skip to Main Content

ফিচার I শতবর্ষী ডিম ভক্ষণ!

সেঞ্চুরি এগস। ঐতিহ্যবাহী এশিয়ান পদ। এতে নিরাময়যোগ্য মিশ্রণে ডিমগুলোকে বহুদিন ধরে সংরক্ষণ করা হয়। ফলে কালে কালে ডিমের রং যদিও কালচে হয়ে যায়, তবে স্বাদ হয়ে ওঠে অতুলনীয়

কত দিনের পুরোনো ডিম খাওয়া সম্ভব? কিংবা বলা ভালো, স্বাস্থ্যকর? সার্চ ইঞ্জিন ঘেঁটে কেউ কেউ হয়তো দিন কতকের কথা বলবেন, তাই বলে বহুদিনের পুরোনো ডিম খাওয়ার কথা নিশ্চয় ভুলেও ভাববেন না? অথচ সেঞ্চুরি এগস পুরোনো হলেই জমে বেশি!
খাবারটির নাম যদিও শতবর্ষের ইঙ্গিতবাহী, অর্থাৎ ১০০ বছরের পুরোনো ডিম খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়; তবে অত দিন না হলেও সেঞ্চুরি এগস প্রস্তুত করতে বেশ দীর্ঘ সময়ই লেগে যায়। মূলত চীনে চল রয়েছে এই বিশেষ পদের; হংকং ও তাইওয়ানের মতো কিছু এশিয়ান দেশেও জনপ্রিয়। এ জন্য ডিমকে কাদামাটি, লবণ, কাঠের ছাই ও চুনের একটি মিশ্রণে কয়েক সপ্তাহ, এমনকি কয়েক মাস ধরে সংরক্ষণ করা হয়। এই প্রক্রিয়া চলাকালে ডিমের বাহ্যিক সাদা অংশ ধীরে ধীরে গাঢ় বাদামি কিংবা কালো এবং নরম ও আঠালো হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ভেতরের কুসুম রূপ নেয় গাঢ় সবুজ রঙে।
কেমন স্বাদ সেঞ্চুরি এগসের? মূলত লবণাক্ত। খেতে মিহি ও ননিতুল্য টেক্সচার সমৃদ্ধ। সাধারণত সয়া সস কিংবা কনজি (চালের জাউবিশেষ) যোগে পরিবেশন করা হয়। হাঁসের ডিম, কোয়েল পাখির ডিম, মুরগির ডিমসহ বিভিন্ন ধরনের ডিম দিয়ে তৈরি করা যায় পদটি। এর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নামও; যেমন থাউজেন্ড-ইয়ার এগস, থাউজেন্ড-ইয়ার-ওল্ড এগস, হান্ড্রেড-ইয়ার এগস, মিলেনিয়াম এগস, স্কিন এগস কিংবা প্রিজারভড এগস।
নাম শুনে কিংবা প্রক্রিয়া জেনে অনেকে সেঞ্চুরি এগসকে পচে যাওয়া বা নষ্ট ডিম হিসেবে গণ্য করেন। অথচ তা একদমই ভুল ধারণা। বরং যদি যথাযথ প্রক্রিয়ায় এই পদ তৈরি করা যায়, তাহলে বহুদিন সংরক্ষণ করা সত্ত্বেও ডিমগুলো ক্ষতিকর জীবাণুমুক্ত থাকবে এবং তা খাওয়া সম্পূর্ণ নিরাপদ।
সেঞ্চুরি এগসের ইতিহাস বেশ পুরোনো। ধারণা করা হয়, দীর্ঘকালের জন্য ডিম সংরক্ষণের প্রয়োজন থেকেই এ পদের উদ্ভাবন। ডিম সংরক্ষণের এই পদ্ধতির প্রথম উদাহরণ মেলে প্রায় ৬০০ বছর আগে; চীনে, মিং রাজবংশের শাসনামলে। সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না থাকলেও এ নিয়ে ছড়িয়ে আছে হরেক গল্প। এর মধ্যে একটি হলো, একদিন চীনের হুয়ান প্রদেশের এক লোক নিজের বাড়ির নির্মাণকাজে ব্যবহৃত ভেজা চুনামাটিতে কয়েকটি হাঁসের ডিম খুঁজে পেয়েছিলেন। কালচে হয়ে যাওয়া পুরোনো সেই ডিমগুলো ছিল খাওয়ার উপযোগী। আর তাতেই তার মাথায় এভাবে ডিম সংরক্ষণের আইডিয়া খেলে যায়। আরেকটি গল্প থেকে জানা যায়, একবার এক লোক বাড়ির বাইরের আঙিনায় এক নারীর জন্য কয়েকটি হাঁসের ডিম লুকিয়ে রেখেছিলেন; সেগুলো কয়েক মাস পর খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। বিশেষভাবে সংরক্ষিত সেই ডিমগুলোও ছিল আহারযোগ্য। সেই থেকে সেঞ্চুরি এগসের প্রচলন।
গল্প কিংবা সত্যি—যা-ই হোক, খাদ্য ইতিহাসবিদদের ধারণা, প্রাথমিকভাবে সেঞ্চুরি এগস ছিল স্রেফ ডিম সংরক্ষণের একটি পদ্ধতি; তবে বহু শতাব্দী ধরে নিরাময়যোগ্যকরণ প্রক্রিয়ার বিকাশের মাধ্যমে এই ডিম একটি দারুণ ও সমৃদ্ধ স্বাদে উন্নীত হয়ে বর্তমানের চীনা সুখাদ্যে পরিণত হয়েছে। লোকে এটি করতেন কাঠের ছাই, লবণ ও ক্যালসিয়াম অক্সাইডের মিশ্রণে তৈরি আরও বেশি জটিল ক্ষারীয় কাদামাটি ব্যবহারের মাধ্যমে, যেটি এমন একটি রাসায়নিক প্রক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল, যাতে ডিমটিতে সোডিয়াম উপাদান ও পিএইচের (হাইড্রোজেনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের রসায়ন) বৃদ্ধি ঘটেছে। ঐতিহ্যগতভাবে, কাটামাটির মিশ্রণটি তৈরি করা হতো একটি স্ট্রং ব্ল্যাক টির মধ্যে এবং এরপর ডিমগুলো চালের তুষ কিংবা ভুষি দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হতো নিরাময়যোগ্য রাখতে।
কালের বিবর্তনে সেঞ্চুরি এগস প্রস্তুত প্রক্রিয়ায় এসেছে পরিমার্জন। তবে স্বভাবতই খাদ্য নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে। আধুনিক প্রক্রিয়ায় ঘরে বসে কীভাবে নিতে পারবেন এর স্বাদ? চলুন, রন্ধনশৈলীবিষয়ক অন্তর্জাল মাস্টারক্লাস সূত্রে জেনে নিই সহজ রেসিপি:
 সময়: প্রস্তুতির জন্য ১০ মিনিট, রান্নার জন্য ১ ঘণ্টা ২১ মিনিট।
 উপকরণ: ২৪টি কোয়েল পাখির ডিম, ১২ আউন্স পানি, ৫টি টি-ব্যাগ অথবা ৪ চা-চামচ ব্ল্যাক টি, ২.৫ আউন্স কোশের সল্ট, ১.৫ আউন্স ফুড-গ্রেড অথবা ভক্ষণযোগ্য সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড, ০.০০২ আউন্স ফুড-গ্রেড জিংক।
 প্রণালি: শুরুতে ব্ল্যাক টি প্রস্তুতের জন্য একটি ছোট পাত্রে পানি গরম করা চাই। তারপর চুলা নিভিয়ে ব্ল্যাক টি ব্যাগ ও লবণ যোগ করতে হবে। পানিকে এবার ঘরের তাপমাত্রার সমতুল্য ঠান্ডা হতে দিন। তারপর টি ব্যাগগুলো সরিয়ে ফেলুন। এরপর দ্বিতীয় ধাপে সোডিয়াম হাউড্রক্সাইড ও জিংক যোগ করুন। এ সময়ে নিজের সুরক্ষায় প্রটেকটিভ গ্লাভস পরতে ভুলবেন না; একই সঙ্গে রান্নাঘরে বায়ু চলাচল যেন ভালোভাবে থাকে, তা নিশ্চিত করুন এবং যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখুন। কেননা, সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড স্পর্শ কিংবা গলাধঃকরণ করা স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই বিপজ্জনক। তাই গ্লাভস পরে, ব্ল্যাক টির ওই মিশ্রণে সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড ও জিংক খুব ধীরে ধীরে ঢালতে হবে। এরপর নেড়ে ভালোভাবে মেশানোর জন্য কোনো স্টেইনলেস স্টিলের চামচ অথবা তৈজসপত্র ব্যবহার করুন। এবার তৃতীয় ধাপে আপনার পরিহিত গ্লাভস অথবা কোনো স্টেইনলেস স্টিলের চামচ দিয়ে সতর্কতার সঙ্গে ডিমগুলো এক-এক করে মিশ্রণে যোগ করুন। ওই পাত্রে সব ডিম দেওয়া হয়ে গেলে পাত্রটি ঢেকে দিন এবং টেপ দিয়ে ঢাকনা সিলগালা করুন। ওই পাত্রের গায়ে তারিখ লিখে রাখুন, যেন আপনার জানা থাকে, কবে এগুলো বানিয়েছিলেন। চতুর্থ ধাপে ডিমগুলো সংরক্ষণে রাখুন। এগুলোকে এমন কোনো শীতল ও অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানে রাখা চাই যেন কোনো উৎপাতের শিকার না হয়! এভাবে পাত্রটি ১২ দিনের মতো রেখে দিন। তারপর পঞ্চম ধাপে, প্রটেকটিভ গ্লাভস পরে পাত্রটির ঢাকনা খুলে ডিমগুলো তুলে আনুন। এবার ডিমগুলোকে ভালোভাবে ধুয়ে, এক ঘণ্টা রেখে দিন শুকানোর জন্য। ষষ্ঠ ধাপে ডিমগুলো একটি প্লাস্টিকের সিলযোগ্য ব্যাগে ভরে ফেলুন। তারপর রেখে দিন একটি লাইট-প্রুফ কনটেইনারে; এ ক্ষেত্রে ঢাকনাযুক্ত কোনো পাত্র ব্যবহার করতে পারেন।

তারপর আবারও সেটি রেখে দিন কোনো শীতল ও অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানে, যেন কেউবা কোনো কিছু জ্বালাতন না করে! এভাবে অন্তত ৩০ দিনের জন্য রেখে দেওয়া চাই। এরপর সপ্তম ধাপে কনটেইনার থেকে ডিমগুলো তুলে আনুন। একটি মাঝারি আকারের পাত্রে পানি গরম করে, ফুটন্ত পানিতে ডিমগুলো ১ মিনিট রেখে দিন। তারপর সেগুলোকে এক বোল ঠান্ডা পানিতে তুলে রাখুন। সর্বশেষ ধাপে মৃদু চাপ দিয়ে ডিমগুলোর খোসা সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে ফেলুন। খেয়াল করে দেখুন, ডিমের রং গাঢ় সবুজ কিংবা কালো হয়ে গেছে কি না। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে খাওয়ার জন্য প্রস্তুত আপনার নিজ হাতে তৈরি সেঞ্চুরি এগস! আদাকুচি, সয়া সস, সিচুয়ান সস কিংবা তিলের তেলযোগে এর স্বাদ বহুগুণ বেড়ে যাবে।
পরিশেষে বলি, কালের যাত্রা ধরে এখনো দারুণ জনপ্রিয় এই বিশেষ পদ রেস্তোরাঁয় কিংবা ঘরে বানিয়ে চেখে দেখার আগে অবশ্যই নিশ্চিত হওয়া চাই, এটি ভোজনযোগ্য কি না। অন্যথায় স্বাস্থ্যঝুঁকির শঙ্কা রয়ে যাবে।

ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top