ফিচার I খানসামা উপাখ্যান
খানসামা বলতে বর্তমানে একজন পুরুষ রাঁধুনিকেই বোঝায়। তবে এ পেশার ব্যাখ্যা এত সরল নয়। শুধু রসুইঘরের চার দেয়ালের ভেতর তেল-মসলা ও ঝোলে হাত পুড়িয়ে রান্না করাই খানসামার পরিচয় নয়। তার দায়িত্বের বিস্তার আরও বড়। যদিও এই পেশার লোকেদের পদমর্যাদা ক্ষয়িষ্ণু হতে হতে বর্তমানে তলানিতে। কিন্তু ইতিহাসে তাদের মর্যাদা ছিল উঁচুতে। মোগল আমল থেকে শুরু হয়ে নবাবি আমল, এরপর ব্রিটিশদের হাতে পরে এই পেশার লোকেরা বর্তমানে শুধু বাবুর্চি হিসেবেই পরিচিতি পাচ্ছেন
মোগল আমলে একজন খানসামা পাকশালের পাশাপাশি ঘরদোর সামালের দায়িত্বেও নিয়োজিত থাকতেন। মানে বাবুর্চির কাজ শুধু রান্না করা হলেও খানসামার দায়িত্ব ছিল আরও বিস্তৃত। বাবুর্চি শুধু রেসিপি অনুযায়ী রান্না করতেন। কিন্তু রান্নার জোগাড়যন্ত্র পরিকল্পনা ও পরিবেশন—সবই করতেন খানসামা। বাবুর্চিকে থাকতে হতো খানসামার অধীনে।
খানসামা উর্দু শব্দ। মূলত খান-ই-সামান থেকে আসা। ভাঙলে দুটি অংশ মেলে—খান ও সামান। এখানে খান অর্থ তত্ত্বাবধায়ক; আর সামান বলতে গৃহস্থালি জিনিসপত্রকে বোঝায়। মোগল আমলে খান-ই-সামান ছিলেন প্রয়োজনীয় নানা পণ্যের রক্ষক। সেখান থেকেই বিবর্তিত হয়ে খানসামা শব্দের আবির্ভাব। মোগল আমলেই ধীরে ধীরে গৃহস্থালির কাজের পাশাপাশি রসুইঘরেও যুক্ত হয়ে পড়েন খানসামারা।
কেউ কেউ খানসামাকে প্রধান রাঁধুনি বলে থাকেন। কিন্তু বিষয়টি পুরোদস্তুর তা নয়। মোগল শাসনামলে বাদশাহদের প্রাসাদের নিয়ম অনুসারে শাহি খানসামা আসলে শাহি বাবুর্চির সঙ্গে মিলে কয়েক দিনের রান্নার আয়োজন সম্পর্কে পরিকল্পনা করতেন মাত্র। এই পরিকল্পনায় খানসামার অংশগ্রহণ ছিল অবশ্যকর্তব্য। কারণ, সেকালে রসুইসহ প্রাসাদের অন্যান্য সব ‘সামান’ থাকত তারই অধীনে। খানসামার কাছ থেকেই ‘রসদ’ সংগ্রহ করতেন শাহি বাবুর্চি। রসদের পরিমাণ ও প্রয়োজন নির্ধারণ করতে তাদের যৌথ প্রয়াস জরুরি ছিল। কেননা মোগল হারেমে বাদশাহসহ অন্যদের জন্য প্রতিদিন প্রচুর খাবার রান্নার প্রয়োজন পড়ত। এ ছিল এক মহা কর্মযজ্ঞ।
খানসামাও অবশ্য বাবুর্চির মতো রান্নার বিষয়ে জ্ঞান রাখতেন। তাই ক্ষেত্রবিশেষে প্রধান বাবুর্চিও খানসামা হতে পারতেন। আবার খানসামাও হতে পারতেন প্রধান বাবুর্চি। তবে এ কথা স্পষ্ট যে খানসামা ও বাবুর্চি অভিন্ন পেশা ছিল না। মোগল আমলে বাদশাহের খাবার পরিবেশনের সময় খানসামার দায়িত্ব ছিল পরিবেশনার সৌন্দর্য রক্ষা এবং খাবারের টেবিলের সব বিষয় সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা।
খানসামাদের সবাই ছিলেন মুসলিম। তারা শেখ কিংবা পাঠান গোত্রের ছিলেন। পরে অনেক পার্সি ব্যক্তিও খানসামা হয়েছেন। হাওয়ার্ড স্টকলারের মতে, খানসামারা ছিলেন বেশ বুদ্ধিমান। তাদের ব্যবহার হতো সুন্দর এবং অন্যদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। লিনেনের সাদা পোশাক পরতেন। মাথায় পাগড়ি বাঁধতেন। অন্যদিকে, বাকল্যান্ড তার ‘মেন-সার্ভেন্টস ইন ইন্ডিয়া’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘খানসামারা একটি বড় পাগড়ি বাঁধেন। তাদের কোমরে থাকে মসলিনের একটি কাপড়।’ ইউরোপীয় পর্যটক ফ্রান্সিস বার্নিয়ের বলেছেন, খানসামারা ছিলেন গৃহস্থালি কাজ ও শৃঙ্খলা দেখভালের দায়িত্বে।
মোগল আমলের পর নবাবি আমলেও খানসামারা নবাবদের প্রাসাদের অপরিহার্য অংশ হয়ে ওঠেন। এই আমলে অনেক খানসামা নিজ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে পদোন্নতি লাভ করে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
লন্ডনের কিংস কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক জাহানারা কবিরের মতে, খানসামারা সামন্ততান্ত্রিক ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন। বিশেষ করে যেসব ধনী ও অভিজাত গৃহে গার্হস্থ্য একটি বিস্তৃত বিষয় ছিল, তাদের জন্য খানসামা ছিলেন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। এই অধ্যাপক আরও জানান, খানসামা-সংস্কৃতি একসময় ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে।
মূলত খানসামা একটি পদ। আর এই কাজের উৎপত্তি মোগল আমলেই। তবে এ পেশার সঠিক পরিচয় বা বর্তমান পরিচিতি তৈরি হয়েছে ব্রিটিশ আমলে। অবশ্য সেই ব্রিটিশদের দেওয়া বিবরণ থেকেই খানসামার পরিচয় পাল্টে যেতে শুরু করে। এমনকি বাবুর্চিরাই খানসামা হিসেবে পরিচিত হতে থাকেন।
একসময় খানসামা হওয়া ছিল রীতিমতো একটি লোভনীয় পেশা। ইংরেজ আমলে এই পেশায় মুসলমানদের একচেটিয়া অংশগ্রহণ ছিল। মূলত খানসামারাই ছিলেন ইংরেজ শাসকদের ঘরের গিন্নি। রসুইঘর ছাড়াও ভাঁড়ারের চাবিকাঠি তাদের হাতেই থাকত। অন্য গৃহকর্মীরা খানসামার হুকুমের অধীনে থাকতেন। খানসামার মন জুগিয়ে চলতে হতো।
মুসলমান ছাড়াও অবশ্য মগ, পর্তুগিজরা খানসামার কাজ করতেন। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, খানসামাবৃত্তিতে সনাতনধর্মীদের নাম নেই। এর একটি কারণ হতে পারে, সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বাবুর্চি হতেন না। স্টকলার জানান, মগ বাবুর্চিরা কোনো ধরনের কাজে আপত্তি করতেন না। কিন্তু সনাতনধর্মীরা গরু কাটতে চাইতেন না; এমনকি মুরগিও। অন্যদিকে মুসলিমদের সমস্যা ছিল শূকরে। এখানে প্রশ্ন ওঠে, খানসামাদের মধ্যে মুসলমানদের প্রাধান্য হলো কীভাবে? এ বিষয়ে বিনয় ঘোষ তার ‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’ বইয়ে লিখেছেন, ‘খানসামাবৃত্তি তিন উপায়ে করার সৌভাগ্য হয়। কেউ খানসামা হয়ে জন্মায়, কেউ খানসামাগিরির যোগ্যতা অর্জন করে, আবার কারও কাঁধে সেটা চাপিয়ে দেওয়া হয়।’ এখানে ‘খানসামা হয়ে জন্মায়’ কথাটির মানে হলো, এটি পারিবারিক পেশা। মোগল ও নবাবি আমলে যেহেতু মুসলিমরাই খানসামা ছিলেন, তাই পরে তাদের পরিবারের সদস্যরা এ কাজে যুক্ত হতে শুরু করেন। এ কারণে ইতিহাসে খানসামাদের মধ্যে মুসলিমদের নামই বেশি মেলে।
তবে মুসলিম খানসামারা যতই দক্ষ হোক, ব্রিটিশরা প্রথম দিকে স্থানীয় খাবারের প্রতি বিশেষ আগ্রহী ছিল না। ভারতীয় খাবারকে তারা অস্বাস্থ্যকর মনে করতেন। বেশি মসলাদার হওয়ায় স্থানীয় খাবারকে দূরে রাখতেন। মেম সাহেবরা তখন খানসামাদের ইউরোপীয় খাবার তৈরি শিখিয়ে-পড়িয়ে নিতেন। এভাবেই এই অঞ্চলে বিকাশ ঘটে স্যুপ, রোস্ট, পাই ও পুডিংয়ের মতো খাবারগুলোর। খানসামারা ব্রিটিশ পদগুলো ভারতীয় পদ্ধতিতে বানাতে শুরু করেন। তারা স্যুপের মধ্যে জিরা ও মরিচ, রোস্টে লবঙ্গ, গোলমরিচ ও দারুচিনি মেশানোর প্রচলন ঘটান। এভাবে তৈরি ভারতীয় ফ্লেভারের খাবারগুলো নিয়ে ব্রিটিশদের মধ্যে আগ্রহ জন্মেছিল।
একসময় ভারতে যে ব্রিটিশ তরুণেরা বিয়ে করেননি কিংবা স্ত্রী ছাড়া বসবাস করতেন, তাদের খাবারদাবারের ব্যবস্থা খানসামারাই করতেন। খানাসামারা যে খুব শিক্ষিত ছিলেন, তা নয়। বংশপরম্পরায় কাজ শিখতেন। আর কাজ করতেন নিজ বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ করে।
খানসামাদের বেতনও ছিল বাবুর্চিদের চেয়ে বেশি। ১৮৪১ সালের ‘বেঙ্গল অ্যান্ড আগ্রা অ্যানুয়াল গাইড অ্যান্ড গেজেটিয়ার’-এ উল্লেখ করা হয়, বাবুর্চির বেতন ছিল ৬-৯ টাকা; আর খানসামার ১০-১৬ টাকা। বেতনের বাইরেও খানসামাদের ছিল বাড়তি আয়। এ পেশায় নিযুক্ত কিছু ব্যক্তি অসদুপায় অবলম্বন করে পয়সা বাগিয়ে নিতেন। ইংরেজ লেখক ফ্রান্সিস প্যাট্রিক নেপিয়ারের লেখায় উঠে এসেছে, ‘সবচেয়ে ধুরন্ধর, মিথ্যাচারী কিন্তু অপরিহার্য ব্যক্তিটি হচ্ছেন খানসামা’! এ ছাড়া বাকল্যান্ড অভিযোগ করেছেন, খানসামারা ইংরেজ পরিবারের রসদ কেনার জন্য মালিকের কাছ থেকে সর্বোচ্চ দাম আদায় করে সর্বনিম্ন দামের পণ্য কিনে আনতেন। এতে বেতনের অনেক বেশি অর্থ তাদের পকেটে ঢুকে যেত। এ ছাড়া ভারতীয় দুধওয়ালাদের সঙ্গে আঁতাত করে কম মূল্যের ভেজালমিশ্রিত দুধ কেনার দুর্নামও জুটেছে খানসামাদের কপালে। এমনকি ইংরেজ পরিবারের ঘোড়ার গাড়িতে স্বজাতির লোক উঠিয়ে তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতেন তারা।
যাহোক, সামন্ত ভারত ও ব্রিটিশরাজের অধীনে খানসামারা খুব গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদার ধারক হয়ে ওঠেন। সেকালে মাস্টার শেফ মনে করা হতো তাদেরকেই। ভারতে ব্রিটিশ শাসন শেষ হলে খানসামারা সাধারণত ক্লাব, সেনা ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের বাড়িতে কাজ শুরু করেন। ভারতের বন বিভাগের রেস্টহাউসগুলোতে এখনো তারা আছেন।
ঔপনিবেশিক কালে স্থানীয়দের কাছে খানসামা বেশ আকর্ষণীয় পেশা হয়ে উঠেছিল। লোকজন তা হওয়ার ইচ্ছা নিয়ে শহরে চলে আসতেন। কলকাতায় কর্মরত খানসামাদের নিয়ে খানসামা পাড়াও গড়ে উঠেছিল। এমনকি সেখানে বর্তমানে খানসামার নামে তিনটি পাকা সড়ক আছে। বাংলাদেশে খানসামা নামে রয়েছে একটি উপজেলা—দিনাজপুরে।
আহমেদ সজিব
ছবি ও চিত্রকর্ম: সংগ্রহ