ছুটিরঘণ্টা I উজবেকিস্তানে ঈদের দিনে
রূপ ছড়ানো এক রূপসী শহর। ভাঁজে ভাঁজে সাজানো ঐতিহ্যের বিবিধ মাধুর্য। কোরবানির ঈদের দিনে সেই শহরের অলিগলি ঘুরে এসে লিখেছেন ফাতিমা জাহান
রাতে ট্রেনে তেমন ঘুমাইনি। শুধুই মনে হচ্ছিল, এই বুঝি আমার স্টেশন চলে এলো আর আমি নামতে পারলাম না! সকাল ছয়টার দিকে আখেরি দফা ঘুম ভেঙে গেল। ট্রেন উজবেকিস্তানের খিভা শহরে পৌঁছবে সাতটায়। আমার ছিল ট্রেনের আপার বার্থ। তড়াক করে নেমে মুখ ধুয়ে এলাম। ট্রেনের অ্যাটেনডেন্ট চা পরিবেশন করছেন। চেয়ে চা নিলাম; সঙ্গে মুফতে দুটো মেরি বিস্কিটের মতো কিছু একটা পেলাম। আমার আশপাশের সিট খালি হয়ে গেছে এতক্ষণে। বোধ হয় সবাই নেমে গেছেন। খিভা এই রুটের শেষ গন্তব্য। আমার গেস্টহাউস থেকে গাড়ি পাঠিয়ে দেবে। তাই আপাতত চিন্তা নেই।
ট্রেন খিভায় পৌঁছাল সময়মতোই। উজবেকিস্তানের অন্যান্য রেলওয়ে স্টেশনের চেয়ে এটি বেশ ছোট। বের হতেই দেখি একজন আমার নাম লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। কাছে যেতেই খোশ আমদেদ জানালেন। চড়ে বসলাম গাড়িতে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে গেস্টহাউসে চলে এলাম।
আজ কোরবানির ঈদ। এই ঈদ এ দেশে কেমনভাবে উদ্যাপন করা হয়, তা দেখার জন্যই পড়ালেখা ফেলে, ইউনিভার্সিটি ফাঁকি দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে উজবেকিস্তান চলে এসেছি।
যে ছেলে আমাকে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এসেছেন, তিনিই নাকি গেস্টহাউসের মালিক, নাম হিকমাতুল্লা। রিসেপশনে বসে আছেন তার স্ত্রী সাবা। আমি তো অবাক। ঈদের দিন এরা গেস্টহাউস সামলাচ্ছেন! আমাকে বেশ কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখলেন। আমি অস্থির হয়ে উঠেছি—কখন রুমে যাব, নাশতা করে বেরোব। হিকমাতুল্লা একসময় এসে বললেন, ‘আপনার জন্য যে রুম বরাদ্দ ছিল, সেটিতে বিদ্যুৎ-সংযোগের একটু সমস্যা হয়েছে। আমরা আপনাকে আরেকটা গেস্টহাউসে পাঠাচ্ছি; কাছেই আমার ভাইয়ের গেস্টহাউসে। আজ ঈদ, তাই কোথাও সারাবার জন্য মিস্ত্রি পাওয়া যাবে না।’
এবারও হিকমাতুল্লা আমাকে গাড়ি করে নিয়ে চললেন। আমি এখন রয়েছি খিভার দেয়ালঘেরা শহর ইচান কালার ভেতরে। খিভায় যা দর্শনীয়, সবই আছে এখানে। এ জন্য আমিও খুঁজে পেতে দেয়ালে ঘেরা প্রাচীন শহরের মধ্যেই থাকব বলে ঠিক করেছি। ইচান কালার ভেতরে স্থানীয় লোকজন বসবাস করে আর তাদের ঘরে আমার মতো অতিথিদের সাদরে স্বাগত জানায়।
গাড়িতে বসেই হিকমাতুল্লাকে বললাম, ‘আজ কোরবানির ঈদ, আপনারা উৎসবে কিছু করছেন না, নাকি স্রেফ হোটেল সামলাচ্ছেন?’ জবাব দিলেন, ‘আমরা বাবা, মা, দুই ভাই একসঙ্গে আনন্দ উদ্যাপন করব।’
পাঁচ মিনিটের পথ। এর মধ্যেই হিকমাতুল্লা তার পরিবারের বৃত্তান্ত বলে ফেলেছেন। ওর বাবা-মা ইচান কালার বাইরে থাকেন। সাবা আর হিকমাতুল্লা নিজেদের পছন্দে বিয়ে করেছেন এক বছর আগে। বিয়ের পর বাবা তাকে আলাদা বাড়ি কিনে দিয়েছেন, আর এখন তিনি গেস্টহাউস ও ট্যুরিজম ব্যবসা করেন। পঁচিশ বছর বয়স্ক ছেলেটা খুব সরল। একনিশ্বাসে একজন অপরিচিতের সঙ্গে এত কথা বলে ফেললেন! এ দেশের সমাজব্যবস্থা সম্পর্কেও খানিক জানা হলো।
নতুন গেস্টহাউসে পৌঁছানোর একটু আগেই হিকমাতুল্লা আঙুল তুলে দেখালেন, ‘আপনি যা দেখতে চেয়েছিলেন, ওই দেখুন।’ অদূরে ইচান কালার দেয়ালের ভেতরে দুজন মিলে একটি ভেড়া জবেহ করছেন। হাজার বছর পুরোনো ইচান কালার পুরোটাই ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। আড়াই শ বাড়ি আর পঞ্চাশটির মতো হেরিটেজ সাইটের সমন্বয় ইচান কালাকে করেছে এক রাজসিক রাজধানী।
আমি রক্তপাত সহ্য করতে পারি না। তাই চোখ ফিরিয়ে নিলাম কোরবানির সেই দৃশ্য থেকে। এদের কারও বাড়িতেই প্রশস্ত আঙিনা নেই, তাই সরু পথ দেখে তার এক কোনায় কোরবানি দিচ্ছেন। হিকমাতুল্লাদের কোরবানি তাদের বাবার বাড়িতে হয়। কোরবানি হয়ে গেলে মাংস ওরা এখানে নিয়ে আসবেন।
হিকমাতুল্লার ভাইয়ের নাম সাদিউল্লা। নাক ফাটিয়ে বসে আছেন! মানে নাকে বড় এক ব্যান্ডেজ। বুঝলাম না কেউ ফাটিয়ে দিয়েছে, নাকি আঘাত লেগেছে। বউটি ভারি মিষ্টি; নাম মাহফুজা। দোতলায় আমার রুম দেখিয়ে দিলেন। ওদের বসার ঘরটি প্রশস্ত। ঢুলুঢুলু চোখে যতটুকু দেখা যায়, তা-ই দেখলাম। হিকমাতুল্লাও কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে রুম দেখিয়ে বললেন, ‘আজকে ঈদের দিন, আপনাকে এ বাড়ির সবচেয়ে ভালো রুমটি আমরা দিয়েছি। এই দেখুন।’ জানালার পর্দা সরিয়ে সামনের দৃশ্য দেখালেন তিনি। আমার যেন ঘোর কাটে না। সামনে টারকোয়েজ রঙের মিনার, পাশে সোনালি রঙা মসজিদ দাঁড়িয়ে। এখনো এই শহরের কিছুই দেখিনি, তবু জানালা দিয়ে এক অপূর্ব রূপ ধরা দিল। এ রকম দৃশ্য সামনে থাকলে রুমে বসেই সারা দিন কাটিয়ে দেওয়া যায়। হিকমাতুল্লা যাওয়ার আগে বলে গেছেন, নিচের খাবার ঘরে আমার জন্য নাশতা তৈরি আছে। তৈরি হয়ে নিচে নেমে খাবার ঘরে নাশতার আয়োজন দেখে থমকে গেলাম। আজ আমি ছাড়া আর কোনো অতিথি নেই এদের বাড়িতে, তা-ও দশ পদ দিয়ে নাশতা করানো আসলেই এলাহি কাণ্ড। এখানে তো মনে হচ্ছে আমিরি কায়দায় আমাকে স্বাগত জানানো হচ্ছে!
বাড়ির চৌহদ্দির ভেতরে পেছনের দিকে একচিলতে উঠোন। সেখানে টেবিল পাতা। এক পাশে উজবেকিস্তানের ঐতিহ্যবাহী খাটিয়ায় বসে খাওয়ারও ব্যবস্থা আছে। সে খাটিয়ায় কায়দা করে মশারি টানানো। মানে মশারির মতো বস্তু সাজানোর জন্য ঝুলিয়ে দুপাশের খুঁটিতে বাঁধা। প্রথমে ভেবেছিলাম ঘুমানোর জন্য অতি উত্তম ব্যবস্থা। পরে বুঝলাম, এটা অন্য ব্যাপার।
ঈদের দিন ঘরে ঘুমিয়ে কাটানোর মানে হয় না। তাই বেরিয়ে পড়লাম। হেঁটেই নাকি এ শহর ঘুরে দেখা সম্ভব। আমি একেবারে পশ্চিমের দিকে হাঁটতে থাকলাম। বাড়িঘর, দেয়াল বা পুরাকীর্তি—যা-ই চোখে পড়ে, সবই মাটি বা সোনালি রঙা। সরকার থেকে নিয়ম করে দেওয়া আছে, বাড়ির দেয়ালে মাটির প্রলেপ থাকতে হবে, বাড়ির রং হতে হবে পুরাকীর্তিগুলোর অভিন্ন রঙের। মানে মরুভূমির সোনালি রঙা। পাঁচ মিনিট হেঁটেই চলে এলাম ইচান কালার পশ্চিম গেটে। ঈদের দিন বলেই হয়তো আশপাশে মানুষ প্রায় নেই। আমাকে ইচান কালার বিভিন্ন স্থাপনা দেখার জন্য টিকিট কাটতে হবে। টিকিট ঘরে যিনি বসে আছেন, তার সঙ্গে ভাঙা ভাঙা ফার্সিতে কথা বলতেই খুব হেসে দিলেন।
ইচান কালার চার ধারে চারটি গেট। বাইরের দেয়াল দেখতে দুর্গের দেয়ালের মতো উঁচু ও পুরু। খানিকটা সোজা হয়ে গিয়ে আবার অর্ধবৃত্তাকার, আবার সোজা দেয়াল চলে গেছে। ইচান কালার পশ্চিম গেট দেখতে আমাদের উপমহাদেশের দুর্গের উঁচু প্রবেশদ্বারের মতোই ইসলামি স্থাপত্যকলা অনুসরণ করে নির্মিত। আমি দেরি না করে পশ্চিম গেটের ভেতরে ঢুকে সামনে পেলাম রেশম পথের ব্যবসায়ীদের কাফেলা। কেউ হেঁটে মরুভূমির পথ পার হচ্ছেন, কেউ বই পড়ছেন উটের পিঠে বসে; বইয়ে হয়তো পথের দিশা লেখা আছে অথবা সফরের ক্লান্তি বা একঘেয়েমি দূর করছে লেখাগুলো। এক উটের দুপাশে পানির বড় বড় ঘড়া বাঁধা, অন্য উটের পিঠে বাঁধা বিছানাপত্র। এই ছিল সে সময়কার মুসাফিরের জীবন ও সফর—যা ভাস্কর্য করে রাখা আছে প্রবেশ দুয়ারে। সিল্ক রোড বা রেশম পথের অংশ এই খিভা। এখান থেকে সিল্ক, মসলা নিয়ে যেতেন ব্যবসায়ীরা; তার পরিবর্তে বিক্রি করতেন সেই সব পণ্য, যা কিনতে চান এ অঞ্চলের বাসিন্দারা। এশীয় ও ইউরোপীয় বণিকদের কাফেলা থামত নগরে নগরে।
সামনের দৃশ্য ইচান কালার অতি চেনা কালতা মিনার। বলা যেতে পারে, খিভাকে বিশ্ব চেনেই এই মিনারের জন্য। ১৮৫২ সালে পাশের মোহাম্মদ আমিন খান মাদরাসা নির্মাণের সময় এই মিনার নির্মাণের কাজও শুরু হয়। খিভার তৎকালীন শাসক মোহাম্মদ আমিন খানের উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ও প্রশস্ত মিনার নির্মাণ করা এবং একই সঙ্গে তখনকার সুউচ্চ মিনার দিল্লির কুতুব মিনারকে টেক্কা দেওয়া। তবে মিনারটি নির্মাণ সম্পন্ন করে যেতে পারেননি এই আমির-এ-খিভা। ১৮৫৫ সালে তার ওফাত হলে কালতা মিনার অসম্পন্ন অবস্থায় রয়ে যায়। তবু মুসলিম জাহানের সে সময়কার সবচেয়ে উঁচু, প্রশস্ত ও রঙিন মিনার তিনিই নির্মাণ করে গেছেন। এটিই বিশ্বের একমাত্র মিনার, যার পুরোটা টাইলসে আবৃত। টারকোয়েজ বা নীলকান্তমণি রঙের ছোট ছোট টাইলস জুড়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে কালতা মিনার। একেবারে ওপরের দিকে কোরআনের আয়াত লেখা টাইলসে। এর নিচের ভাগে টারকোয়েজ রঙের টাইলস, নিচের ভাগে টারকোয়েজের বিভিন্ন শেডের টাইলস দিয়ে ক্রস নকশা করা। এর নিচে শুধু টারকোয়েজ রঙের ঢালাও টাইলস। এভাবে ধাপে ধাপে নেমে এসেছে রঙিন টাইলস। আগে মিনারের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি ছিল, এখন নেই। তাই এর পেছনের মোহাম্মদ আমিন খান মাদরাসার দিকে ঘুরে গেলাম।
দেখতে সামারকান্দ, বুখারার অন্যান্য মাদরাসার মতোই। প্রবেশমুখে বিশাল আকারের তোরণ। তোরণের উপরিভাগে গাঢ় নীল, ফিরোজা, সাদা রঙের টাইলসের কারুকাজ। তবে অন্যান্য শহরের টাইসের কারুকাজের চেয়ে তা বেশ ভিন্ন। খালি চোখে বোঝা যাচ্ছিল না। ছবি তুলে জুম করে দেখি, এখানে এলাহি কাণ্ড ঘটে গেছে! এত সূক্ষ্ম কারুকাজের নকশা আমি অন্য কোনো শহরে দেখিনি। খিভা শহরের বৈশিষ্ট্য তাহলে এ-ই। এখানেই খিভা এত অনন্য, এত রহস্যময়। শিল্পীর তুলি যতভাবে সূক্ষ্ম রাখা যায়, ততভাবেই একে ব্যবহারের উপযুক্ত করে তোলা হয়েছে। এ এক অনন্য রাজ্য, যেখানে শিল্প দেখতে গেলে ভেতরের সব অনুভূতিকে নিংড়ে দিয়ে চোখে মেখে নিতে হয়; চোখ দেখে নেয় কোনো এক জামানার এই রূপ!
মাদরাসার ভেতরের অংশ অন্যান্য মাদরাসার আদলের। ভেতরে এক টুকরো চার কোনা উঠোন আর তা ঘিরে প্রাচীরের মতো চারদিকে মাদরাসা কক্ষ। দোতলা এ মাদরাসায় এখন আর পড়ালেখা হয় না; বরং গড়ে উঠেছে একটি হোটেল। অর্থাৎ বহিরাঙ্গের আকার ও কারুকাজ অক্ষত রেখে মাদরাসার কক্ষগুলোকে হোটেল রুম করা হয়েছে। ভেতরের আঙিনায় আপাতত কেউ নেই। আমি ঘুরেফিরে দোতলায় চলে এলাম। টানা বারান্দার কক্ষগুলোর দরজার কাঠের কারুকাজের ওপর বার্নিশ চকচক করছে। মানে দরজাগুলো নতুন। বাকি সোনালি ইটের দেয়াল, নীল-সাদা টাইলস—সবই ১৮৫১ সালের। আমি নিচে নেমে এলাম। নিচে ততক্ষণে একজন ব্রিটিশ ছেলে আর এক চীনা মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আর আপনমনে মাদরাসার স্থাপত্য বিষয়ে ভুলভাল বকছেন শুনে আমি মাতব্বরি করতে এগিয়ে গেলাম! ওদেরকে বুঝিয়ে বললাম, কাকে বলে মিহরাব আর কীভাবে এই টাইলসে কারুকাজ করা হয়েছে। বন্ধুরা আমার এই স্বভাবকে বলে ফ্রি সোশ্যাল সার্ভিস। ছেলেটি এতক্ষণ হাঁ হয়ে শুনছিলেন। একসময় বললেন, ‘আপনি কি শিক্ষক?’ জবাবে ‘না, আমি যাযাবর’ বলে মাদরাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। হোটেলে রূপান্তরিত মাদরাসার প্রতি আমার আগ্রহ তেমন আর রইল না।
বাইরে কালতা মিনার রোদে নিজের গায়ে বিদ্যুৎ খেলাচ্ছে। এর পায়ের কাছে বসে দুজন বুজুর্গ বেশ খিলখিলিয়ে হেসে যাচ্ছে। বসে আছে খাটিয়ায়; পায়ের জুতি মেঝেতে রাখা। তামা রং মেখে এরা যে কত বছর ধরে খিলখিল করছে, জানা নেই। কারণ, ভাস্কর্যকে আমি কখনো নড়েচড়ে উঠতে দেখিনি।
কালতা মিনারের পায়ের কাছে এখন হরেক পণ্য সাজানো। আমার নজর একবার খিভার এই জাদুবন্দী কারুকাজে পড়েছে। পসার সাজিয়ে বসেছেন যারা, তাদের নির্দিষ্ট কোনো দোকান নেই। ইচান কালার পথের এক পাশেই টেবিল পেতে বসে গেছেন। একটি স্ট্যান্ডে খিভার নকশা করা গাঢ় নীল, ফিরোজা, আকাশি, সাদা চার কোনা টাইলস সারি সারি দাঁড় করানো। জাদুবন্দী কারুকাজ ছাড়াও নীল, পান্না সবুজ রঙের আস্ত ছোট ছোট দাবার গুটির মতো টাইলস রাখা। পাশে মেঝেতে রাখা চিনামাটির ওপর হাতে আঁকা সূক্ষ্ম কারুকাজের প্লেট, কাপ সেট, মিনিয়েচার পেইন্টিং ইত্যাদি।
দেয়ালঘেরা শহরের ভেতরের দেয়ালের পাশ দিয়ে আমি হেঁটে চললাম। গরমে পা আটকে যেতে চায়। আবহাওয়া শুষ্ক, তা-ও ছড়াচ্ছে হাওয়া। ইচান কালার মূল দেয়াল আসলে নির্মিত হয়েছিল ইটের গাঁথুনি আর মাটির প্রলেপে। দেয়ালের কিছু অংশ থেকে মাটির প্রলেপ সরে গেছে। খানিক হেঁটে একটি উঁচু দালানে ঢুকে পড়লাম। এটি বোধ হয় ইচান কালার একমাত্র দালান, যার কয়েকটি তলা রয়েছে। আমি উঁচু উঁচু সিঁড়ি কখনো হামাগুড়ি দিয়ে, কখনো বেয়ে বেয়ে একসময় ছাদে উঠে এলাম। আমার আগেই একদল ট্যুরিস্ট এখানে এসে পড়েছে। তিনতলা থেকে ইচান কালার সব গেট দেখা যায়। কাছের কালতা মিনারসহ আরও দুটি মিনার দেখা যাচ্ছে। একটি ছোট মিনারও আছে দেখছি। ৯৩ একরের এই ইচান কালার ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন ভবনের টারকোয়েজ রঙের গম্বুজ ঝলমল করছে।
একটু উঁচুতে বলে বেশ হাওয়া খেলছে চারপাশে। এখন কিছু চীনা ট্যুরিস্ট এসে কলকাকলি বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমি আসল পাখির খোঁজে তিনতলায় উঠেছি। মনে হলো, এই নকল পাখিদের ভিড়ে সেগুলো পালাবে! তাই হামাগুড়ি দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নামলাম।
অলিগলি পেরিয়ে কালতা মিনারের পথ ধরলাম আবারও। মিনারটির পাশের মাদরাসার সামনে কিছু বাদ্যযন্ত্র সাজিয়ে রাখা। দেখতে দোতারা, সেতার, ডাফলি ইত্যাদির মতো। একজন ভীষণ রূপসী বিক্রেতা দেখি এক ইউরোপীয়কে একটি বাদ্যযন্ত্র গছিয়ে দিচ্ছেন! আমার কৌতূহল অন্য জায়গায়। কী আছে এই মাদরাসায়—দেখার জন্য ভেতরে ঢুকে পড়লাম। এটি একসময় মাদরাসা হিসেবে ব্যবহৃত হলেও এখন সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রের মিউজিয়াম। প্রথম কক্ষে নানা ভাস্কর্য সাজানো। কয়েকজন পুরুষ পাশাপাশি কার্পেটের ওপর বসে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে। কেউ বাজাচ্ছে বাঁশি। পাশেরজন বাজাচ্ছে দুতোর বা দোতারা। আরেকজন ব্যস্ত এস্রাজ নিয়ে। আরেকজনের হাতে আরেক ধরনের বাঁশি। পাশের কক্ষে উজবেকিস্তানের প্রথম দিকের নৃত্যগীত শিল্পীদের ছবি বাঁধাই করে দেয়ালে ঝোলানো। সবচেয়ে সাহসী শিল্পী নুরখন, যাকে উজবেক নৃত্যগীতের পথিকৃৎ বলা হয়। তার পাশে ফ্রেমে বাঁধা আছেন তামারা খানুম, ওলমাখন খায়তোভা প্রমুখ গায়িকা। ছবি দেখে মনে হচ্ছে, এখানে নারীরাই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
আশপাশের স্থায়ী ও অস্থায়ী দোকানে এখন ধীরে ধীরে রং ধরছে, দোকান খুলছে। বিভিন্ন হস্তশিল্প, সিরামিক, টাইলসের জিনিসপত্রে রঙিন হচ্ছে সরু পরিচ্ছন্ন পথের দুধার। হঠাৎ আমার এ শহরকে রূপনগর বলে মনে হলো। বেশি ছড়ানো নয়, আবার ছোটও নয়। ধীরে ধীরে এখন রূপ খুলছে। সোজা পথ চলে গেছে জুমা মসজিদের দিকে। আরেক ধারের পথ গেছে আমার গেস্টহাউসের দিকে। আমি দাঁড়িয়ে মাঝের ফুলবাগানে। সেখানে ফুটে আছে নানা রঙের ফুল।
হেঁটে ইচান কালার একদম মাঝখানে চলে এলাম। জুমা মসজিদ সেখানে। এই মসজিদের মিনার বহু দূর থেকে দেখা যায়। ইচান কালায় আছেই সাকল্যে তিনটি মিনার। কালতা মিনার, জুমা মসজিদের মিনার আর ইসলাম খোজা মিনার—যা আমার গেস্টহাউসের জানালা দিয়ে দেখে এসেছি। জুমা মসজিদের মিনারটি খুব সাধারণ ইটে তৈরি। মাঝেমধ্যে এর গায়ে সমুদ্রাভ সবুজ রঙের টাইলস দিয়ে কয়েকটি দাগ কাটা। মিনারের একদম ওপরে ইট দিয়ে মুকারনা করা।
মসজিদটি প্রথম নির্মাণ করা হয়েছিল দশম শতাব্দীতে। এরপর প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও খিভা শহর আক্রমণের কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ১৭৮৮ সালে আবার মূল মসজিদের ওপর এই মসজিদ নির্মিত হয়। ভেতরে তখন ২১৫টি কাঠের স্তম্ভ এক লুকোচুরির দুনিয়া তৈরি করেছে। একতলা আর বেশ বড় এই মসজিদে চার পাশে চারটি দরজা; তবে কোনো জানালা নেই। তাই ভেতরটা বেশ অন্ধকার। কাঠের স্তম্ভগুলোর কয়েকটিতে ফুল-লতাপাতা খোদাই করা। কয়েকটি স্তম্ভের খোদাই ক্ষয়ে গেছে। কিছু স্তম্ভে খোদাই নেই। খুব সাধারণ মসজিদের সাধারণ চুনকাম করা মিহরাব। এক পাশে নারীদের নামাজ পড়ার জন্য কাঠের ফোল্ডিং করা খাঁজ কাটা দেয়ালের আড়াল করে দেওয়া। প্রায় ৫৫ বর্গমিটার আয়তনের এই মসজিদে এখন কেউ নেই। মিহরাবের সামনের অংশ ছাড়া অন্য কোথাও কার্পেট নেই। তার মানে এখানে যত মুসল্লির সমাগম ঘটে, ঠিক ততটুকু জায়গাতেই কার্পেট বিছানো থাকে। নাম জুমা মসজিদ, তাই জুমার নামাজেই বেশি মুসল্লির সমাগম ঘটে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মসজিদটি পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল জনসাধারণের নামাজ পড়ার জন্য। শহরের আমিরের নামাজ পড়ার জন্য আলাদা মসজিদ।
ততক্ষণে বিকেল হয়ে এলো। সূর্যের তেজ কমছে ধীরে ধীরে। হাঁটতে হাঁটতে ফিরে এলাম সাদিউল্লার বাড়িতে। আমার রুম থেকে আসলে ইচান কালার অনেকখানিই দেখা যায়। প্রতিবেশীর দোতলা বাড়িও দেখা যায়। সব বাড়ির দেয়াল, বাইরের দেয়াল মাটি দিয়ে লেপা। এক সোনালি রঙে ঢেকে রাখা হয়েছে এই শহর।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামল। বাইরে প্রচণ্ড গরম, তাই আর বের হতে ইচ্ছে করছিল না। নিচের আঙিনায় তখন উৎসব শুরু হয়ে গেছে। উঠোনে পাতা টেবিলে খাবার সাজাচ্ছেন সাবা, মাহফুজা। কয়েকজন দীর্ঘদেহী উজবেক নারী টেবিলের সঙ্গে পাতা চেয়ারে বসে আছেন। এই তাহলে এ দেশের ঈদ উদ্যাপন? দোতলা থেকে দেখতে খুব ভালো লাগছিল। একসময় হিকমাতুল্লা আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। আমি নারীদের মাঝে চেয়ার টেনে বসলাম। হিকমাতুল্লা আর কয়েকজন পুরুষ আঙিনার খাটিয়ায় বসা। সাবা সবার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। হিকমাতুল্লার মা, ফুফু, দাদি, নানি—সবাই আছেন এখানে। আরও আছেন সাবার মা। তাকে দেখে অবশ্য ওর বড় বোন ভেবেছিলাম। এত রূপসী আর কম বয়সী দেখতে! সে কথা বলতেই তিনি নড়েচড়ে বসে রুমালের সমান স্কার্ফটি ঠিক করে, জামাটা একটু টেনে আরও সুন্দরভাবে বসার চেষ্টা করলেন। তিনি একটি স্কুলে রুশ ভাষার শিক্ষক। আর এদিকে হিকমাতুল্লার ফুফু আমার প্লেটে কোরবানির মাংসের স্তূপ জমিয়ে যাচ্ছেন! এই মাংস সাবার মা রান্না করে এনেছেন। ভেড়ার মাংসের সাধারণ রান্না। শুধু পেঁয়াজ, আদা, রসুন দিয়ে মাংস সেদ্ধ করা হয়েছে বলে খাবারটি খুব স্বাস্থ্যসম্মত। বিশাল উজবেক রুটির চার ভাগের এক ভাগ দিয়ে খেলাম। টেবিল ভরা কী কী খাবার ছিল? কয়েক রকমের ফল দেখে আমার আনন্দ কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। কেক, কুকিজ, উজবেক মিষ্টি, কয়েক রকমের প্যাটিস, জুস…আরও কত কী যে সাবা এনে টেবিল ভরেছেন! আমি খেতে পারছি না, তবু ফুফু বলছেন, ‘আরেকটু খাও, এত অল্প খেলে হয় না!’
মাথার ওপর ছোট্ট একটি চাঁদও উঠে গেছে ততক্ষণে। হাওয়া ঠান্ডা হতে শুরু করেছে। ভিন দেশে, ভিন পরিবেশে, অচেনা অথচ যেন খুব আপন মানুষ ও শহরে ঈদের আনন্দ কয়েক গুণ বেড়ে গেল এভাবেই।
ছবি: লেখক