মনোজাল I কেন্দ্রবিন্দু কোন্দল
পুরোটাই মানসিক প্রপঞ্চ। অন্যের মতামতকে অতিরিক্ত মূল্যায়নের ক্ষতিপূরণ বলা যায়। অবহেলায় পরিণত হতে পারে কঠিন মানসিক অসুখে
স্পটলাইট—চেনা শব্দ। হাজার ওয়াটের আলো দেয়। রেড কার্পেটের আয়োজনে, ছবির প্রিমিয়ার শোতে নায়ক-নায়িকাকে কেন্দ্র করে দেখা যায় স্পটলাইটের কারসাজি। তবে অনেকের হয়তো জানা নেই, রুপালি জগতের স্পটলাইট বাস্তব জীবনেও মিলেমিশে গেছে। কীভাবে? মনোজগৎকে প্রভাবিত করে। যখন কোনো ব্যক্তি কোনো পরিস্থিতিতে মনে করেন, সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে তিনি। এবং এ কারণে অস্বস্তি অনুভব করা শুরু করেন। এবং এতে জীবনযাত্রার স্বাভাবিকতা খানিকটা ব্যাহত হয়, তখন এ ধরনের মানসিক অবস্থাকে ‘স্পটলাইট ইফেক্ট’ বলা হয়।
বৃত্তের ভেতর শুধু আমি!
মেহমানদারি, দাওয়াত, অফিসের প্রোগ্রাম, মিটিংসহ নানা সময়ে স্পটলাইট ইফেক্ট হঠাৎ আবির্ভূত হতে পারে। আগাম সংবাদ ছাড়াই আসতে পারে এই অনুভূতি। মনের গহিনের সর্ষে দানার মতো ছোট্ট যে মন, সেখানে তৈরি হতে পারে অস্বস্তি! নিজের কমফোর্ট জোনের বাইরে স্পটলাইট ইফেক্টে আক্রান্ত হওয়ার উদাহরণ বেশি। যেমন কোনো ব্যক্তির মনে হতে পারে, চারদিক থেকে সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে! যেন শত জোড়া চোখের দৃষ্টি একসঙ্গে। দেখছে, ভাবছে, আর বিচার করছে! ঠিক তখনই প্রবল শক্তিশালী প্রশ্নের আক্রমণে এলোমেলো হয়ে যায় সবকিছু! ‘কেমন দেখাচ্ছে আমাকে? সব ঠিক আছে তো?’ পোশাকের নকশা কি আপ টু ডেট? নাকি আউটডেটেড? এমন অস্বস্তির আচ্ছাদন আনন্দ মাটি করে দিতে সক্ষম!
মন জগতে-জগতের মনে!
লোকসমাগমে নিজেকে নিয়ে নিজের অস্বস্তি অনেকের হয়। এই আকস্মিক স্বস্তিহীন বেদনের জন্য মূলত মন জগৎ দায়ী বলে জানা যায়। এর পুঁথিগত নাম ‘স্পটলাইট ইফেক্ট’। এতে আক্রান্ত মানুষেরা মনে করেন, সব সময় তাদের ওপরে একটি স্পটলাইট আলো ফেলছে। সবাই জেনে যাচ্ছে ভুল-ত্রুটি। প্রকাশিত হচ্ছে তার ‘ইমপারফেকশন’।
স্পটলাইট ইফেক্ট সম্পর্কে প্রথম জানা যায় ২০০০ সালে, একটি গবেষণাপত্রের মাধ্যমে। তিনজন গবেষক বিষয়টি নিয়ে পেপার তৈরি এবং তা পাবলিশ করেন। জানা যায়, উৎস লুকিয়ে আছে মানব মনে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় ‘ইগোসেন্ট্রিক বায়াস’।
যাদের সোশ্যাল অ্যাংজাইটি আছে, তাদের জন্য ‘স্পটলাইট ইফেক্ট’ আরও মেজর ইস্যু হয়ে ধরা দেয়। অনেক সময় তা কর্মস্পৃহা, দক্ষতা, মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায়। ভুক্তভোগী নিজেকে নিয়ে লজ্জিত বোধ করতে শুরু করেন। খুব সহজ বিষয়কেও কঠিন করে দেখতে শুরু করেন। কখনো যদি মনমতো তৈরি হতে না পারেন, তাহলে তিনি সারা দিনই অস্বস্তিতে ভুগতে পারেন। অন্যরা কী ভাবছে, তাকে নিয়ে, সে বিষয়ে হতে পারে দুশ্চিন্তা। এ ধরনের আশঙ্কা পেশাদারত্বে যেমন বাধা তৈরি করার প্রবল সম্ভাবনা তৈরি করে, তেমনি ব্যক্তিগত হতাশাও সৃষ্টি হতে পারে। আবার, অফিসের পরিবেশে ফরমাল ড্রেসআপের নিয়ম থাকলেও অনেকে ভোগেন অস্বস্তিতে। কারণ, রোজকার পোশাকে তিনি এমন কিছু পরেন না।
কোন্দলের কারণ
চিকিৎসাবিজ্ঞানের তথ্যমতে, স্পটলাইট ইফেক্ট তৈরি হওয়ার পেছনে মূলত দুটি বিষয় দায়ী। একটি হচ্ছে স্মৃতি, অন্যটি অপরের মনোযোগের চাহিদা।
কোনো ব্যক্তি যদি একবার এমন কোনো পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যান, যা তার জন্য লজ্জাজনক, তাহলে একই রকমের ইভেন্টে তিনি বারবার সেই স্মৃতি মনে করে উদ্বেগ অনুভব করতে পারেন।
আবার, যখন কোনো ব্যক্তি অন্য সবার কাছে নিজের মূল্যায়ন আশা করেন, তখন এ ধরনের চাপ বেশি হতে পারে। দাওয়াত, পার্টি, গেট টুগেদার, অফিস ইন্টারভিউসহ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস, শ্বশুরবাড়ি—এসব জায়গার প্রথম দিককার অভিজ্ঞতা এ রকম হতে পারে। হতে পারে বিয়ের পাত্র-পাত্রীর ক্ষেত্রেও। এমন পরিস্থিতিতে বারবার ওড়না, আঁচল টেনে ঠিক করার চেষ্টা, টাইয়ের নটে হাত চলে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। কারণ, এই স্থানগুলোতে ব্যক্তিবিশেষের নিজেকে অন্যের সামনে তুলে ধরতে হয়। আবার, অনেক সময় অন্যের মতামতের জন্য অপেক্ষা করতে হতে পারে; যা ব্যক্তিকে অস্বস্তি দেয় এবং পরে ভীতির উদ্রেক করতে পারে।
জরিপে জানা
২০০৭ সালে এ বিষয়ে একটি কোয়ান্টিটিভ রিসার্চ সম্পন্ন করা হয়। যেখানে ক্লাসরুমে প্রবেশের ঠিক আগমুহূর্তে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আলাদাভাবে ডেকে একটি করে টি-শার্ট দেওয়া হয়। টি-শার্টগুলোর নকশার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল হাস্যরসাত্মক ক্যারেক্টার অথবা মোটিফ। ছাত্ররা সেগুলো পরে ক্লাসরুমে যেতে অস্বস্তি বোধ করছিলেন। সংকোচ নিয়েই তারা ক্লাস করেন। লেকচার শেষে তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়, আনুমানিক কতজন তাদের পোশাক নিয়ে হেসেছেন, কটাক্ষ করেছেন বলে তারা মনে করেন। তারা জানান, অন্তত ৫০ শতাংশ ছাত্র এ বিষয়ে মনে মনে অথবা সহপাঠীদের সঙ্গে ঠাট্টা করেছেন। অথচ প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যা ছিল ২৫ শতাংশ। অন্যরা বিষয়টি নিয়ে সেভাবে চিন্তাই করেননি।
মন ব্যাকুল
স্পটলাইট ইফেক্ট সব সময় অস্বস্তিকর অবস্থার জন্ম দেয়, তা বলা যাচ্ছে না। কারণ, অনেক সময় একটি ভালো প্রেজেন্টেশন অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সামনে উপস্থাপন করার পরেও স্পটলাইট ইফেক্টের অনুভূতি হতে পারে। মনে হতে পারে, বাহবা দিচ্ছে সবাই। আবার কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল সবার সামনে এসে গেলেও হতে পারে এই অনুভূতি।
প্রশংসা যেমন আনন্দিত করে, তেমনি সমালোচনা দেয় অস্বস্তি। যে পোশাকটি পরার কারণে ব্যক্তি প্রশংসা পেয়ে থাকেন, সেটি সাধারণ হলেও অসাধারণ হয়ে ওঠে। আবার সমালোচনায় এর বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। প্রিয় থেকে অপ্রিয় হতে একটি মন্তব্যই যথেষ্ট হতে পারে।
উপস্থিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে ‘ক্লোজ অ্যাটেনশন’ পাওয়ার আশঙ্কায় সোশ্যাল অ্যাংজাইটি তৈরি হয়, যা সামাজিক সম্পর্ক রক্ষা, জনসমাগমে উপস্থিতি, পরিবারের বাইরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের ওপর প্রভাব তৈরি করে। ফলস্বরূপ ব্যক্তিজীবন বিপর্যস্ত হয়। অনেকে নিজেকে সোশ্যাল গ্যাদারিং থেকে সরিয়ে রাখা শুরু করেন। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। পরিচয়, কুশল-বিনিময় এড়িয়ে যেতে শুরু করেন।
অমীমাংসিতে মীমাংসা
সমাধানে প্রথমেই একটি সত্য মনে রাখা যেতে পারে। সেটা হচ্ছে, অন্যকে নিয়ে আসলে তেমন গুরুত্ব দিয়ে কেউ ভাবে না। নিজেকে নিয়ে ভাবনা নিজের কাছেই থাকে। উৎসব আয়োজনে অন্যের চাহিদার থেকে নিজেকে নিজের কাছে সুন্দর লাগছে কি নয়া তা ভেবে পোশাক নির্বাচন করলে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। তবু যদি স্পটলাইট ইফেক্ট অনুভব করার মতো কোনো ঘটনা ঘটে, তাহলে তার বিপরীতে একমুহূর্ত নিজেকে বসানো যেতে পারে। এমন ঘটনা সামনে হলে আপনি কি শতভাগ গুরুত্ব দিয়ে অন্যকে দেখতেন? প্রশ্নের উত্তরে স্বস্তি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, জানা গেছে, শতভাগ মনোযোগ কখনোই দেন না দর্শক। এরপরেও স্পটলাইট ইফেক্টের কারণে যদি সমস্যা গুরুতর হয়, জীবনযাপন বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি নেওয়া যেতে পারে। বিশেষজ্ঞ মতামত স্পটলাইট ইফেক্ট থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করতে পারবে বলে আশা করা যায়। একই সঙ্গে নিজেকে নিজে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়েও সচেতন হতে হবে।
সারাহ্ দীনা
ছবি: ইন্টারনেট