বিশেষ ফিচার I আধিপত্যে এগিয়ে
লৈঙ্গিক সমতা নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা কম হচ্ছে না। কিন্তু সমতা কি সত্যিই আছে সর্বত্র? নাকি বৈষম্যের চিত্রটাই প্রতীয়মান হচ্ছে প্রতিনিয়ত? ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির কথাই ধরা যাক, সেখানেও কিন্তু অভিন্ন ছবিটাই দৃষ্টিগোচর হয়। না, সেটা কেবল বাংলাদেশেই নয়, গোটা গ্লোবেই। লিখেছেন শেখ সাইফুর রহমান
আবিশ্বের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি কি পুরুষশাসিত? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ‘এভরি ডে ইজ ফ্রাইডে’র লেখক নিনা সেগুরার একটি মন্তব্য মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছেন, ‘পুরুষপ্রধান না বলে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে পুরুষেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ বলাই শ্রেয়’।
এখন যেটাই বলি না কেন, চালকের আসনে আদপে সিংহভাগই পুরুষ। আর ওই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে চমৎকার সব তথ্য উঠে এসেছে। মজার বিষয় হলো, সারা বিশ্বের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির চালিকাশক্তি কিন্তু নারী। অথচ পরিচালন কর্তারা মূলত পুরুষ। এমনকি নারীদের ব্র্যান্ডেও।
বিশ্বের শীর্ষ সারির সব ব্র্যান্ডের কি ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর, কি প্রধান নির্বাহী বা স্বত্বাধিকারী—সবাই বলতে গেলে পুরুষ। এমনকি অর্থনীতি বা অন্যান্য ক্ষেত্রেও উচ্চপর্যায়ে নারীদের প্রতিনিধিত্ব এত কম নয়। অথচ আরও চোখ কপালে তোলা তথ্য হলো, সারা বিশ্বের ফ্যাশন স্কুল থেকে পাস করে ইন্ডাস্ট্রিতে যোগ দেওয়াদের অন্তত ৮৫ শতাংশই নারী। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ফ্যাশনবিষয়ক পড়াশোনায় এগিয়ে নারীরা। এ দেশে ফ্যাশন নিয়ে পড়াশোনার ক্ষেত্রে শীর্ষ দুটি বিশ্ববিদ্যালয় বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি (বিইউএফটি) এবং শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি—উভয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
২০১৮ সালের তথ্যানুযায়ী বিশ্বের শীর্ষ ৫০টি ফ্যাশন ব্র্যান্ডে নারীপ্রধান নির্বাহী ছিল মাত্র ১৪ শতাংশ; যদিও জানা গেছে, এই সংখ্যা হালে বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। তবে সেটা ৩১ শতাংশের বেশি নয়।
বছরের পর বছর ধরে আরও একটি বিষয় বেশ জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে। সেটি হলো, সারা পৃথিবীর ফ্যাশনে যত পণ্য প্রতিনিয়ত ডিজাইন ও তৈরি করা হচ্ছে, তার সিংহাভাগই মেয়েদের। এমনিতেই বলা হয়ে থাকে, নারী শরীরের জ্যামিতি ফ্যাশন ডিজাইনারদের পোশাক নকশায় প্রাণিত করে। আর সেটি নারী ও পুরুষ ফ্যাশন ডিজাইনারনির্বিশেষে। ফলে বাজারে যেকোনো স্তরে—তা সে বিলাসী পোশাকই হোক বা কেজো, মেয়েদের পোশাকই বেশি। এ জন্য আর্থিক যে আবর্তন, সেখানেও প্রাধান্য নারীদের। তারাই টিকিয়ে রেখেছেন এই শিল্প। অথচ প্রদীপের নিচে যে আঁধার! কারণ, নীতি নির্ধারণীতে তাদের অবস্থান দৃঢ় নয়। তাই ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে সাইজ-ইজম কিংবা বৈচিত্র্যহীনতার সমস্যা নিয়ে কথা হলেও এটিকে অস্বীকার করা উপায় নেই যে লৈঙ্গিক সমতার সমস্যাও প্রকট।
কিছু কিছু তথ্য রীতিমতো বিস্ময় জাগায়। মাত্র ৮ বছর আগে অর্থাৎ ২০১৬ সালে ক্রিস্তিয়ঁ দিওর প্রথম নারী ডিজাইনার নিয়োগ দেয়। আর জিভাঁশি দেয় তার পরের বছর।
আবার কিছু ব্যতিক্রম আছে। যেমন আমেরিকান ডিজাইনারদের মধ্যে ডোনা ক্যারান, ক্লেয়ার ম্যাককার্ডেল, বনি কাশিন, অ্যান ক্লেইন বা লিজ ক্লাইবোর্নরা তাদের লেবেল ঠিকই দাঁড় করিয়েছেন। আর প্রথম নারীপ্রধান নির্বাহী হয়েছেন রোজ মারি ব্রাভো। ১৯৯৭ সালে। তবে এসব নিতান্তই নগণ্য; বরং ম্যাককিঞ্জি অ্যান্ড কোম্পানির জরিপ বলে, বিশ্বের শীর্ষ ডিজাইনার ব্র্যান্ডই হোক বা রিটেইল, সুপারভাইজার পর্যন্ত নারীদের একটি অবস্থান থাকে। সংখ্যাটি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এর পরের ধাপে উঠতে সিঁড়ি ভাঙাটা নারীদের জন্য বেশ কঠিন। অন্তত ৫০ শতাংশ ঝরেই যায়।
একটা সময় পর্যন্ত নারীদের বেশ মজবুত অবস্থান ছিল ফ্যাশন পরিমণ্ডলে। কটুরিয়ার হিসেবে তাদের নামডাকও ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। দিওর, জিভাঁশি, আরমানি, ইভস সা লোরদের সমকক্ষ হিসেবে অবশ্য একজনের নাম একবাক্যে সবাই উচ্চারণ করবেন। তিনি কোকো শ্যানেল। তিনি ছিলেন একাই একটি প্রতিষ্ঠান।
পরবর্তীকালে জগৎ মাতানো আরও কয়েকটি নাম বলা যেতে পারে; যেমন ভিভিয়েন ওয়েস্টউড, স্টেলা ম্যাককার্টনি বা মিউসিয়া প্রাদা। এর বাইরে আছেন দোনাতেল্লা ভারসাচি। অবশ্য দোনাতেল্লার কপাল খোলে বড় ভাই জিয়ান্নি ভারসাচি অকালে খুন হওয়ায়।
পক্ষান্তরে, হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া ব্র্যান্ডগুলোতে নেই নারী ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে নারীকে নিয়োগ দিলেও পরে তাকে সরিয়ে পুরুষকে নিযুক্ত করা হয়।
প্রিয় পাঠক, একটি বিষয় কখনো খেয়াল করেছেন? এই যে বিশ্বে এত বড় বড় সব সম্মাননা অনুষ্ঠান হয়, এই যেমন অস্কার, এমি, গ্র্যামি ইত্যাদি; এসব অনুষ্ঠানে নারী সেলিব্রিটিরা যে পোশাক পরে লালগালিচা মাতান, সেগুলোর কয়টা নারীদের ডিজাইন করা? ঘুরেফিরে সেই পুরুষ ডিজাইনারদের নামই তো শোনা যায়। আরমানি, ভারসাচি, ভ্যালেন্তিনো, কার্ল লেগারফেল্ড, ইভস সা লোর, আলেকজান্ডার ম্যাককুইন ইত্যাদি। এদের মধ্যে কেউ কেউ বেঁচে আছেন। কিন্তু তাদের লেবেল তো আছে। এমনকি নারী ডিজাইনারদের তৈরি ব্র্যান্ডের প্রধানদের গদিতে আছেন পুরুষেরা।
কয়েক বছর আগে বিখ্যাত ফ্যাশন পোর্টাল বিজনেস অব ফ্যাশন নিউইয়র্ক, লন্ডন, মিলান আর প্যারিস—এই চার ফ্যাশন ক্যাপিটালে ফ্যাশন উইক চলাকালে একটি জরিপ চালায়। তাতে ৩১৩টি ব্র্যান্ডের ৩৭১ জন ডিজাইনারের মধ্যে মাত্র ৪০ শতাংশ নারী ডিজাইনারের উপস্থিতি খুঁজে পায়। তবে একটু আশাজাগানো চিত্র দেখা যায় লন্ডন আর মিলানে। এই দুটো শহরে উদীয়মান তরুণদের উপস্থিতি বেশি পরিলক্ষিত হয়। সেখানে নারী ডিজাইনারদের এগিয়ে থাকার তথ্য মেলে।
বিশেষজ্ঞরা যদিও ব্যবস্থাপনায় নারীদের তুলনায় কম উপস্থিতির কিছু বাস্তব কারণকেও উপেক্ষা করতে রাজি নন। পরিবার, মাতৃত্ব না ক্যারিয়ার—কোনটাকে এগিয়ে রাখবেন তারা? এই দোটানাও একটি বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে বৈকি। আর সেটি স্বীকারও করেছেন অনেকে। এই যখন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, তখন বাংলাদেশের অবস্থা একনজর দেখে নিলে মন্দ হয় না।
দৃশ্যপট বাংলাদেশ
স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫০ বছরে বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি এগিয়েছে বেশ। যদিও তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার মতো উল্লেখযোগ্য নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, ডিজাইনার ব্র্যান্ডের ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে নারীদের উপস্থিতি এখানে বেশি। সেই নাসরিন করিম, রোকাসানা সালাম, রিনা লতিফ থেকে আনিলা হক, সারা করিম, হুমায়রা খান, মাহিন খান, লিপি খন্দকার থেকে হালের ফায়জা আহমেদ, রোকাইয়া আহমেদ পূর্ণা, তানহা শেখ বা আফসানা ফেরদৌসী—বলতে গেলে নারীর জয়জয়কার। আবার ফ্যাশন হাউসগুলোতেও নারী ডিজাইনারদের সংখ্যা হেলাফেলা করার মতো নয়।
যদিও ব্র্যান্ড পরিচালনায় নারীদের অবস্থান যে উল্লেখযোগ্য নয়, তা মানতেই হবে। কে ক্র্যাফটের প্রধান নির্বাহী শাহনাজ খান বা লা রিভের প্রধান নির্বাহী মন্নুজান নার্গিস ছাড়া আর প্রধান নির্বাহী তেমন চোখে পড়ে না। অন্যদিকে ফ্যাশন ব্যবসায় টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের মনিরা এমদাদ, কনিষ্কের নিনা আমিন, ক্যাটস আইয়ের আশরাফুন সিদ্দিকী, নিপুণের হাসমত আরা ফ্লোরা, দেশালের ইশরাত জাহান, ক্লাবহাউসের মায়মুনা হোসেনদের ভূমিকাকে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। তারা ব্যবসা পরিচালনার পাশাপাশি ডিজাইনের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখেন। এ ক্ষেত্রে আরেকজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। তিনি তামারা আবেদ। ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনিই পরিচালনা করেন বাংলাদেশের শীর্ষ লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড আড়ং।
আগেই উল্লেখ করেছি, ফ্যাশন বিষয়ে পড়াশোনার ক্ষেত্রেও এগিয়ে আছেন মেয়েরা। ডিজাইনার হিসেবে বিভিন্ন ব্র্যান্ডে কাজও করছেন তারা। এই সংখ্যাও বেশ ভালো। অন্তত আন্তর্জাতিক ফ্যাশনের তুলনায়। পাশাপাশি বাংলাদেশে ফ্যাশনের বাজার যথেষ্ট বড়। এখানে প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষভাবে সম্পৃক্তদের সংখ্যাও কম নয়। নানা ভূমিকায় অন্তত ৭০ শতাংশ নারী কাজ করেন। অথচ বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিও পুরুষশাসিত। এখানেও ব্যবস্থাপনা থেকে নীতিনির্ধারণী—সব ভূমিকায় পুরুষের সংখ্যাই বেশি। বড়সড় জরিপের প্রয়োজন নেই, কেবল দেশী দশের দিকে তাকালেই সেটি স্পষ্ট হয়। কে ক্র্যাফট, বিবিআনা, দেশাল—এই তিন প্রতিষ্ঠানে নীতিনির্ধারণী অবস্থানে আছেন নারী। তা-ও এককভাবে নয়। আর সাদাকালোতে আছেন স্লিপিং মোডে!
যে তথ্য আশা জাগায়
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ফ্যাশনে একটি অভিন্ন চিত্র আশা জাগায়। এই ইতিবাচক ভূমিকায় অনুঘটক হয়েছে সামাজিক মাধ্যমের উত্থান ও জনপ্রিয়তা এবং করোনাকাল। আর সেটি হলো নারী ডিজাইনার ও উদ্যোক্তাদের আত্মপ্রকাশ। এই সংখ্যা উল্লেখযোগ্য বৈকি।
এরই মধ্যে আমেরিকা ও ইউরোপে এমন অনেক ব্র্যান্ড দৃঢ় অবস্থান গড়ে তুলতে পেরেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। খুঁত এর একটি। পাশাপাশি সরলা, পটের বিবি, সুরঞ্জনা, খাদি, ঋতি, কটন রুটস, গুটিপা, কারখানা, দ্য হকারস, দিশাস রোড ব্লকস, ভারমিলিয়ন ইত্যাদি। এর পাশাপাশি দুটো গয়না ব্র্যান্ড দারুণ জনপ্রিয় হয়েছে—সিক্স ইয়ার্ড স্টোরি ও গ্লুড টুগেদার। প্রতিনিয়ত যোগও হচ্ছে। এভাবেই নারীদের অবস্থান শক্তপোক্ত হচ্ছে।
সমে এসে আবারও সেই চর্বিত-চর্বণ। বড় ভেঞ্চার, বড় উদ্যোগে কিন্তু ছড়িটা থাকছে পুরুষের হাতে। আমাদের ম্যানেজমেন্টের নানা পর্যায়েও নারীদের অংশগ্রহণ কোনোভাবেই আশাবাদী করে না। অথচ এসব বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ দেশেই আছে। অনেকে করছেনও। কিন্তু তারপর দেশের ইন্ডাস্ট্রিতে না এসে তৈরি পোশাকশিল্প বা অন্য কোথাও চলে যাচ্ছেন। অস্বীকার করার উপায় নেই, এ দায় কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিরও আছে। নীতিনির্ধারণীতে এই ব্যবধান ঘোচাতে না পারলে লৈঙ্গিক সমতার বিষয়টি দুরাশা হয়েই থাকবে। পিছিয়ে থাকবেন নারীরা।
এটি কেবল বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়, এই পরিস্থিতি বিশ্বব্যাপী। ভারত কিংবা চীন, কোরিয়া কিংবা জাপান—সবখানেই ছবিটা অবিকল। পরিবর্তন কবে হবে, কীভাবে হবে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা যে ভাবছেন না, তা নয়। ব্যবধানও যে কমছে না, তেমনও নয়; কিন্তু পরিস্থিতি পরিবর্তনের লয়টা মন্দাক্রান্তা। আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করতে হবে আবিশ্বের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে নারী জাগরণের।
ছবি: সংগ্রহ