স্বাদশেকড় I ক্ষীর ক্ষৌণি
সুস্বাদু মিষ্টান্ন। ইংরেজিতে রাইস পুডিং হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা যেতে পারে। দুধ ও চিনি দিয়ে চাল, গম, ট্যাপিওকা বা ভার্মিসেলি ফুটিয়ে তৈরি। এলাচি, জাফরান, কিশমিশ, পেস্তা, কাজু বা কাঠবাদাম যোগে সুগন্ধ ও স্বাদযুক্ত করা হয়
ক্ষীর। জনপ্রিয় ভারতীয় মিষ্টিজাতীয় খাবার। এই উপমহাদেশের মানুষের জীবনে ধর্ম, খাদ্যতালিকা ও পুষ্টির দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত খাবারের সময় বা পরে ডেজার্ট হিসেবে পরিবেশন করা হয়। বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে বিভিন্ন নাম; তবে প্রস্তুতপ্রণালি কমবেশি একই রকম। ইতিহাস অনুসন্ধানে প্রমাণিত, এটি প্রাচীন ভারতীয় খাদ্যসংস্কৃতির একটি অংশ ছিল। আয়ুর্বেদে এর উল্লেখ মেলে। তবে প্রথম ক্ষীর কখন তৈরি হয়েছিল কিংবা এর উৎস কী, সে সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়।
ইতিহাসবিদদের মতে, এই মিষ্টান্নের প্রথম উল্লেখ মেলে সংস্কৃত শব্দ ‘ক্ষীরিকা’য়, যার অর্থ ‘দুধ দিয়ে তৈরি খাবার’। ভারতের গুজরাটের পদ্মাবতে চতুর্দশ শতাব্দীতে এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়, যেখানে একে চালের পুডিং হিসেবে নয়, বরং জোয়ার [গমবিশেষ] ও দুধ দিয়ে তৈরি মিষ্টি হিসেবে বোঝানো হয়েছে। তখন পুডিংয়ে বাজরা [খাদ্যপণ্যবিশেষ] ব্যবহার বেশ প্রচলিত ছিল। প্রকৃতপক্ষে, ক্ষীর এমন এক খাবার, যাতে পোতেগা ও ব্ল্যাঙ্কমেঞ্জের মতো মাংসল দিকও রয়েছে। অনেকে বিশ্বাস করেন, পোতেগা ও ব্ল্যাঙ্কমেঞ্জের মতো খাবার ক্ষীরের উৎপত্তিকে অনুপ্রাণিত করেছে। রোমানরা এই খাবার পেট ঠান্ডা রাখতে ব্যবহার করত। ডিটক্স ডায়েট হিসেবে চালের পুডিং ব্যবহারের চল ছিল তাদের মধ্যে। পাশ্চাত্যের বিপরীতে ভারতীয় উপমহাদেশে জায়ফলের ব্যবহার ক্ষীরের স্বাদে পরবর্তীকালে সংযোজন করা হয়। এই সংস্করণে সর্বদা মসলার ব্যবহার ছিল, বিশেষত দারুচিনি কিংবা এলাচির। এটি তিক্ত-মধুর স্বাদযুক্ত গুড় বা ফল ব্যবহারের জন্য হতে পারে; কারণ, তখন ভারতে চিনি ছিল একটি অচেনা উপাদান।
যাহোক, সেই সময় চিনির অপ্রাপ্যতা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এই সাধারণ মিষ্টি খাবারের নিজস্ব বৈচিত্র্য এনে দেওয়া থামাতে পারেনি। কেরালার সর্বদক্ষিণ অঞ্চলের পায়াসাম বা পায়েস উপমহাদেশে আগে থেকেই জনপ্রিয় ছিল, যা ক্ষীরের চেয়ে ঘন ও সমৃদ্ধ। সেরা পায়াসাম মেলে ওই অঞ্চলের গুরুভায়ুর ও আম্বালাপূজা মন্দিরে। বিশেষত আম্বালাপূজা মন্দিরে ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে পায়াসাম পরিবেশন করা হয়। প্রচলিত আছে, ভগবান কৃষ্ণ একজন বৃদ্ধ ঋষির রূপ ধারণ করে সেই অঞ্চলের রাজাকে দাবা খেলার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। সত্যিকারের দাবা খেলোয়াড় এবং মনস্তাত্ত্বিক কৌশলে দক্ষ হওয়ায় রাজা সানন্দে সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন। খেলায় জয়ী হলে ঋষি কী চান জানতে চাইলে রাজা ঋষির অনুরোধে হতবাক হয়ে যান। ঋষি বলেন, দাবা বোর্ডের প্রতিটি বর্গক্ষেত্রের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ধানের দানা এবং প্রতিটি খেলায় জেতার জন্য আগের চেয়ে দ্বিগুণ ধানের দানা দিতে হবে। স্বভাবতই রাজা হেরে যান। তারপর থেকে মন্দিরে বিনা মূল্যে পায়াসাম বিতরণের প্রথা চালু হয়।
দক্ষিণ ভারতে ক্ষীরের এই জনপ্রিয় সংস্করণের পর অন্য সংস্করণগুলো তামিলনাড়ু, কর্ণাটক ও অন্ধ্র প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তামিলনাড়ুতে একে পায়সাম বলা হয়; অন্যদিকে কর্ণাটক ও অন্ধ্র প্রদেশে পরিচিত পায়াসা নামে। হায়দরাবাদ (অন্ধ্র প্রদেশ) শহরে গিল-ই-ফিরদৌস নামে ক্ষীরের আরেকটি সংস্করণ রয়েছে; সেটিও বেশ জনপ্রিয়। এটি দুধ ও লাউ দিয়ে তৈরি একধরনের ঘন ক্ষীর।
আক্ষরিক অর্থে গিল-ই-ফিরদৌস মানে ‘স্বর্গের কাদামাটি’। এই বিশেষ খাবার তৈরিতে নবাবী প্রভাব রয়েছে। নবাবেরা ছিলেন ইসলামি শাসক, যারা হায়দরাবাদ শাসন করতেন। দক্ষিণে দুধ ও চিনি দিয়ে তৈরি সাধারণ ক্ষীরে তারা গুড় ও নারকেলের দুধ ব্যবহার করতেন। এর বৈচিত্র্যের সঙ্গে পুরোনো ক্ষীরের প্রস্তুতপ্রণালির কিছুটা ভিন্নতা দেখতে পাওয়া যায়।
দক্ষিণ রাজ্যের ক্ষীর বৈচিত্র্যের কথা বললেও ভারতের উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম অংশে মেলা জনপ্রিয় বৈচিত্র্যগুলোকে উপেক্ষা করার অবকাশ নেই। উত্তরে এটি ক্ষীর নামেই পরিচিত। উত্তর ভারতীয় ক্ষীরের আরও জনপ্রিয় সংস্করণ রয়েছে, যেমন বারাণসীতে উৎসব ও হবনের [প্রসাদ পোড়ানোর একটি অনুষ্ঠান] সময় প্রস্তুত করা হয় শুধু দুধ, চাল, ঘি, চিনি, এলাচি, শুকনো ফল ও কেসর (জাফরান দুধ) ব্যবহার করে। এটি অনেক হিন্দু উৎসব ও উদ্যাপনের অপরিহার্য খাবার। যদিও পদটি প্রায়শই চাল দিয়ে তৈরি করা হয়; তবে ভার্মিসেলির মতো উপাদান আরেকটি জনপ্রিয় বিকল্প। উত্তর ভারতে আরেকটি বিখ্যাত সংস্করণকে বলে ফিরনি, যা পার্সিয়ানদের হাতে উদ্ভাবিত। প্রচলিত আছে, তারা এই মিষ্টি খাবার পছন্দ করতেন। প্রকৃতপক্ষে, তারাই এই খাবারে গোলাপজল ও শুকনো ফল ব্যবহারের প্রবর্তন করেছিলেন। এসব যোগে খাবারটি আরও নিখুঁত ও মসৃণ রূপ পেয়েছিল।
ক্ষীরের পূর্ব ভারতীয় বৈচিত্র্যগুলোর উৎসের নেপথ্যে বেশ আকর্ষণীয় গল্প চালু রয়েছে। চালের ক্ষীরের ওডিশা সংস্করণ [উত্তর ওডিশায় পায়াস] সম্ভবত দুই হাজার বছর আগে ওডিশার পুরী শহরে উদ্ভূত হয়েছিল। এটি আজও সেখানে মন্দির চত্বরে রান্না করা হয়। ওডিশায় ক্ষীরের আরেকটি বিখ্যাত প্রকরণ প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন ভারতের আরেকটি বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক কোনার্ক মন্দির নির্মাণে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। জনশ্রুতি আছে, সমুদ্রের নোঙর এলাকার কাছে থাকায় বহু চেষ্টার পরেও মন্দিরটির ভিত্তি স্থাপন করা যায়নি। যতবার পানিতে পাথর ছুড়ে মারা হয়েছিল, তা কোনো চিহ্ন না রেখেই ডুবে গেছে। প্রকল্পটি প্রায় স্থগিত হয়ে পড়লে, প্রধান স্থপতির ছেলে অবশেষে সমাধান নিয়ে আসেন। কীভাবে একটি সেতুর ভিত্তি স্থাপন করা যায়, তা দেখানোর জন্য তিনি একটি বাটিতে গরম ক্ষীর ব্যবহার করেছিলেন। গরম দুধে ছোট ছোট চালের বল ব্যবহার করে নিজের বক্তব্য জাহির করেছিলেন। সেদিনের সেই ছোট্ট বালক নিশ্চিত করেছিলেন, এভাবেই কোনার্ক মন্দির তৈরি করা সম্ভব। আর তা তার দেওয়া সেই সূত্রমতেই নির্মিত হয়েছিল। পাশাপাশি ক্ষীরের একটি নতুন রূপ আবিষ্কার করেছিলেন তিনি, যাকে বলা হয় গয়ন্তা গোদি ক্ষীর, যা আজও ওই রাজ্যের অন্যতম সিগনেচার মিষ্টান্ন। এই খাবারের স্বাদ এতই দারুণ ছিল, খ্রিস্টপূর্ব ২৬১ অব্দে সংগঠিত কলিঙ্গ যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে এটি অশোকের প্রাসাদে সন্ধ্যার অন্যতম প্রধান খাবার হয়ে ওঠে। পায়াসকে একটি শুভ খাদ্য হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। সাধারণত অন্নপ্রাশনের পাশাপাশি ওডিশা পরিবারের অন্যান্য উৎসব ও জন্মদিন উদয্াপনের সঙ্গে এটি জড়িত।
বাংলায় একে পায়াস বা পায়েশ বলে। এখানে আছে আরেকটি ভিন্ন মতবাদ। এই ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবারের সন্ধান মেলে, যা দুই হাজার বছরের বেশি পুরোনো। অনেকের মতে, চৈতন্য মহাপ্রভুর পুরী সফরের সময় অনেক বাঙালি ব্রাহ্মণ বাংলা থেকে গুড়ের পায়েশ ওডিশায় নিয়ে যান। ভারতের পূর্বাঞ্চলে এ খাবার পায়ক্স নামেও পরিচিত এবং শুকনো ফলের সঙ্গে চেরি যোগের কারণে এটি হালকা গোলাপি রং ধারণ করে। এই খাবার তৈরিতে ভাতের পরিবর্তে সাগো [খেজুর থেকে আহরিত ভোজ্য মাড়] ব্যবহার করার চল রয়েছে।
বিহারে একে ‘চাওয়াল কে ক্ষীর’ বলা হয়। এটি চাল, ফুল ফ্যাট ক্রিম, দুধ, চিনি, এলাচিগুঁড়া, শুকনো ফল ও জাফরান দিয়ে তৈরি। এর আরেকটি সংস্করণ রসিয়া ক্ষীর তৈরি করা হয় চিনির বদলে গুড় দিয়ে। দেখতে বাদামি রঙের। স্বাদ হালকা, মিষ্টি।
ক্ষীরকে ভারতের অন্যান্য মিষ্টান্নের মধ্যে কুইনটেসেন্টিয়াল ডেজার্ট বা কুইন ডিশ বলা যেতে পারে। এই খাদ্য ছাড়া কোনো জমকালো ভোজসভা যেন পূর্ণতা পায় না। এই খাবারকে বিশেষত্ব এনে দিয়েছে এর বহুমুখী ব্যবহার। রন্ধন জগতের পরিচিত বেশির ভাগ ফল ও সবজিযোগেই ক্ষীর তৈরি করা যায়; হোক সেটি আপেল ক্ষীর, কিংবা লাউ থেকে কাঁঠাল এমনকি বাদাম বা সাধারণ গার্নিশ—যেকোনো কিছু থেকে তৈরি। তবে ক্ষীরের প্রকৃত জনপ্রিয়তার নেপথ্যে ধর্মবিশ্বাসের রয়েছে ভূমিকা। শ্বেত বা সাদা রংকে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। বছরের পর বছর ধরে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়া ক্ষীরের মতো ফিউশন ফুড খুব কমই রয়েছে। আর শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছেই নয়, মুসলমানদের উৎসব-আয়োজনেও এর রয়েছে দারুণ চল। আর ঈদ উপলক্ষে তো কথাই নেই!
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট