলোচনার সুযোগ না দিয়ে একতরফা সিদ্ধান্তে এলে এমন কার্যক্রমকে তুলনা করা যেতে পারে সোশ্যাল পুলিশিংয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ের সঙ্গে। যেখানে অভিযুক্তের মতামত দেওয়ার জায়গা থাকে না। শুধু শাস্তি ভোগ করে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সপক্ষে যুক্তি দেওয়ার মতো সুযোগ থাকলে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি জনমত গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পাবে।
ছবি: ইন্টারনেট