ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I সিজনলেস ফ্যাশন
নতুন ধারা। যুগোপযোগী। বাঘা বাঘা ব্র্যান্ডকেও যেন সুযোগ করে দিচ্ছে গতানুশোচনার। ভবিষ্যতের ভাবনা কেমন
বিশ্ব ফ্যাশন বাজারে একটি বছরকে প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়—স্প্রিং/সামার এবং অটাম/উইন্টার; যা মূলত প্রাইমারি সিজন হিসেবে পরিচিত। এই দুই সিজন ঘিরে নতুন সংগ্রহ বাজারে আনে বেশির ভাগ ব্র্যান্ড।
ফ্যাশন সিজনে ঋতু গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার কারণ পৃথিবীর উত্তর-পূর্ব দেশগুলোর তাপমাত্রার তারতম্য। আবার এই অঞ্চলের ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রচণ্ড দাবদাহ থেকে শূন্য তাপমাত্রায় বসবাস—দুই-ই হয় এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের জীবনে। ঋতু পরিবর্তনে তাদের পোশাক পরিকল্পনা শর্টস থেকে লেয়ারিংয়ে পৌঁছে যায়। এমন পরিস্থিতি নিয়ে ভাবলে ‘মোস্ট বেসিক’ লেভেলে ‘সিজনালিটি’ গুরুত্বপূর্ণ।
সিজনালিটি
ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডের ব্যাকরণে সিজনালিটি বলতে শুধু আবহাওয়া উপযোগী পোশাকের সংগ্রহকেই নয়, নতুন সংগ্রহকেও বোঝায়। বর্তমানে বেশির ভাগ ব্র্যান্ড বছরে অন্তত দুটি সংগ্রহ বাজারে আনে। কোনো কোনো ব্র্যান্ড আনে চারটি অব্দি। মূল দুটি কালেকশন হয় স্প্রিং/সামার এবং অটাম/উইন্টার।
স্প্রিং/সামার: মূলত উষ্ণ আবহাওয়ার উপযোগী পোশাক তৈরি হয়। ব্রিদেবল ফ্যাব্রিকের ব্যবহারে গুরুত্ব বাড়ে। বাতাসের আর্দ্রতার উপযোগী কি না, সেদিকে লক্ষ থাকে। হালকা ওজনের সুতি কাপড়, টিপিক্যাল লিনেনের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। পোশাকে প্রাধান্য পায় টপ-স্কার্ট, শর্ট, সুইম ওয়্যার। প্রিন্টের ব্যবহারে মনোযোগী থাকেন ডিজাইনার। রঙের দারুণ ব্যবহার উষ্ণতা ছড়ায়।
অটাম/উইন্টার: শীতকে গুরুত্ব দিয়ে তৈরি। লেয়ারিং গুরুত্ব পায়। ভারী বুননের ফ্যাব্রিক ব্যবহার করা হয়। যেমন লাক্সারিয়াস ক্যাশমেয়ার, উল। প্রোডাক্ট লাইনে জাম্পার, কার্ডিগান, ব্লেজার, কোট, জ্যাকেট, স্কার্ফ ও বুট থাকে। কালার প্যালেটের গাঢ় রংগুলো ব্যবহার করা হয়। দামও তুলনামূলক বেশি।
এই দুয়ের পাশাপাশি ‘ইন্টারমিডিয়েট কালেকশন’ নিয়েও কাজ করে ব্র্যান্ডগুলো। কিন্তু এখানে স্বতন্ত্রতা রয়েছে। কোনো ব্র্যান্ড প্রি-উইন্টার, প্রি-ফল কালেকশন নিয়ে আসতে পারে; আবার কোনোটি হাজির হতে পারে ‘হাই সামার’ কালেকশন নিয়ে। তবে লাক্সারি ব্র্যান্ড শ্যানেল, ডিওর, জিল স্যান্ডার তাদের মধ্যবর্তী সংগ্রহকে নামকরণ করে রিসোর্ট, ক্রুজ অথবা প্রি-ফল নামে।
প্রয়োজন নাকি বাজারজাতকরণ
প্রাথমিকভাবে বিক্রিবাট্টা বাড়ানোর একটি উপায় বলা যেতে পারে সিজনালিটিকে। এর সঙ্গে আছে আরও একটি বিষয়। ব্র্যান্ডমাত্রই ক্রেতা আকর্ষণের নানান স্ট্র্যাটেজি তৈরি করবে। তেমনই একটি কৌশলের নাম সিজনালিটি। উদাহরণে বল সিজনের কথা বলা যেতে পারে। বল গাউনের কালেকশন শীতে বাজারে আসে। এর কারণ এই সময়ে বল অ্যান্ড ডিনার পার্টির আয়োজন করা হয়।
ফ্যাশন মার্কেটে র্যাট রেসের কনসেপ্ট নতুন কিছু নয়। বছরজুড়ে দশের বেশি ফ্যাশন উইক আয়োজিত হয়ে আসছে দীর্ঘ সময় ধরে। অংশ নিচ্ছেন নামীদামি ডিজাইনাররা। নতুন নতুন পণ্য কেনার জন্য ক্রেতাদের আগ্রহী করার ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করেছেন তারা। ক্রেতারাও কিনেছেন। পরিসংখ্যানে বাজারের আকার বেড়েছে অভাবনীয়ভাবে। বিলিয়ন ডলারের বেচাকেনা হয়েছে বেশির ভাগ দেশে। এই তাড়না বিশ্বের সব দেশের নাগরিককেই ছুঁয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়া একাই প্রতি মিনিটে ৬ হাজার কেজি ফ্যাশন বর্জ্য তৈরি করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ময়লার ঝুড়ি কেন পোশাকের শেষ ঠিকানা হচ্ছে? পোশাকগুলো কি ছিঁড়ে-ফেটে গেছে? নাকি তথাকথিত মাইক্রো ট্রেন্ডের সেলিব্রিটি ইমেজ থেকে ছিটকে পড়েছে?
আবার এই পোশাক সংগ্রহের পর্দা তুলতে আয়োজন করা হয় ফ্যাশন শো। র্যাম্পে, সুরের তালে প্রদর্শিত হয় নতুন পোশাক। বিশ্বজুড়ে এই প্র্যাকটিস চলেছে, চলছে। ফ্যাশন শোতে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, দর্শকের প্রস্তুতি, পরিবহনসহ নানাভাবে কার্বন নিঃসৃত হয়। এর পরিমাণ ২ লাখ ৪১ হাজার টন। সংখ্যাটি ৫১ হাজার গাড়ির কারণে বাতাসে মিশে যাওয়া কার্বন ডাই-অক্সাইডের সমান। সবকিছু মিলিয়ে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ক্ষতিকর ভূমিকা রেখেছে ফ্যাশন। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ফাস্ট ফ্যাশন। তৈরি ও বিক্রি হয়েছে প্রচুর। প্রতিনিয়ত চাহিদা বেড়েছে। ব্যবহারের সময়কাল কমেছে। ক্রেতাচাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উৎপাদনক্ষমতা বাড়িয়েছে প্রডিউসাররা। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিকের কাছে প্রতিটি মুহূর্ত হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, চাহিদার বিপুলতা। তাদের বার্ষিক আয় তো বটেই, এক মিনিটের আয়ের পরিমাণও বিশাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে শ্রমিকের সুরক্ষা গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। ওভারটাইম, বিশ্রামহীন কর্মঘণ্টা, অমানুষিক পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর কর্মস্থল, নারী ও শিশুশ্রমের আধিক্য—সবকিছু নিয়েই বারবার সোচ্চার হয়েছেন সচেতনেরা। আশানুরূপ ফল মেলেনি আজও। সিজনের শিকলে বন্দি ফ্যাশনে ক্ষতি আর হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে। পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মানবিকতা বোধের অবমূল্যায়ন হয়েছে। শর্ট লাইফ স্প্যানের ট্রেন্ডও এখানে নেতিবাচক প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। কারণ, নতুন নতুন ফ্যাশন ধারায় আগ্রহী যারা, তারা নিত্যনতুন সংগ্রহকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ফাস্ট ফ্যাশন ফেবারিটে পরিণত হয়েছে।
এরপরে, পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয়ের খবর আসতে শুরু করলে জানা যায়, এর পেছনে দায় রয়েছে ফ্যাশনেরও। ফ্যাশন বর্জ্য প্রকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। জলবায়ুতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। রোজ বাড়ছে তাপমাত্রা। সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বরফ গলছে। মাইনাস টেম্পারেচারে অভ্যস্ত প্রাণীরা মারা যাচ্ছে। সব শেষে বিপর্যস্ত হচ্ছে জনজীবন! এর কোনোটারই দায় এড়াতে পারেনি ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি।
স্বাগত সিজনলেস
২০২০ সালের করোনাকালে ফ্যাশন বাজারে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। বিগ ব্র্যান্ড মাইকেল কোরস এবং সাঁ লহো সিদ্ধান্ত নেয়, তারা ফ্যাশন ক্যালেন্ডারের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলবে না। অংশ নেবে না সিজনাল ট্রেন্ড তৈরিতে। গুচি এবং প্রাডাও বাতিল করে ফ্যাশন শো। এই মহামারির সময়ে লাক্সারি ব্র্যান্ড গুচির পক্ষ থেকে একটি চিঠি লেখেন লেবেলটির তৎকালীন ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর আলেসান্দ্র মাইকেল। সেখানে তিনি সিজনালিটির প্রথাকে জীর্ণ বলে উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করেন, তার ব্র্যান্ড দুই বছরে শুধু একবার ফ্যাশন শো করবে। সাঁ লহো, জর্জিও আরমানির পক্ষ থেকেও পরিবেশের প্রতি সচেতন আচরণের আভাস পাওয়া যায়। কোনো নির্দিষ্ট ঋতু, জেন্ডার, ক্যাটাগরিতে আলাদা না করে, সবকিছু নিয়ে একবারে ফ্যাশন বাজার এগিয়ে গেলে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছে ফ্যাশন ডিজাইনারদের সংগঠন রিউইনিং ফ্যাশন। তারা প্রস্তাব করেছে ফ্যাশন ক্যালেন্ডার নতুনভাবে সাজানোর বিষয়ে, যা বর্তমান সময়ের বাজারের চাহিদাকে গুরুত্ব দেবে।
ফ্যাশন শো আয়োজিত হওয়ার পরে দ্রুততম সময়ের মধ্যে শোরুমে পোশাক পৌঁছাতে হবে। এই দুয়ের মধ্যকার সময় দীর্ঘ করা যাবে না। কারণ, এই সময়ের মধ্যে নকশা নকল হয় এবং বাজারে নিম্নমানের একই নকশার পোশাক আসে।
ফ্যাশন শো জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ও জুন মাসে আয়োজন করার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। কারণ, এতে ক্রেতাদের যখন যে ঋতুর পোশাক প্রয়োজন, সেগুলো বাজারে এলে তখনই কিনে নিতে পারবেন। অনেক আগে নতুন সংগ্রহ চলে এলে সেগুলো কিনে সংরক্ষণ করতে অনেক ক্রেতা আগ্রহী হন না।
ফ্যাশন উইক মেইল-ফিমেল জেন্ডারে বিভক্ত না করে একই সঙ্গে আয়োজন করা হলে সব ধরনের খরচে লাগাম টানার সম্ভাবনা রয়েছে। ট্র্যাডিশনাল ফ্যাশন শোতে আয়োজক, প্রেস এবং ফ্যাশনে আগ্রহী—তিন দলেরই প্রচুর টাকা ও সময় ব্যয় হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিই সবচেয়ে বেশি উপকৃত হতে পারে।
এখন বিশ্বে যে ফ্যাশন শোর আয়োজন করা হয়, তা অন্তত ৫০ বছরের পুরোনো ডিজাইন। সিজনলেস ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে শো কেসিং যেমন ফ্যাশন উইকে অংশ নেওয়া, ফ্যাশন শোর আয়োজন, ফটোশুট, উইন্ডো মার্চেন্ডাইজিংয়ের মতো ক্ষেত্রে খরচ যথাযথ করার সুযোগ রয়েছে। অর্থাৎ ব্যয় কমানো যেতে পারে। রিটার্ন অব ইনভেস্টমেন্ট তখন ব্র্যান্ডকে বাজারে নতুন করে বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে পারে।
সিজনলেস ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হলে পোশাকের নকশার মান বাড়ার সুযোগ তৈরি হয়। কারণ, তখন প্রতি তিন মাস পর আনকোরা প্যাটার্ন, প্রিন্ট, অর্নামেন্টেশন তৈরির চাপ ডিজাইন ডিপার্টমেন্টের ওপরে থাকবে না। ফ্যাশন একটি শিল্প এবং এ নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা শিল্পী। তাই তাদের সময় নিয়ে সৃজনশীল ভাবনা এবং কাজের প্রয়োজন থাকতে পারে। কারখানায় কর্মরত পোশাককর্মীরা যথাযথ সময় পাবেন পোশাক তৈরির জন্য। অতিরিক্ত পরিশ্রমে বাধ্য হবেন না। একই সঙ্গে ট্র্যাডিশনাল ক্র্যাফটম্যানশিপের জন্য ইতিবাচক হবে।
ক্রেতার ইমপালস শপিং অর্থাৎ আবেগের বশে কেনাকাটায় লাগাম টানার উপায় হতে পারে সিজনলেস ফ্যাশন। কারণ, নিত্যনতুন কালেকশনে তখন তাদের চোখ আটকাবে না। অযথা আকর্ষিত হয়ে অতিরিক্ত কেনা থেকে বিরত থাকবেন। ফলে ফ্যাশন বর্জ্যরে পরিমাণ কমবে। এ ছাড়া ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে প্রচুর পানির ব্যবহার হয়। উৎপাদন নিয়ন্ত্রিত হলে পানির ব্যবহারও কমে আসতে শুরু করবে। পানিশূন্যতা, খরা, কার্বন নিঃসরণ, বন উজাড়ের মতো ঘটনা কিছুটা হলেও কম ঘটবে। ফ্যাশন ক্ষতিকর হবে না। টেকসই তত্ত্বের উপযুক্ত প্রয়োগে পোশাকবাজার সুন্দর ও সচ্ছল হবে।
সারাহ্ দীনা
ছবি: ইন্টারনেট