skip to Main Content

স্বাদশেকড় I টাকো টক্কর

অন্যতম প্রধান মেক্সিকান ফুড। টিকে রয়েছে কয়েক শতাব্দী ধরে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পেয়েছে আধুনিকতার পরশ। যত দূর জানা যায়, রৌপ্য খনি থেকে এর যাত্রা শুরু

টাকোর বিরাজ এখন দুনিয়াময়। ভুট্টাভিত্তিক টর্টিলা মোড়ানো এই খাটি মেক্সিকান ফুডের রয়েছে নানা বৈচিত্র্য; যেমন কার্নিটাস, বারবাকোয়া, আল প্যাস্টোর, অ্যাডোবাডা। টাকো শব্দের উৎপত্তি নাহুয়াটল বা নাহুতল (মেক্সিকান আদিভাষী জনগোষ্ঠীর ভাষাবিশেষ) ভাষার ‘টলাহকো’ থেকে; যার অর্থ ‘অর্ধেক’ বা ‘মাঝখানে’। সুস্বাদু ফ্ল্যাটব্রেড খাওয়ার আগে কীভাবে ভাঁজ করা হয়, সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় এই নামকরণ থেকে।
টাকোর উৎপত্তি ভুট্টা থেকে। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৩০০০ অব্দে মেক্সিকানরা ভুট্টা চাষ করতে তেহুয়াকান ভ্যালির মরুভূমি খনন করে সেখানে ঘাসের সংকরণ করেছিলেন। আদিবাসী সংস্কৃতিতে ভুট্টাকে মানবতার ভিত্তি বা জীবনের বীজ হিসেবে দেখা হতো। এমনকি তারা বিশ্বাস করতেন, মানুষ ভুট্টা থেকে তৈরি।
প্রাচীন সংস্কৃতিতে ভুট্টাকে সম্মান করার অন্যতম কারণ, এটি আক্ষরিক অর্থেই তাদের প্রাণে টিকে থাকতে সাহায্য করার পাশাপাশি সামগ্রিক জীবনযাত্রার ব্যাপক উন্নতি ঘটাতে ভূমিকা রেখেছিল। ভুট্টাদানাগুলোকে একটি অ্যাসিডিক ট্রিটমেন্ট দিয়ে দুধ অথবা পানি যোগে সেগুলো থেকে ভুসি অপসারণ করা যায়। তারপর মিহি ভুট্টার আটার বেস তৈরি করে টর্টিলা (পাতলা, ফ্ল্যাট প্যানকেক যা কর্নমিল দিয়ে তৈরি) বানানো হয়। হাজারো বছর আগে থেকেই ভুট্টার নানাবিধ ব্যবহার পরিলক্ষিত হলেও ইতিহাসবিদেরা ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ওলমেক সভ্যতায় (১৬০০—৪০০ খ্রিস্টপূর্ব) নিক্সটামালাইজড ভুট্টার প্রথম আভিধানিক অস্তিত্ব লক্ষ করেন। যার অর্থ, সম্ভবত সে সময় তারা তাদের খাদ্যের মধ্যে ভুট্টার রুটি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
আজটেক সভ্যতার প্রখ্যাত শাসক দ্বিতীয় মোকটেজুমার (শাসনামল ১৫০২-১৫২০) জন্য তৈরি এই খাবারে ভুট্টার টর্টিলাকে একটি উষ্ণ ও শক্ত আকার দেওয়া হতো। এই প্রক্রিয়া খাবারটিকে স্কুপে ধরে রাখতে সাহায্য করত। ১৫১৯ সালে শুরু হওয়া স্প্যানিশ-আজটেক যুদ্ধে এর দুই বছর পর বিজয়ের মাধ্যমে আজটেক সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়েছিলেন স্প্যানিশ দিগ্বিজয়ী এবং নিউ স্পেনের প্রথম গভর্নর হার্নান কর্টেজ। তিনি সে সময় তার সৈন্যদের ভুট্টা টর্টিলা ও শূকরের মাংস খাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
যদিও টাকো প্রাচীন খাবার এবং উৎস-শব্দ অনুসারে একে সহজভাবে ভাঁজ করার কথা বলা হয়েছে, তবে এই মেক্সিকান রন্ধনপ্রণালি বিশ্বে নানা সময়ে নতুন মোড় পেয়েছে। টাকোর উৎপত্তি সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া না গেলেও বিশেষজ্ঞদের মত অনুসরণ করে এই মসলাদার, কার্ব-ভর্তি ডিলাইটের ইতিহাসের পাতায় একটু ঢুঁ মারা যাক।
খনি থেকে উঁকি
অথেনটিক মেক্সিকান টাকোর আধুনিক সংস্করণের বিকাশ ঘটেছে উনিশ শতকের কোনো এক সময়ে, মেক্সিকান সিলভার খনিতে। ‘টাকো ডি মাইনারো’ বা ‘খনিশ্রমিকদের টাকো’ নামে। যদিও নিশ্চিত নয়, তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকে বিশ্বাস করেন, ‘টাকো’ বলতে প্রাথমিকভাবে একটি পাতলা কাগজে মোড়ানো গোলাবারুদ-সংবলিত ডিনামাইটকে বোঝাত, যেটি পাথরের মুখের গর্ত উড়িয়ে দিতে এবং আকরিক খননকাজে ব্যবহৃত হতো। সুস্বাদু টর্টিলা মোড়ক কীভাবে গোলাবারুদের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ, তা বোঝা সম্ভব যদি টাকোর আধুনিক রূপ অনুধাবন করা যায়। একটি ছোট টাকো, অর্থাৎ টাকিটো দেখতে অনেকটাই ডিনামাইটের একটি ছোট লাঠির মতো!
সে যাক! সিলভার খনি থেকে এই সুস্বাদু খাবার মেক্সিকোর শ্রমজীবী শ্রেণির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে টাকোরিয়ারা পরিমিত দামে এটি অফার করতেন। একসময় অভিবাসী নারীরা সেখান থেকে মেক্সিকো সিটিতে বিক্রি করার জন্য টাকো নিয়ে আসেন। আর শহরটি দ্রুতই সে দেশের বৃহত্তম টাকো হাবে রূপ নেয়।
১৯০৮ সালে কুয়াউতলা শহরে মোরেলোস সস, চোরিজো, গ্রিন সস এবং পর্ক রাইন্ডস দিয়ে মোল ভার্দে টাকোর পাশাপাশি আরও অনেক ধরনের টাকো তৈরি করা হয়। অবশেষে এই টাকোগুলো দেশটির মোরেলোস প্রদেশের রাজধানী কুয়ের্নাভাকাতে বিস্তার লাভ করে।
গত শত বছরে
গেল ১০০ বছরে টাকোর ঘটেছে ব্যাপক বিস্তার। তাতে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে ঝুড়ি! বলছি টাকো বাস্কেটের কথা। মেক্সিকোতে এক বিরাট অর্থনৈতিক সংকট ও বেকারত্বের কারণে দেশটির সবচেয়ে ছোট প্রদেশ তলাক্সকালার রাজধানীবাসী টাকো বিক্রির একটি আধুনিক কৌশল উদ্ভাবন করেছিলেন। বেকার নাগরিকেরা বিশেষ ঝুড়ি তৈরি করে, সেগুলোতে খাবারটি বহন করে বিক্রি শুরু করেন। টাকো প্রস্তুতকারীরা প্রতিদিন সকালে টাকো বাস্কেটগুলো জড়ো করতেন। তারপর বাইকে চেপে রওনা হতেন ফেরি করে এই সুস্বাদু খাবারগুলো বিক্রি করার জন্য। টাকো বাস্কেটের সেই চল এখনো রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভ্যানে করে টাকো বিক্রির রেওয়াজ।
১৯৩০ থেকে ১৯৬০-এর দশকে মেক্সিকোতে লেবানিজদের ব্যাপক অভিবাসন ঘটে। এর ফলে খাদ্যসংস্কৃতিতে ঘটে বিনিময় ও সংমিশ্রণ। তাতে বিকাশ ঘটে টাকো আল প্যাস্টোর। অনেকের মতে, এটিই সবচেয়ে জনপ্রিয় টাকো। এই মেক্সিকান খাবারে বিদেশি খাদ্যসংস্কৃতির প্রভাব পড়ার প্রথম ফলও এটি।
অন্যদিকে, মেক্সিকান অভিবাসীরা প্রাথমিকভাবে আমেরিকায় টাকো নিয়ে আসেন সে সময়ে, যখন তারা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে রেলপথ নির্মাণের কাজ খুঁজতে এসেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর একদম গোড়ার দিকে, মেক্সিকান টাকো কার্টগুলো লস অ্যাঞ্জেলেসে জায়গা করে নেয়। নারীদের মাধ্যমে পরিচালিত এসব কার্টকে বলা হতো ‘চিলি কুইন’। সে সময়ে বেশির ভাগ আমেরিকান ভোক্তাই টাকোকে নিম্নশ্রেণির স্ট্রিট ফুড বিবেচনা করতেন। আমেরিকান টাকোর সব উপাদান মেক্সিকান সংস্করণগুলোর চেয়ে বেশ আলাদা ছিল। কেননা, টাকোরোস বা টাকো প্রস্তুতকারীদের তখন স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য উপাদান যোগে কাজ করতে হয়েছিল।
হার্ড টাকো শেল (সংরক্ষণাগার ও বিক্রয়কেন্দ্র বিশেষ) আমেরিকান উদ্ভাবন বলে ধারণা করা হয়। সম্ভবত দীর্ঘ শেলফ লাইফের কারণে এর উৎপত্তি। সেখান থেকেই টাকো বিক্রি করা হতো। যাত্রা শুরুর প্রায় দশ বছর পর নতুনভাবে পথচলা শুরু করে এটি। পরিণত হয় ফাস্ট ফুড রেস্তোরাঁয়। নাম রাখা হয় ‘টাকো বেল’। এই নতুন মেক্সিকান-আমেরিকান রেস্তোরাঁ চেইনের পরবর্তী ইতিহাস তো কমবেশি সকল টাকোপ্রেমীরই জানা!
১৯৬২ সালে টাকো বেল শুরু করেছিলেন গ্লেন বেল। যদিও টাকো তত দিনে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত মেক্সিকান খাবার, তবু টাকো বেলের হাত ধরে যুক্তরাষ্ট্রব্যাপী এটি মূলধারায় উঠে আসে। মজার ব্যাপার হলো, এই তুমুল জনপ্রিয় রেস্তোরাঁগুলোর কোনোটিই জনবহুল মেক্সিকান অঞ্চলে ছিল না। টাকো বেল এই মেক্সিকান খাবারের একটি আমেরিকান সংস্করণ মূলত নন-মেক্সিকানদের কাছে বিক্রি করত। যেসব আমেরিকান আগে মেক্সিকান ফুড খাননি, সম্ভবত তাদের নতুন ও সুস্বাদু খাবার আস্বাদনের এমন সুযোগ করে দেওয়ার ফলেই ফ্র্যাঞ্চাইজিটি এমন সাফল্য পায়।
রাস্তা বনাম রেস্তোরাঁ
স্ট্রিট ফুড হিসেবে বিস্তার ঘটলেও রাস্তায় রাস্তায় যারা টাকো বিক্রি করতেন, টাকো বেল ও অন্যান্য ফাস্ট ফুড জায়েন্টের প্রস্তুত করা এ খাবারের গতির সঙ্গে স্বভাবতই তারা তাল মেলাতে পারেননি। টাকোর বিস্তারে অবশ্য ব্যাপারটি মন্দ ছিল না। তবে কথা আছে! ফাস্ট ফুডে প্রাপ্ত সুবিধার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু স্বাদ ও গুণমানে আমরা হরদম আপোস করি। আপনি যদি কোনো মেক্সিকান স্ট্রিট সেলারের কাছ থেকে টাকোর স্বাদ পান, তাহলে রেস্তোরাঁয় পাওয়া এ খাবারের কোনো স্বাদের সঙ্গে সেটির তুলনাই টানতে যাবেন না যেন! ফাস্ট ফুড হিসেবে টাকোর স্বাদ মোটেই খারাপ নয়; তবে ঐতিহ্যের বিপরীতে এগুলোকে বেশ ‘পানিযুক্ত’ মনে হতে পারে।
বর্তমানে চিপোটল ও টাকো বেলের মতো বেশ কয়েকটি ফাস্ট ফুড রেস্তোরাঁ ছড়িয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে। এ খাবার নিয়ে প্রতিনিয়ত বেশ দাপটও দেখাচ্ছে সেগুলো। তাই বলে রাস্তা থেকে হারিয়ে যায়নি এই স্ট্রিট ফুড। মেক্সিকোতে তো বটেই, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি ছোট-বড় শহরের বিভিন্ন রাস্তায় হয়তো ভালোভাবে নজর বোলালেই দেখতে পাবেন, স্ট্রিট সেলার দাঁড়িয়ে রয়েছেন তার নিজের বানানো ঐতিহ্যবাহী ও অথেনটিক টাকো নিয়ে, আপনাকে আপ্যায়ন করার জন্য।

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top