ফিচার I মে-তে মাত
মে মাসজুড়ে নানা উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে দুনিয়াবাসী। পৃথিবীর নানা প্রান্তে, নানা রঙে। বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়াতে যারা ভালোবাসেন, তারা আগে থেকে পরিকল্পনা করতে পারলে ঠিকঠাক হাজিরা দিতে পারেন এসব উৎসবের কোনো কোনোটায়। এমনই কিছু বার্ষিক উৎসবে দেওয়া যাক নজর
বালিস্পিরিট ফেস্টিভ্যাল
প্রত্যেক ব্যক্তিমানুষের অন্তস্তলে ইতিবাচক পরিবর্তনের স্পৃহা জাগিয়ে তোলার এবং সেটিকে লালন করার উদ্দেশ্য নিয়ে ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপের উবুদ শহরে আয়োজিত হয় এই উৎসব। যেন এতে অংশগ্রহণকারীরা মনে সেই জাগ্রত পরিবর্তনস্পৃহাকে লালন করে নিজের বাড়িতে, নিজ কমিউনিটির কাছে, পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দিতে পারেন। যোগব্যায়াম, নৃত্য ও সংগীতের উপকারী আর অনুপ্রেরণামূলক ঐতিহ্যগুলোর ভেতর দিয়ে আত্মিক, সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলে প্রাণোচ্ছলতার সঙ্গে জীবন কাটানোর প্রেরণা জোগায় এই উৎসব।
অফিশিয়াল ওয়েবসাইট সূত্রে [www.balispiritfestival.com] জানা যায়, ব্যতিক্রমধর্মী উৎসবটির সূচনা ২০০৮ সালে। তাতে উপস্থাপিত হয় হাথা, ভিনিয়াসা ফ্লো, য়িন, লাফটার, পাওয়ার, অনুসরা, আস্তাঙ্গা, সিলাত, ক্যাপোয়েইরা, পোই, কি গংসহ বিভিন্ন স্টাইলের যোগব্যায়াম। পরিবেশিত হয় মান্ডালা, জাভানিজ, বালিনিজ, ভারতীয় ও পশ্চিম আফ্রিকান ট্র্যাডিশনসহ বিভিন্ন শৈলীর নৃত্য।
পাঁচ থেকে ছয় দিনের এই উৎসবের প্রতি রাতের কর্মযজ্ঞের সমাপনী ঘটে বিশ্বের নানা প্রান্তের পারফরমারদের পরিবেশন করা সংগীতের মূর্ছনায়। এবারের আসর ১ থেকে ৫ মে। উৎসবজুড়ে ইয়োগা, ড্যান্স, হিলিং প্র্যাকটিস, ব্রেথওয়ার্ক, মার্শাল আর্টস, সাউন্ড থেরাপি ও আরও অনেক কিছু ঘিরে আয়োজিত হয় তিন শতাধিক কর্মশালা ও সংগীত সেশন।
আফ্রিকাবার্ন
শহর থেকে দূরে। দক্ষিণ আফ্রিকার তানকওয়া কারু ন্যাশনাল পার্কে। আদিগন্ত ছড়ানো বালুকা আর পাথুরে প্রান্তর। ধূলি-ধূসরতা। তার বুকে একদল স্বপ্নবাজ মানুষের প্রাণোচ্ছল হুল্লোড়। সৃজনশীলতার আউট অব দ্য বক্স প্রদর্শনী। বলছি আফ্রিকাবার্নের কথা। অন্য যেকোনো উৎসবের চেয়ে একেবারেই আলাদা। প্রতিবছর এপ্রিলের শেষ থেকে মের শুরু পর্যন্ত চলে। সাত দিনব্যাপী। এবারের আসর ২৯ এপ্রিল থেকে ৫ মে।
এই বার্নিংম্যান ফেস্টিভ্যাল আসলে দুনিয়ার নানা প্রান্তের সংগীতপ্রেমী, সংস্কৃতিমনা, সৃজনশীল, শিল্পী ও ট্রেন্ডসেটারদের মিলনমেলা। সূচনা ২০০৭ সালে। উদ্দেশ্য কমিউনিটি বিল্ডিং, ডিকমোডিফিকেশন, ক্রিয়েটিভিটি, সেলফ-রিলায়েন্স ও র্যাডিক্যাল সেলফ-এক্সপ্রেশনের মধ্য দিয়ে নিরীক্ষার মাধ্যমে পৃথিবীকে নতুনভাবে উদ্ভাবনের সুযোগ তৈরি করা। প্রতিবারই নতুন নতুন থিমে আয়োজিত। এবারের থিম ‘ক্রিয়েশন’ বা সৃষ্টিশীলতা।
ফেস্টিভ্যালের ওয়েবসাইটে [www.afrikaburn.org] অংশগ্রহণে ইচ্ছুকদের আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, ‘আপনারা যারা নির্মাতা, স্বপ্নবাজ, মহাজাগতিক অভিযাত্রী—আপনাদের আমন্ত্রণ জানাই দক্ষিণ আফ্রিকার বিশেষ বালুকাবেলায়, সৃজনশীলতার অন্তরমহলে আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য। লার্জার-দ্যান-লাইফ শিল্পের মহিমায় মরুভূমির বাতাসের গুঞ্জনকে আপন করে নিতে। যেখানে প্রতিটি মুহূর্তই সৃজনশীলতার সম্ভাবনা জারি রাখে। এই ধূলির ভেতর আসুন আমরা প্রত্যেকের অন্তস্তলে বসত করা মহাজগতের স্ফুলিঙ্গকে প্রজ্বালন করি।
আসুন, আমরা কারু মরুভূমির ধূলিগুলোকে কল্পনার পীঠস্থান আর ভাবনার প্রাসাদে রূপ দেওয়ার মাধ্যমে হয়ে উঠি ভবিষ্যৎ স্বপ্নগুলোর স্থপতি।’ বলে রাখি, এটি সম্পূর্ণই স্বেচ্ছাসেবী ইভেন্ট। এখানকার সবকিছুই কমিউনিটির ভেতর থেকে ঘটে। বাইরের কোনো বিক্রেতার জায়গা নেই। অর্থাৎ কেনাবেচার মামলা নেই। এমনকি নেই বিনিময় প্রথাও।
আয়োজনস্থলের অবস্থান রাজধানী কেপটাউনের উত্তর দিকে; ৩০০ কিলোমিটার দূরে। আয়োজনজুড়ে থাকে সংগীতের ছড়াছড়ি। তবে কোনোটাই পূর্বনির্ধারিত নয়। ফলে চমকের পর চমকের সম্ভাবনা। তবে খেয়াল রাখা চাই, উৎসবকালে ওখানকার আবহাওয়া বেশ বেসামাল থাকে! দিনে ভীষণ গরম আর রাতে ভীষণ শীত পড়ে।
বার্গেন ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল
১৯৫৩ সাল থেকে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়ে আসা এই উৎসব উত্তর ইউরোপীয় শিল্প ময়দানের একটি কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। মিউজিক, অপেরা, থিয়েটার ও ড্যান্সের নতুন নতুন প্রকল্পের ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ারের জন্য বিশেষভাবে খ্যাত। প্রতিবার হাজিরা দেন লক্ষাধিক দর্শনার্থী। ৭০টির বেশি ভেন্যুতে আয়োজিত হয় চার শতাধিক ইভেন্ট। স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উৎসব এটি।
অফিশিয়াল ওয়েবসাইট [www.fib.no] থেকে আরও জানা যায়, ফেস্টিভিটিস, ফাউন্ডেশনস ও ফ্রিকশন—‘এফ’ বর্ণে শুরু এই তিন টার্মের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় সব ইভেন্ট। ফেস্টিভিটিসের মূলে তরুণ ও বয়স্ক—উভয় প্রজন্মকে বিনোদিত করা ও চমকে দেওয়া এবং রাস্তাজুড়ে আনন্দমুখরতার জয়গান।
পাশাপাশি মস্তিষ্ক, অন্তর ও পায়ের পাতা দিয়ে তা অনুভব করারও উপলক্ষ। ফাউন্ডেশনের মূলে ইতিহাস জাহির করা পারফরম্যান্স ও কনসার্টগুলোর মাধ্যমে ধ্রুপদী শিল্প-ঐতিহ্যের সর্বসেরা নমুনাগুলো পরিবেশন করা হয়। তাতে ঐতিহ্য ও নতুনত্ব এবং গভীরতা ও প্রতিফলনের ঘটে সন্নিবেশ। ফ্রিকশনের মূলে বেপরোয়া ও বিচক্ষণতা এবং নিরীক্ষা ও অন্বেষণের ভেতর দিয়ে নতুন প্রযুক্তিকে শৈল্পিক ল্যান্ডস্কেপে অবাধ উপস্থাপনা। উৎসব চলে ১৫ দিন ধরে। এবারের আসর ২২ মে থেকে ৫ জুন।
চেয়ুং চাউ বান ফেস্টিভ্যাল
হংকংয়ের চেয়ুং চাউ দ্বীপে অনুষ্ঠিত। এবারের আসর ১২ থেকে ১৬ মে। উৎসবটির বেশির ভাগ অনুষ্ঠানই আয়োজিত হয় ওই দ্বীপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান পাক তাই টেম্পলে। ইতিহাস বলে, সপ্তদশ শতাব্দীতে হংকংজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল প্লেগ। দ্বীপ থেকে মন্দ আত্মাকে তাড়াতে এবং প্লেগ থেকে রেহাই পেতে স্থানীয়রা ওই টেম্পলের বাইরের দিকে একটি বেদি নির্মাণ করেছিলেন। সেখানে প্রার্থনা করতেন তারা।
স্থানীয়দের বিশ্বাস, সেই প্রার্থনায় কাজ হয়েছিল। প্লেগ থেকে রেহাই পেয়েছিলেন দ্বীপবাসী। তাই প্রতিবছর সেখানে মিউজিক, ড্যান্স, ড্রামস ও প্যারেডের মাধ্যমে এ ঘটনা উদ্যাপন করা হয়।
অফিশিয়াল ওয়েবসাইট (www.cheung-chau.com/bun-festival) সূত্রে আরও জানা যায়, উৎসবের মূল অংশ হলো বান টাওয়ারস, প্যারেড উইদ চিলড্রেন’স ফ্লোটস, বান টাওয়ার ক্লিম্বিং কম্পিটিশন এবং ভেজিটেরিয়ান ফুড উপভোগ। বলে রাখি, বান টাওয়ার মানে বনরুটি দিয়ে অতিকায় মিনার গড়ে তোলা!
মাদেইরা আইল্যান্ড ফ্লাওয়ার ফেস্টিভ্যাল
পর্তুগালের মাদেইরা দ্বীপে এই উৎসব চলে প্রায় তিন সপ্তাহ। এবারের আসর ২ থেকে ২৬ মে। ওয়েবসাইট [www.visitmadeira.com/en/whats-on/events/flower-festival] বলছে, আটলান্টিকের বুকে ছোট্ট সুন্দর দ্বীপ মাদেইরা। ফুলে ভরা এই ভূখণ্ডকে আদর করে অনেকেই ডাকেন চিরকালীন বসন্তের দ্বীপ কিংবা আটলান্টিকের ফুলবাগান। দ্বীপটির রাজধানী ফুনচালে অনুষ্ঠিত হয় এই ফুলোৎসব। একে ঘিরে শহরকে সাজানো হয় বর্ণিল সাজে। পুরোটাই চমৎকার ফুলের সমাহারে।
ফুল-সংশ্লিষ্ট কনসার্ট, মার্কেট, শো আর প্রতিযোগিতায় মাত হয়ে থাকেন দর্শনার্থীরা। উৎসবের মূল প্যারেডের নাম ‘কর্তেয়ো আলেগরিকো’; সরল বাংলায় ‘বিবাহের রূপক’ বলা যেতে পারে। অনুষ্ঠিত হয় মের কোনো এক রোববার দুপুরে। প্যারেড চলাকালে চমৎকার সব পোশাক পরিহিত শিশু, বয়স্ক ও নারী-পুরুষেরা শহরজুড়ে বিচরণ করে। ফুলের পোশাক, ফ্লোট আর কোরিওগ্রাফিতে যেন স্বর্গোদ্যানে রূপ নেয় চারপাশ।
ইলেকট্রিক ডেইজি কার্নিভ্যাল
যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসে। বৈশ্বিকভাবে বিখ্যাত ড্যান্স মিউজিক ফেস্টিভ্যাল। সংক্ষেপে ইডিসি নামে পরিচিত। উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে বড় ড্যান্স মিউজিক ফেস্ট। এর সংস্করণ মেক্সিকো, ফ্লোরিডা ও জাপানেও অনুষ্ঠিত হয়। ওয়েবসাইট [www.lasvegas.electricdaisycarnival.com] বলছে, এবারের মূল আসর ১১ থেকে ১৯ মে।
ইলেকট্রিক স্কাইয়ের নিচে জীবন, প্রেম, শিল্প ও সংগীতকে উদ্যাপন করতে জড়ো হন অনুরাগীরা। কল্পনাশক্তির ঘটে জমকালো প্রদর্শনী। সারা দুনিয়ার খ্যাতিমান পারফরমারদের হাজিরা থাকে। পাইরোটেকনিক, কার্নিভ্যাল রাইডসের পাশাপাশি ড্যান্সার, স্লিট ওয়াকার, অ্যারিয়ালিস্ট, সার্কাস পারফরমার এবং আরও অনেক কিম্ভুতকিমাকার চরিত্রের উপস্থিতিতে একাকার। ইন্টারঅ্যাকটিভ আর্ট ইনস্টলেশন, এলইডি থ্রিডি সুপারস্ট্রাকচার এবং থ্রিডি গ্লো-ইন-দ্য-ডার্ক এনভায়রনমেন্ট মন্ত্রমুগ্ধ করে দর্শনার্থীদের।
হামামাৎসু ফেস্টিভ্যাল
মে মাসের শুরুতে অনুষ্ঠিত হয়। জাপানের হামামাৎসু শহরে। তিন দিনের উৎসব। এবারের আসর ৩ থেকে ৫ মে। দুই ভাগে বিভক্ত। ভাসমান প্যারেড এবং অতিকায় ঘুড়ি ওড়ানো। ওয়েবসাইট [www.inhamamatsu.com/recommend/hamamatsu-festival.php] বলছে, উৎসব চলাকালে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে রাস্তাজুড়ে সুসজ্জিত বিরাট প্যারেড জায়গা করে নেয়। এর প্রতিটি অংশই শহরটির একেকটি অঞ্চলের বিশেষত্বের প্রতিনিধিত্ব করে।
প্যারেডগুলো সাজানো হয় কাঠে তৈরি সুদৃশ্য ভাস্কর্য দিয়ে। কোনো কোনোটি শতবর্ষ পুরোনো। জাপানি ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র বাজাতে বাজাতে প্যারেডে নেতৃত্ব দেয় শিশুরা। এ সময়ে সঙ্গ দেওয়া বড়দের হাতে থাকে লন্ঠন ও পতাকা। তারা আওয়াজ তুলে জোগাতে থাকেন উৎসাহ।
এ রকম ৭০টির বেশি প্যারেডের দেখা পান দর্শনার্থীরা। উৎসবের দ্বিতীয় ভাগে বিরাট সব ঘুড়ি ওড়ানোর ধুম পড়ে যায়। শুরু সকাল ১০টায়। চলে সূর্যাস্ত পর্যন্ত।
লাইফস্টাইল ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট