skip to Main Content

টেকসহি I হাস্য লাস্য

‘শান্তির শুরু হাসি থেকে’—মাদার তেরেসার এই উক্তি সাক্ষ্য দেয় বেঁচে থাকার জন্য হাসি কতটা প্রয়োজনীয়। শিশু থেকে বৃদ্ধ—হাসির ওপর ভিত্তি করেই কাটিয়ে দেয় জীবনের অনেকটা সময়। হাসি এমন একটি চিহ্ন, যার অর্থ সর্বজনীন। এটি সংক্রামকও বটে। এক হাসিমুখ ছড়িয়ে দেয় আরেকটি মুখে হাসি। এই হাসিমুখ তুলে ধরে মন ভালো করার, আনন্দে থাকার গল্প

হাসলে শরীর ও মন ভালো থাকে—এ কথা তো গবেষণায় বহু আগেই প্রমাণিত। কিন্তু অটুট হাসিমুখের জন্য যে দিবস উদ্‌যাপিত হয়, তার গল্প কি আমরা জানি? প্রতিবছরের মে মাসের প্রথম রোববার পালিত হয় বিশ্ব হাসি দিবস বা ওয়ার্ল্ড লাফটার ডে। হাসিমুখে ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য ও ইতিবাচকতা বজায় রাখাই এর মূল বিষয়। দিবসটির সূত্রপাত ১৯৯৮ সালে। ভারতের মুম্বাইয়ে ডা. মদন কাটারিয়ার হাত ধরে। তিনি তখন ‘লাফটার ইয়োগা’ বা যোগাসনের মাধ্যমে হাসির উপযোগিতা সম্পর্কে তুলে ধরেন। দাবি করেন, হাসির মাধ্যমে যেমন সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায়, তেমনি মানসিক স্থিতিও ভালো থাকে।
সে বছর ডা. কাটারিয়া বিশ্ব হাসি দিবসের সূত্রপাত ঘটালেও লাফটার ইয়োগার সূচনা ১৯৯৫ সালে। এই উদ্যোগে ডা. কাটারিয়ার সঙ্গী ছিলেন তার স্ত্রী মাধুরী এবং আরও তিন বন্ধু। ফেশিয়াল ফিডব্যাক হাইপোথিসিসের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে লাফটার ইয়োগাকে জনপ্রিয় করে তোলেন মুম্বাইয়ের ওই বিশেষজ্ঞ। ভারতের স্থানীয় একটি পার্কে তারা শুরু করেছিলেন হাসির যোগাসনের চর্চা। রসিকতা কিংবা কৌতুক ছাড়াও কীভাবে দৈনন্দিন পরিস্থিতি বিচার করে হাসা সম্ভব, সেসব পদ্ধতি নিয়েই আলোচনা হতো সেই যোগাসনে।
হাসির যোগাসন বর্তমানে আন্তর্জাতিকভাবে জনপ্রিয়। যোগব্যায়াম এবং হাসির ব্যায়ামকে একত্র করে এটি। কৌতুকই কেবল মূল উৎস নয়, বরং জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিও হাসির সঞ্চার ঘটাতে পারে, এটি প্রমাণ করাই লাফটার ইয়োগার মূল উদ্দেশ্য। নিয়মিত এর চর্চা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। পাশাপাশি এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকেও শক্তিশালী করতে কাজে দেয়। কঠিন সময়েও ইতিবাচকতা ধরে রাখতে সহায়তা করে এই যোগাসন। বর্তমানে বিশ্বের ১১০টি বেশি দেশের লাফটার ক্লাব এই ইয়োগার সঙ্গে যুক্ত। ঢাকার রমনা পার্ক এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও সকালের দিকে দেখা যায় হো হো করে হাসির চর্চা। একদল মানুষ লাফটার ইয়োগা চর্চা করে সেখানে। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে হাসতে থাকা মানুষগুলোর মূল লক্ষ্য হাসির মাধ্যমে শরীর সুস্থ রাখা।
হাসি নিয়ে অবশ্য আরেকটি দিবসও প্রচলিত আছে বিশ্বজুড়ে। ওয়ার্ল্ড স্মাইল ডে। পালিত হয় অক্টোবর মাসের প্রথম শুক্রবার। এই দিবসের নেপথ্যের গল্পটিও চমৎকার। হাসিমুখের কারিগরের হাত ধরেই ১৯৯৯ সাল থেকে পালিত হয়ে আসছে।
গেল শতকের মাঝামাঝিতে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসের শিল্পী হার্ভে বল বিখ্যাত হয়েছিলেন সারা বিশ্বে। তার তৈরি হাসির ইমোজি ছিল সেই খ্যাতির কারণ। কালো রঙের দুটি বিন্দু দিয়ে চোখ, একটি ওল্টানো বক্ররেখার মুখ, সঙ্গে একটি বৃত্ত ছিল সেই ইমোজিতে। উৎফুল্লতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হলুদ রং ব্যবহার করা হয়েছিল তাতে। ১৯৬৩ সালে মাত্র ৪৫ ডলারে ইমোজিটি কিনে নেয় একটি ইনস্যুরেন্স সংস্থা। হার্ভে বলের তৈরি ইমোজি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে থাকে সর্বত্র। নিজের সৃষ্টির এমন বাণিজ্যিকীকরণ দেখে খানিকটা হতাশ হন হার্ভে। ঘোষণা দেন হাসি দিবস পালনের। প্রতিষ্ঠা করেন হার্ভে বল ওয়ার্ল্ড স্মাইল ফাউন্ডেশন। ২০০১ সালে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন হার্ভে বল। তার সেই ফাউন্ডেশনের পৃষ্ঠপোষকতায় জাতি, ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে পালিত হয়ে আসছে ওয়ার্ল্ড স্মাইল ডে।
কত রকমের হাসি আছে আমাদের চারপাশে? গবেষণা বলে, ১৯ রকমের। এর মধ্যে অট্টহাসি, মুচকি হাসি, মেকি হাসি, মুক্তঝরা হাসি, মোনালিসার রহস্যময়ী হাসি কিংবা ভুবনভোলানো হাসি—প্রকারভেদ বলে শেষ করা বেশ কঠিনই বটে! ব্যক্তিভেদে হাসির অর্থও কিন্তু ভিন্ন রকমের। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা পাঁচ শতাধিক বছরের পুরোনো চিত্রকর্ম মোনালিসার কথা ধরা যাক। মোনালিসাকে প্রায়ই হেঁয়ালি মানসিক অবস্থার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়। এই চিত্র বেশির ভাগ লোকের কাছে সুখের প্রতীক। কারও কারও কাছে মিষ্টি হাসি বলেও প্রতীয়মান। আবার এই হাসিই অনেকের কাছে বিদ্রূপের প্রতীক। একটু বেশি সময় ধরে দেখলে মোনালিসার হাসি ‘অখুশি’ বলেও মনে হয় অনেকের কাছে।
যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত লোমালিন্ডা ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের ক্লিনিক্যাল ইমিউনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. লোরেন্স বার্ক হাসি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন। তাতে উঠে এসেছে চমকপ্রদ নানা তথ্য। যেমন মানুষের উদ্বেগ বাড়ানোর হরমোন করটিসোলের নিঃসরণ কমায় হাসি। ফলাফল? হাসির মাধ্যমে মানুষ উদ্বেগমুক্ত হয়। হাসির মাধ্যমে বিভিন্ন নেতিবাচক আবেগ প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকে। প্রাণখোলা হাসি দিয়ে অন্যের মনও নিমেষে ভালো করে দেওয়া যায়।
ডা. বার্কের মতে, হাসি রোগ প্রতিরোধক শ্বেতরক্তকণিকার উৎপাদন বাড়ায়। তাই রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি করতে নির্মল হাসির জুড়ি নেই। তা ছাড়া প্রতি ঘণ্টায় ১৫ সেকেন্ড অর্থাৎ দিনে ৬ মিনিট করে হাসতে পারলে আমাদের বুক ও কাঁধের মাংসপেশি ক্রমাগত সংকুচিত ও প্রসারিত হবে এবং মন থাকবে নিরুদ্বিগ্ন ও প্রফুল্ল। হাসির আরও গুণের কথাও বলেছেন ডা. বার্ক। তার মতে, অনাবিল হাসি আক্রমণাত্মক একগুঁয়ে স্বভাবকে বদলে দিতে সাহায্য করে। যত বেশি হাসবেন, তত বেশি রাগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তৈরি হবে। পাশাপাশি হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিও কমায় হাসি।
হাসিতে মুখের ৫ থেকে ৫৩ ধরনের পেশি সঞ্চালিত হয়। বিশেষ করে অট্টহাসি অ্যান্ডোরফিন নামক রাসায়নিক পদার্থের নিঃসরণ ঘটায়, যা আমাদের ব্যথার অনুভূতি কমায়। আমরা যখন আনন্দে থাকি, মস্তিষ্কে ডোপামিন নামের হরমোনের নিঃসরণ বাড়ে। সেরোটোনিন ও অ্যান্ডোরফিন নামের হরমোনের প্রভাবে মানুষের মেজাজ ভালো থাকে এবং মানসিক চাপ ও যন্ত্রণা কমে।
হৃদ্যন্ত্রের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করে হাসি। এর ফলে শরীর শিথিল হয় এবং রক্তচাপ কমে। হাসলে মন ভালো তো থাকেই, আয়ুও বাড়ে। এ ছাড়া মুখের মাংসপেশির ব্যায়াম হয়ে যায়। ফলে যারা নিয়মিত হাসেন, তাদের মুখে বার্ধক্যের ছাপ তুলনামূলক কম পড়ে। রেগে থাকার চেয়ে হাসির মাধ্যমে উৎফুল্ল থাকলে শরীরের শক্তি খরচও কম হয়। তা ছাড়া, হাসলে ফুসফুস আর মস্তিষ্কে অক্সিজেনের প্রবাহ বাড়ে। চিন্তাভাবনা শাণিত হওয়ার পাশাপাশি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাও সুসংহত হয়। হাসির মাধ্যমে ক্লান্তি, অবসাদ দূরে সরে যায়। প্রতিদিন ১৫ মিনিট হাসলে প্রায় ৪০ ক্যালরি শক্তি ক্ষয় হয়, যা ওজন কমাতে সাহায্য করে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, হাসিমুখ ও কৌতুকবোধ একজন মানুষকে অন্যদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে। পরিবার ও সমাজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাসি দিয়ে সহজে স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতি তৈরি করে নেওয়া যায়। সামাজিক বিভিন্ন পরিস্থিতিতে হাসি দিয়ে অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আর্ন্তব্যক্তিক যোগাযোগের মধ্যেও হাসির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
হাসিতে আছে নানা বৈচিত্র্য। বিবিসির তথ্যমতে, হাসির অন্তত ১৯টি ধরন থাকলেও এর মধ্যে ‘খুশি’ প্রকাশ করে মাত্র ছয়টি। বাকি হাসির ধরন দেখা যায়—যখন আমরা ব্যথা পাই, বিব্রত কিংবা অস্বস্তিকর অবস্থায় থাকি। আতঙ্কিত এমনকি দুঃখিত অবস্থায়ও হাসি ফুটে ওঠে আমাদের মুখে। কখনো কখনো হাসির অর্থ অবজ্ঞা, রাগ কিংবা অবিশ্বাস। আমরা অনেক সময় মিথ্যে বললে হাসি; আবার কিছু হারিয়ে ফেললে সান্ত¡না দেওয়ার উদ্দেশ্যেও।
লৈঙ্গিক বিবেচনায় পুরুষের তুলনায় নারীর হাসির প্রবণতা বেশি। পুরুষ দৈনিক গড়ে ৮ বার হাসলে নারী হাসে অন্তত ৬২ বার। আর শিশুদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা অন্তত ৪০০।
হাসি নিয়ে কবিরাও কম কলকাকলি করেননি! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই বিশের দশকে লিখে গেছেন চাঁদের হাসির বাঁধ ভাঙার গল্প। আবার রাশি রাশি হাসির মতো বকুল ফুল ফোটার গল্পও বলেছেন তার লেখনীতে। শুধু কি তাই? কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় লিখে গেছেন, ‘আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি।’ ‘হাসতে নাকি জানে না কেউ/ কে বলেছে ভাই/ এই শোন না কত হাসির/ খবর বলে যাই’—রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের লেখা এই কবিতা ছেলে-বুড়ো সবার কাছেই সমান প্রিয়। আবার সুকুমার রায়ের ‘আহ্লাদী’ কবিতাতেও হাসির গমকের কথা উঠে এসেছে। তবে হাসিবিহীন গোমড়া মুখের কথাও বলেছেন তিনি, ‘রামগরুড়ের ছানা’ কবিতায়। ‘আবোল তাবোল’ বইয়ে প্রকাশিত এই কবিতার ‘রামগরুড়ের ছানা/ হাসতে তাদের মানা/ হাসির কথা শুনলে বলে/ হাসব না না না না’—চারটি লাইন বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে বড্ড আপন!
হাসি নিয়ে যখন এত কথা হলো, একটি কৌতুক দিয়ে বরং সমাপ্তি টানি। একবার বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হেনরি মোশের বিমূর্ত চিত্র ‘লা বে’র প্রদর্শনী চলছিল নিউইয়র্কের এক মিউজিয়ামে। ছেচল্লিশ দিন ধরে সবাই একবাক্যে প্রশংসা করছিল ছবিটির। সাতচল্লিশতম দিনে শিল্পী নিজে এলেন দেখতে। কিউরেটর ছুটে এসে বললেন, ‘আপনার ছবি দেখে সবাই উচ্ছ্বসিত।’ হেনরি মোশে উদাস ভঙ্গিতে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘হবে হয়তো। কিন্তু ছবিটা কি শুরু থেকেই উল্টো ঝুলছে?’
 সুস্মিতা চক্রবর্তী মিশু
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top