মনোযতন I মিথ্যের মিথ
মিথোম্যানিয়া। অকারণে ও অবচেতনে মিথ্যে কিংবা অতিরঞ্জিত কথা বলাজনিত মানসিক সমস্যা। এ ধরনের অভ্যাসকে আপাতদৃষ্টে হানিকর মনে না হলেও এর প্রভাব মারাত্মক
ধরা যাক, সদ্য শেষ হওয়া ঈদে আপনি একটি শাড়ি কিনেছেন। বেশ আকর্ষণীয়। আপনার এক বন্ধু আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন, এটি কোথা থেকে কিনেছেন। অনায়াসে উত্তর দিলেন, বিদেশ থেকে ছোট খালা এনেছেন। মাস তিনেক আগে কেনা। অথচ আপনি শাড়িটি কিনেছেন বাড়ির পাশের মার্কেট থেকে। কোনো কারণ ছাড়াই অবলীলায় মিথ্যে বলে দিলেন!
কিংবা ভাবুন, আপনার কাছের বন্ধু ইমতিয়াজের কথা! তার মেয়ে জাইমা ঈদে সিলেটে বেড়াতে গিয়ে বাবার ফোন পানিতে ফেলে দিয়েছিল। এতে বন্ধ হয়ে যায় ফোনটি। ফলে সাত দিনের ছুটিতে তাদের একদমই খুঁজে পাওয়া যায়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেই; ফোনে তো নেই-ই। অবশ্য ভীষণ আনন্দে ছুটি কাটিয়েছেন তারা। কিন্তু ছুটি থেকে ফিরে স্কুল খোলার পর ১৫ বছর বয়সী জাইমা তার বন্ধুদের বলল, ছুটিতে সে বাবা-মায়ের সঙ্গে প্যারিসে ঘুরতে গিয়েছিল। আইফেল টাওয়ার দেখে এসেছে। সে তার প্যারিস ভ্রমণের সবকিছুর প্রায় খুঁটিনাটি বর্ণনা দিল বন্ধুদের কাছে। কিছুদিন পর তার মায়ের সঙ্গে এক বন্ধুর মা ফোনে কথা বলতে গিয়ে প্যারিস ভ্রমণের প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি আকাশ থেকে পড়লেন! জানালেন, প্যারিস কেন, ইউরোপের কোনো দেশেই কখনো বেড়াতে যাননি তারা; জাইমার তো পাসপোর্টই করা হয়নি। শুধু এই একটি ঘটনাই নয়, জাইমা যেকোনো বিষয়ে দেদার মিথ্যে বলে ফেলে।
এই যে অকারণে মিথ্যে বলা, মানসিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের ভাষায় এই অভ্যাসকে বলে ‘প্যাথলজিক্যাল লাইয়িং’। আরেক নাম ‘মিথোম্যানিয়া’। একে সরাসরি রোগ না বলে রোগের উপসর্গ হিসেবেই দাবি করেন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। এই উপসর্গে আক্রান্ত ব্যক্তি কারণে-অকারণে মিথ্যে বলেন। স্বাভাবিক বিচারে বিষয়টি বড় সমস্যা মনে না হলেও একসময় তিনি ক্রমেই একা হয়ে পড়েন; বন্ধু-স্বজনদের কাছে হেয় হন।
এই মিথ্যে বলে আপনার কোনো লাভ হয় না, হয়তো সেগুলো নিতান্তই ছাপোষা মিথ্যে কিংবা বানিয়ে বানিয়ে কথা বলা, যাতে কারও কোনো লাভ-ক্ষতিও হচ্ছে না। তবু আপনি এসব বলে যান। প্রশ্ন করলে বলেন, যেকোনোভাবে মিথ্যে বলা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেন না; অস্থিরবোধ হয়। মিথ্যে কিংবা বানিয়ে বলে তবেই শান্তি! কিন্তু মনে রাখবেন, এসব কারণে মিথোম্যানিয়ায় আক্রান্তদের আইনি ঝামেলার সম্মুখীন হওয়ারও ইতিহাস রয়েছে। তাই কারও যদি এ ধরনের সমস্যা থাকে, তাহলে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়া কিংবা বড় ধরনের আইনি ঝামেলায় পড়ার আগেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
ইতিহাসের পাঠ
১৮৯১ সালে এন্টন ডেলব্রোক তার চিকিৎসাসংক্রান্ত বইয়ে মিথোম্যানিয়ার কথা প্রথম উল্লেখ করেন। বইতে বলা হয়, এ সমস্যায় আক্রান্তরা সব সময় বানিয়ে বানিয়ে, বাড়িয়ে কথা বলেন। তারা মূলত কল্পনার জগতে যা ভাবেন, তা নিয়েই বাস্তবেও বলতে শুরু করেন। একে তাই আচরণগত সমস্যাও বলা হয়।
‘কারণে মিথ্যা বলার চেয়ে অকারণে মিথ্যা বলতে মানুষ বেশি পছন্দ করে’—এমন কথা হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন তার ‘মিসির আলির অমীমাংসিত রহস্য’ গ্রন্থে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কাকাবাবু’ সিরিজের জোজোর কথাও নিশ্চয় মনে আছে। যে মিথ্যে আর বানিয়ে কথা বলায় পটু! জোজোর মতো অনেকে আছি আমরা, যারা বানিয়ে বানিয়ে কথা বলি, যাতে কারও কোনো লাভ কিংবা ক্ষতি হয় না। গবেষণায় দেখা গেছে, একজন মানুষ কারণে-অকারণে দৈনিক গড়ে ১ দশমিক ৬৫টি মিথ্যে কথা বলে। এই মিথ্যে বলার জন্য ব্যক্তি নিজের মধ্যে একধরনের অপ্রতিরোধ্য তাড়না অনুভব করে। বাধ্য হয়। কখনো এটি তাড়নাগত, আবার কখনো হয়ে ওঠে বাধ্যতাধর্মী।
শৈশব থেকে শুরু, তবু
সাধারণত শৈশব থেকেই আমরা কম-বেশি বানিয়ে গল্প বলি কিংবা বলতে পছন্দ করি। তবে এই অভ্যাস বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চলেও যায়। যদি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও থেকে যায়, তবেই সেটি মিথোম্যানিয়া বলে বিবেচিত হয়। এতে আক্রান্তরা কোনো কারণ ছাড়াই মিথ্যে বলেন এবং তারা সেই মিথ্যেকে সত্য হিসেবে বিবেচনা করে একটু বানিয়ে, একটু বাড়িয়ে সবার সঙ্গে বলতে শুরু করেন। একটি সত্য ঘটনার মধ্যেও তারা বানিয়ে কয়েকটি মিথ্যে জুড়ে দিয়ে তারপর অন্যদের সামনে উপস্থাপন করেন।
অকারণে কেন এ পথে
অকারণে মিথ্যে বলার সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। অবশ্য নানা কারণে মানুষ মিথ্যে কথা বলে। কেউ কেউ তা বলেন স্বভাবগতভাবে। তবে পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার, ইমপালস কন্ট্রোল ডিজঅর্ডার, ওসিডি, ফ্যাক্টিসিয়াস ডিজঅর্ডার, ডিমেনশিয়া, মাদকাসক্তিসহ বেশ কিছু মানসিক সমস্যার লক্ষণ হিসেবে অকারণে মিথ্যে বলার প্রবণতা থাকতে পারে। এ ছাড়া যাদের আত্মবিশ্বাস কম, যারা নিজেদেরকে সামাজিক বৈষম্যের শিকার মনে করেন, যাদের প্যারেন্টিং ত্রুটিযুক্ত এবং সামাজিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে নানাভাবে, তাদের মধ্যে এ প্রবণতা থাকতে পারে।
নায়ক কিংবা খলনায়ক
যারা অকারণে মিথ্যে বলেন, তারা খুব ভালো স্টোরিটেলার! বলার সময় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বানোয়াট বর্ণনা দিতে পারেন। কখনো সেই মিথ্যে ঘটনায় নিজেকে নায়ক, আবার কখনো শিকার হিসেবে পরিচিত করেন। অনেক সময় এই মিথ্যেকে নিজে শক্তভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করেন। তারা খুব দ্রুত চিন্তা করতে পারেন। তাদের কারও কারও মধ্যে সৃষ্টিশীল কাজ করার গুণও থাকে। এই অকারণে মিথ্যে বলার জন্য যিনি বলছেন, তার পরিবারের সদস্যরা প্রায়ই বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। তবে মিথ্যেটি ধরা পড়ার পরও ব্যক্তি নিজে কোনো গ্লানি অনুভব করেন না।
সমাধানে
গবেষণায় দেখা গেছে, মিথোম্যানিয়ায় পুরুষের তুলনায় নারীর আক্রান্তের হার বেশি। এতে আক্রান্তরা তাদের বলা মিথ্যেকে মিথ্যে ভাবেন না। ফলে চিকিৎসার দিকেও সাধারণত কেউ ঝুঁকতে চান না। এ বিষয়ে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল বলেন, ‘মিথ্যে কথা বলাটা সরাসরি কোনো রোগ নয়; এটি বরং একটি বড় রোগের উপসর্গ। এই অভ্যাস যেকোনো মানুষকে সিজোফ্রেনিক করে তুলতে পারে। অ্যান্টি-সোশ্যাল পার্সোনালিটি, আত্মবিশ্বাসের অভাব, নিজেকে নিয়ে অসন্তুষ্টি, কিংবা নিজেকে জাহির করার প্রবণতা থেকে মানুষ এ ধরনের ক্রমাগত মিথ্যে বলে থাকেন। তবে কখনো কখনো বিপদগ্রস্ত লোক নিজেকে বাঁচাতে মিথ্যের আশ্রয় নেন। নির্যাতিত মানুষগুলো নির্যাতন থেকে বাঁচতেও মিথ্যে বলে থাকেন। এটি অবশ্য দুর্ঘটনাজনিত মিথ্যে। তবে ক্রমশ মিথ্যে বলা ব্যক্তিরা নিজের করা ভুল থেকে শিক্ষা নেন না বলেই মিথ্যে বলেন। অনেক সময় অন্যের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য মিথ্যে বলে নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি করে থাকেন এ ধরনের লোক। এদের মধ্যে অপ্রাপ্তি ও হতাশা ভীষণভাবে কাজ করে।’
‘আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আইডেন্টিটি ক্রাইসিস ও নৈতিক উন্নয়নের ঘাটতি থাকলেও মানুষ মিথ্যে বলে। বলা যায় আদর্শে ঘাটতি থাকলেও। যে ব্যক্তি মিথ্যে বলেন, তাকে তার সমাজ, পরিবার ও পরিপার্শ্ব ঠেলে দেয় এমনটা বলার জন্য। তাই পরিবার থেকে নৈতিকতার শিক্ষা পাওয়া জরুরি। কেননা ছোট ছোট মিথ্যে থেকে বড় সংকট তৈরি হয়। পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার কিংবা সিজোফ্রেনিয়ার মতো রোগ বাসা বাঁধতে পারে মনোজগতে। আশপাশে যারা মিথ্যে বলাটা টের পাবেন, তাদেরই উচিত সেই ব্যক্তিকে সহায়তা করা,’ যোগ করেন ডা. কল্লোল।
তিনি আরও জোর দিয়ে বলেন, অকারণে মিথ্যে বলা ব্যক্তির প্রতি ক্ষুব্ধ হওয়া চলবে না। তার এই আচরণকে রোগের লক্ষণ হিসেবে গণ্য করা চাই। তিনি মিথ্যে বলার বিষয়টি অস্বীকার করতে পারেন। সে সময় তার সঙ্গে তর্ক করা ঠিক নয়। বরং তার প্রতি সহানুভূতি দেখাতে হবে। তাকে নিয়ে হাসাহাসি কিংবা বিদ্রূপ করা ভালো নয়। কেউ এমনটা করলে নিরুৎসাহিত করতে হবে। আবার তিনি যখন মিথ্যে বলছেন, সেটি বুঝতে পেরেও তার সঙ্গে তাল মেলানো ঠিক নয়। এ সময়ে বরং প্রসঙ্গ পরিবর্তন করা শ্রেয়, যেন তিনি মিথ্যে বলা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করতে পারেন।
অকারণে মিথ্যে বলার পেছনে যদি কোনো মানসিক রোগ নির্ণীত হয়ে থাকে, তাহলে সেটির বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা অবশ্যই গ্রহণ করা চাই। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন হতে পারে সাইকোথেরাপি কিংবা ওষুধের।
আশিক মুস্তাফা
ছবি: ইন্টারনেট