ছুটির ঘণ্টা I লাবণ্যময় লাদাখ
হ্রদ, পর্বত, উপত্যকা আর গিরিপথ মিলে লাদাখকে করে তুলেছে মনোরম ও রোমাঞ্চকর। লিখেছেন ফাতিমা জাহান
তখন সবে সন্ধ্যার লালিমা মিলিয়েছে দিগন্তে, কনকনে ঠান্ডা। বেরিয়ে পড়লাম তাঁবু থেকে। প্যাংগং লেকে আসার উদ্দেশ্য ছিল চাঁদনি রাত উপভোগ করা। হাঁটা শুরু করলাম লেকের দিকে। আশপাশ নির্জন, নিশ্চুপ, কোথাও একটা ঝিঁঝি পোকার শব্দও নেই। এ কেমন জায়গা! বিকেলেই দেখলাম শখানেক ট্যুরিস্ট লেকের আশপাশজুড়ে রয়েছে, আর শশিকলা দেখার বেলায় কেবল বেজায় ফাঁকিবাজি। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে খানিকটা নামতে হয় লেক অবধি যাবার জন্য। শুকনো খটখটে পাথর আর মাটির পাহাড়। গাছপালা কিচ্ছু নেই। নামতে নামতে আপন মনে গান গাইতে লাগলাম। দৃষ্টি নিষ্পলক। সব সৌন্দর্য বোধ করি প্রকৃতি এখানেই ঢেলে দিয়েছে। ধবল ফকফকে একখানা চাঁদ একা আমাকেই যেন দেখছিল চারদিক ফরসা করে, ইশারা করে ডাকছিলও বোধ হয়, কে জানে সেই চন্দ্রালোকের ভাষা আর শান্ত প্যাংগং লেকের জল এসে আমাকে ছুঁতে চাইছিল আপন ভেবে। একে তো চাঁদনি রাত, তার ওপর নির্জন প্রকৃতি, সব একাকার হয়ে মন কাব্যরসে উথলে উঠতে চাইছিল। কিন্তু বেজায় ঠান্ডায় চোখমুখ জমে যাচ্ছিল, ভারী শীতবস্ত্রে যদিও আচ্ছাদিত ছিলাম। বাইরের তাপমাত্রা ছিল এক বা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস। ভাবলাম শশিকলার সঙ্গে সখ্য না হয় ভিন দেশেই করব, যেখানে তাপমাত্রা ভিলেন হয়ে আসবে না। হাঁটতে লাগলাম তাঁবুর দিকে। কিন্তু বিধি বাম, এ কোথায় এলাম! দূর থেকে সব তাঁবুই একরকম দেখতে আর ভীষণ ঠান্ডার কারণে রাত আটটার মধ্যেই সব ঘুমিয়ে পড়েছে। কাকে জিজ্ঞেস করে যে ডেরায় পৌঁছাই। চাঁদনি রাত, কিন্তু পথঘাটে কোনো বাতি নেই। থাকবেই বা কী করে? লোকালয়-বিচ্ছিন্ন এ গ্রামখানি যে দুর্গম। কিছুটা পথ ওপরে চড়তেই দেখলাম, একটা রেস্টুরেন্ট থেকে খানিকটা আলো ছড়াচ্ছে। বাইরে থেকে হাঁক দিলাম। দুজন ১৯-২০ বছরের ছেলে এসে আশয়বিষয় জানতে চাইল। বললাম পথ হারিয়েছি। জিজ্ঞেস করল, কোন তাঁবুতে উঠেছি। এই সর্বনাশ, তাঁবুর নামই তো জানি না! যে ট্যাক্সি নিয়ে লেহ থেকে এসেছি তার ড্রাইভার জানে। এসেছি আজ দুপুরে। অবশ্য বিকেলে একবার বেরিয়েছিলাম লেকপাড়ে। তাদেরকে বললাম, তোমরা আমাকে গাড়ি যে পথ দিয়ে চলে, সে পথটা দেখিয়ে দাও, আমি সেই পথ ধরে চিনে নিতে পারবো। তারা আরও অবাক হয়ে বললো, আপনি তো অনেকখানি পথ হেঁটে এসেছেন।
একজন এগিয়ে দিতে এলো। ছেলেটির নাম রুস্তম। বাড়ি কারগিল। এখানে রেস্টুরেন্টে কাজ করে। আরও খানিকটা পথ ওপরে চড়ার পর দেখি আমার ট্যাক্সিচালক আমাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছে। রুস্তমকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলাম আমার তাঁবুতে। তাঁবু থেকেও জ্যোৎস্না ষোলোকলায় উপভোগ করা যায়। তবে ফারাক শুধু রাজশাহীতে বসে গাছ থেকে পেড়ে আম খাওয়া আর নিউইয়র্কে বসে সেই একই আমের স্বাদ গ্রহণ করা।
আমার ধারণা, মানুষ দুটি জীবন যাপন করে- প্রথম জীবন প্যাংগং লেক দেখার আগে আর দ্বিতীয় প্যাংগং লেক দেখার পর। আমি এখন দ্বিতীয় জীবন যাপন করছি।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৪ হাজার ২৭০ ফুট উঁচু এই অপার জলরাশি আমার দেখা ভারতের সব লেকের মধ্যে সবচেয়ে মনোহর। ১৩৪ কিমি দীর্ঘ প্যাংগং লেকের অর্ধেকের একটু বেশি অংশ পড়েছে চীন সীমান্তের ভেতরে। শীতকালে লেকটি বরফে পুরোপুরি জমে যায়। একে সর্বোচ্চ চারণভূমিও বলা হয়ে থাকে। সারি সারি সোনালি পর্বত পাহারা দিচ্ছে নীল জলরাশিকে। শুষ্ক আবহাওয়া, হ্রদের নোনা জল ইত্যাদি কারণে এখানকার জমিতে ফসল ফলে না। শীতকাল এখানকার অধিবাসীদের জন্য গৃহবন্দিত্ব বরণের কাল। সারা বছরের তাপমাত্রা সাধারণত ২০ থেকে মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। হ্রদের যে প্রান্তে আমি ছিলাম, সেখানে সাকল্যে স্থানীয় ১৪টি পরিবার বসবাস করে। কথা হচ্ছিল আমার তাঁবুর মালিক রোমোর সঙ্গে। মেয়েটি মা, ভাই আর বরকে নিয়ে থাকে। লাদাখের পরিবার মাতৃতান্ত্রিক না হলেও ভারতের অন্যান্য পিতৃতান্ত্রিক সমাজের চেয়ে আলাদা, নিয়মকানুন শিথিল। অনুকূল আবহাওয়ায় তারা সবজি শুকিয়ে জমা করে প্রতিকূল সময়ের জন্য।
প্যাংগং হ্রদে ভ্রমণার্থীদের থাকার জন্য স্টার হোটেল যেমন আছে, তেমনি আমার মতো অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষদের জন্য রয়েছে তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা।
এখানে আসতে হয় লাদাখের রাজধানী লেহ থেকে। সাধারণ ভ্রমণকারীরা তাই করেন। কারণ, লেহ থেকে অনুমতিপত্র জোগাড় করে তবেই এই নয়নাভিরাম হ্রদের মুখোমুখি বসা যায়। ভারত-চীন সীমান্তবর্তী এলাকা, কড়া নিরাপত্তাবেষ্টনী পার হয়ে তবেই এর দেখা মেলে। লেকের জলে কোনো জীব বা উদ্ভিদের সন্ধান মেলেনি। সাঁতার কাটা বা নৌকাভ্রমণ নিষিদ্ধ এখানে, কারণ, সীমান্তবর্তী নিরাপত্তা।
সাধারণত প্যাংগং হ্রদে এলে এক রাত থেকে তবেই ফেরেন দর্শনার্থীরা। এ জন্য নিজস্ব ট্যাক্সি ভাড়া করে নিয়ে আসেন সবাই। লেহ শহর থেকে ৫/৬ ঘণ্টার পথ, ১৫৮ কিমি। আমি সেখানে ফিরলাম তার পরদিন, একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে। ভ্রমণের আরও কত বাকি।
দুই হাজার বছর আগে থেকেই সিল্ক রুটের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র এবং পূর্ব ও পশ্চিম এশিয়াকে সংযোগকারী হিসেবে পরিচিত ছিল লাদাখ। এই উচ্চ মালভূমিতে ৪৫ মিলিয়ন বছর আগে থেকেই পর্বতমালার অস্তিত্ব ছিল বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। সিন্ধু নদ লাদাখকে সমৃদ্ধ করেছে চাষবাস ও বাণিজ্যে।
লাদাখ শব্দের অর্থ হচ্ছে গিরিপথের ভূমি। জনপদটি এতই প্রাচীন যে প্রস্তর যুগের সময়কার খোদিত মূর্তির সন্ধান এখানে পাওয়া গেছে।
লেহ শহরে প্রথম দিনে ঠিক করলাম, শহরটা খানিক হেঁটে দেখে ফেলবো। আমি উঠেছিলাম হোম স্টেতে। লেহ শহরে হোটেলে থাকার চেয়ে হোম স্টেতে থাকা আমার জন্য সুবিধাজনক মনে হয়েছিল। কোনো এক পরিবারের সঙ্গে থেকে তাদের জীবনযাপন, সংস্কৃতি জানার সুযোগ আরও বেড়ে যায়। যার বাড়িতে অতিথি হয়েছিলাম তিনি পেশায় ডাক্তার, ডা. মরুপ। স্বামী-স্ত্রী থাকেন গৃহকর্মী নিয়ে, সন্তানেরা অন্য শহরে চাকরিরত। খুব সুন্দর গোছানো বিশাল তিনতলা বাড়ি, তার চেয়েও সুন্দর বাড়ির সামনে গড়ে তোলা ফুলের বাগান।
লেহ শহর সম্পর্কে বলে নিই। লাদাখের রাজধানী লেহ হিমালয়ের কোল ঘেঁষে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১১ হাজার ৫৬২ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকেই এটি সিন্ধু উপত্যকার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। সিল্ক রুট, যা ভারতকে চীনের সঙ্গে যুক্ত করেছে, সে পথটির প্রাণকেন্দ্র ছিল এই নগর। শহরটি তিব্বতীয় সংস্কৃতি প্রভাবিত এবং বেশির ভাগ মানুষ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। অষ্টম শতাব্দী থেকে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজন লাদাখে বাণিজ্য করতে আসা শুরু করে কাশ্মীর থেকে এবং তখন থেকেই মুসলমান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায় শান্তিপূর্ণভাবে মিলেমিশে বসবাস করছে।
লেহ ভ্রমণ শুরু করলাম লেহ প্যালেস থেকে। এটি তিব্বতের পোটালা প্যালেসের আদলে তৈরি করা হয়েছিল প্রায় একই সময়, ১৬৪৫ সালে। সাধারণ পাথর, মাটি ইত্যাদি দিয়ে তৈরি নয়তলা এ প্রাসাদে নেই কোনো জৌলুশ। এতেই বোঝা যায় লাদাখের রাজারা নিজেদের আরাম-আয়েশ, জাঁকজমকপূর্ণ জীবনের বদলে জনসাধারণের মঙ্গল চিন্তায় আর ধর্মকর্মে ব্যস্ত থাকতেন। লেহ শহরের প্রায় সব প্যাগোডা, বাড়িঘরই তিব্বতীয় ধাঁচে তৈরি করা হয়েছে। সফেদ সুন্দর দেয়াল আর তার খয়েরি ছাদ, কাঠের দরজা। সংস্কৃতি, উৎসব ইত্যাদিতেও তিব্বতীয় প্রভাব প্রকট।
সময়টা আগস্ট মাস। আবহাওয়া চমৎকার। রাতে একটু ঠান্ডা পড়ে আর দিন আরামদায়ক। কোল্ড ডেজার্ট বা ঠান্ডা মরুভূমির আবহাওয়া। শুষ্ক। হাঁটা শুরু করলাম ‘শান্তি স্তুপা’ বা ‘পিস প্যাগোডা’ অভিমুখে। জনসাধারণের প্রার্থনার জন্য এ প্যাগোডা নির্মাণ করা হয়েছিল ১৯৯১ সালে। পাহাড়ি এলাকা, বেশির ভাগ প্যাগোডাই পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে দর্শন করতে হয়।
এরপর চললাম লাদাখের দুটো প্রাচীন গুরুত্বপূর্ণ মনাস্টেরি দর্শন করতে। থিকসে ও হেমিস। দুটো মনাস্টেরি বা মঠ লেহ শহরের বাইরে। তাই ট্যাক্সি চেপে যেতে হলো।
থিকসে লাদাখের বৃহৎ মনাস্টেরি হিসেবে গণ্য। বারো তলা এ ভবন সিন্ধু উপত্যকায় অবস্থিত, যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১১ হাজার ৮০০ ফুট উঁচুতে। নির্মাণকাল ১৫ শতকের গোড়ার দিকে। দেয়ালজুড়ে প্রাচীন তিব্বতীয় চিত্রকলা মঠের শোভা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এখানে ভিক্ষু আছেন ৬০ জন। কয়েকজন ভিক্ষুর সঙ্গে কথা হলো। তারা আশপাশের গ্রাম থেকে পড়তে এসেছেন। লাদাখ ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে বাইরের জগৎ সম্পর্কে এদের ধারণা তেমন নেই। প্রকৃত সুখী মানুষ যেন এরাই।
এরপর চললাম হেমিস মনাস্টেরির সন্ধানে। লেহ শহর থেকে ৪৫ কিমি দূরে। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা ধারণা করেন, এর নির্মাণকাল এগারো শতকের আগে। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে হেমিস মনাস্টেরিতে বসে সূর্যাস্ত দেখলাম ভিক্ষুদের সন্ধ্যাকালীন প্রার্থনার সুরের সঙ্গে। মঠের ভেতরকার দৃশ্য দেখলে মনে হবে, তিব্বতে এসে পৌঁছেছি।
ফিরে এলাম লেহ শহরে। এখানে তিব্বতীয় রিফিউজিদের একটি বিশাল অংশ বসবাস করছে বহু বছর ধরে। ভারতের বিভিন্ন স্থানে তাদের বাস দেখেছি। সে এক দুর্বিষহ জীবন, যদিও কেউ অর্থকষ্টে নেই, তবু নেই তাদের নাগরিকত্ব, ভুলতে পারে না প্রাণের জন্মভূমিকে, কারও কারও জন্ম ভারতেই কিন্তু ফিরে যাবার ব্যবস্থা নেই নিজ ভূমিতে। লেহ শহরে তিব্বতিদের মার্কেটে যেতে ভুলবেন না যেন।
লাদাখে পঞ্চম দিন। ‘খারদুংলা পাস’-এর উদ্দেশে রওনা হলাম। আগের দিন ভাড়া করা বাইক ঠিকঠাক করে রেখেছিলাম ৪০ কিলোমিটারের গিরিপথ পার হবার জন্য। খারদুংলাকে বলা হয় পৃথিবীর উচ্চতম ইঞ্জিনচালিত যানবাহনের পথ, যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮ হাজার ৪০৬ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। যারা অ্যাডভেঞ্চারপিয়াসী তারা আঁকাবাঁকা এই গিরিপথে বাইক চালাতে পছন্দ করবেন।
লেহ থেকে সকাল সকাল রওনা দিলাম। কারণ, শুধু খারদুংলা পাস নয়, আশপাশের গ্রামগুলোও ঘুরে দেখতে চাইছিলাম।
এক পাশে চুনাপাথর ও অন্যান্য খনিজের উঁচু পাহাড়, অন্য পাশে সোনালি পর্বতরাশি আর মধ্যখানে সুগঠিত পিচঢালা পথ।
বাইক চালিয়ে আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে যখন খারদুংলা পৌঁছালাম, তখন সেখানে ঝিরিঝিরি বরফ পড়ছিল। এখানে বলতে গেলে সারা বছরই বরফ পড়ে। অথচ নিচে লেহ শহর মেঘমুক্ত, ঝকঝকে। আমার আগে ও পরে অনেক ভ্রমণার্থী এসে পৌঁছেছেন বাইক, ট্যাক্সি বা বাইসাইকেলে চড়ে। কিছুক্ষণ এই গিরিপথে কাটিয়ে গিরিপথ বেয়ে নেমে পড়লাম গ্রামের দিকে।
কোয়ুল গ্রামটি লেহ শহর থেকে খুব বেশি দূরে নয়। গ্রামবাসী আপ্যায়ন করল লাদাখের বিখ্যাত চা দিয়ে। এই চায়ের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, চিনির বদলে লবণ এবং অল্প মাখন দিয়ে তৈরি করা হয়। খেতে খারাপ নয়। গ্রামবাসীর প্রধান পেশা কৃষিকাজ ও পশুপালন, যা সম্ভব হয় গ্রীষ্মকালে। শীতকাল গৃহবন্দি থাকার সময়, কারণ তাপমাত্রা মাইনাস ৩০ ডিগ্রি পর্যন্ত নেমে যায় এবং ভারী তুষারপাতে যাতায়াত ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। গ্রামবাসী আরও একটি সুস্বাদু খাবার খেতে দিল, যার নাম স্ক্যুয়ু। পাস্তার মতোই।
লাদাখে আমার ভ্রমণ প্রায় শেষের দিকে এসে ঠেকেছে। ষষ্ঠ দিনে চলে গেলাম নুবরা ভ্যালি দেখতে। লেহ শহর থেকে ১৪০ কিমি দূরে। নুবরা ভ্যালিতে প্রবেশের জন্য অনুমতিপত্র জোগাড় করতে হয় লেহ থেকে। যেকোনো ট্রাভেল এজেন্ট তা করে দিতে পারে অথবা নিজে গিয়েও সংগ্রহ করা যায়।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত নুবরা ভ্যালি হলো শেওক এবং সিয়াচেন নদীর মিলনস্থল। শেওক নদী সিন্ধু নদের শাখা মাত্র। এই উপত্যকাজুড়ে গড়ে উঠেছে জনবসতি। শুষ্ক লাদাখে এত সবুজের সমারোহ নুবরায় এলেই দেখা যায়। একধারে সুউচ্চ পর্বতমালা আর তার পাদদেশে সবুজ কার্পেট বিছিয়ে দেয়া হয়েছে যেন। স্মৃতিতে এনে দেয় শৈশবে পড়া কোনো তিব্বতীয় উপকথা।
এরপরের গন্তব্য তুরতুক গ্রাম। খুব পুরোনো গ্রাম এটি, ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের অধীনস্থ ছিল। সে-বছর ভারত পাকিস্তান সীমান্ত যুদ্ধে গ্রামটি ভারত দখল করে নেয়। এখানকার অধিবাসীরা বাল্টিস্থানী মুসলমান। নুবরা ভ্যালি আর তুরতুক গ্রাম দেখা শেষ করে রাত কাটিয়ে দিলাম মেঘমুক্ত তারাভরা আকাশের নিচে। মানে নুবরাতেই। কারণ, পরদিন খুব ভোরে যেতে হবে ঐতিহাসিক ‘কারগিল’ এবং সমাপ্তি হবে মনোমুগ্ধকর লাদাখ ভ্রমণের।
ট্যাক্সিচালক আলী ভাই আমাকে লেহ ও তার আশপাশের জায়গাগুলো ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। লাদাখের সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে অনেক তথ্য তিনি দিয়েছেন আমাকে। তার সঙ্গে চলে গিয়েছিলাম ট্যাক্সিচালকদের আড্ডায়, লেহ ট্যাক্সিস্ট্যান্ড, সাধারণ মানুষের দেখা পেতে। উল্লেখ্য, লাদাখ পুরো ভারতে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। এখানকার মানুষদের মতো সরল, অতিথিপরায়ণ ভারতের অন্য কোথাও আমি দেখিনি।
কারগিল লেহ শহর থেকে ২৩৪ কিমি দূরে ভারত পাকিস্তান সীমান্তে অবস্থিত। সেখানে পৌঁছানোর আগে দেখে নিলাম লাদাখের সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহৎ মনাস্টেরি লামায়ুরু। নবম শতাব্দীতে এ মঠ নির্মাণ করা হয়। দেড় শ জন ভিক্ষু। লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন এ মঠ দূর থেকে রহস্যময় দেখায়।
কারগিল শহরে পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে গেল। ভারত পাকিস্তান সীমান্তবর্তী হওয়ায় দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনার হাওয়া এই জনপদের ওপর দিয়ে বেশ কয়েকবার রয়ে গেছে। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ হয়েছিল এখানে। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ১৯৯৯ সালের যুদ্ধ, যাতে দুই দেশের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। দুই দেশেরই হাজারখানেক সৈন্য নিহত হয়েছেন। এখানে ওয়ার মেমোরিয়াল মিউজিয়াম কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। তবে কারগিলকে প্রকৃতি উদার হস্তে দান করেছে গিরিমালা, সবুজ বনানী ও সুউচ্চ পর্বতরাশি।
এখানে ভ্রমণ শেষ করে চললাম পরবর্তী গন্তব্য শ্রীনগরের দিকে। কিন্তু মন পড়ে রইল লাবণ্যময় লাদাখে। যদি আপনার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকতে ইচ্ছে হয় বা যদি মনে হয় কোথাও হারিয়ে যাবার নেই মানা, তাহলে লাদাখ আদর্শ স্থান। ভারতের অন্যান্য জায়গার মোবাইল নেটওয়ার্ক এখানে কাজ করে না। আর ইন্টারনেটের ব্যবস্থা এখানকার সব জায়গায় নেই। তাই যদি দুদ- শান্তিতে, ঝঞ্ঝাটবিহীন থাকতে চান, চলে যেতে পারেন লাদাখ।
উল্লেখযোগ্য তথ্য
ঢাকা থেকে লেহ পর্যন্ত সরাসরি কোনো ফ্লাইট নেই। কলকাতা ও দিল্লি থেকে বিমানে লেহ পৌঁছানো যায়।
সড়কপথে দিল্লি, চ-ীগড়, মানালি, শ্রীনগর থেকে লেহ যেতে হয় ট্যাক্সি বা বাস ধরে। মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সড়কপথ খোলা থাকে। বাকি সময় ভারী তুষারপাত ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে লাদাখের সব সড়ক বন্ধ থাকে। শীতকালে বেশি তুষারপাতের কারণে মাঝে মাঝে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ থাকে।
সব মানের হোটেলের ব্যবস্থা আছে লাদাখে। কারণ, গত সাত-আট বছরে এটি প্রধান এক ভ্রমণ গন্তব্য হয়ে গেছে।
তিব্বতীয় সুস্বাদু খাবার যেকোনো রেস্টুরেন্টে মিলবে। তবে তিব্বতীয় ধাঁচের ডেকোরেশন পিস বা গয়না কিনতে ভুলবেন না।
Wonderful read! Hoping to read more articles written by this writer.