মনোযতন I স্বাস্থ্যভীতি সতর্কতা
ঈদের মৌসুমে খাদ্যভীতি হানা দিচ্ছে মনে? হেলথ অ্যাংজাইটির কারসাজি নয়তো? জানুন বিস্তারিত
‘সুস্বাস্থ্যই প্রকৃত সত্য; ধন সম্পদ কিংবা সোনা রুপার খনি নয়’—এমনটাই বলেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন থাকা স্বাস্থ্যকর। তবে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ ভালো কিছু নয়। কেননা, এমন অভ্যাস একজন মানুষকে ভীতির জগতে নিয়ে যায়। জানা কিংবা অজানা অসুখের ভয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। একই সঙ্গে বারবার রোগনির্ণয় করতে থাকেন এবং আতঙ্কগ্রস্ত হন। তাতে মনোজগতে হানা দিতে পারে হেলথ অ্যাংজাইটি।
রোগবিদ্যার ভাষায়
হেলথ অ্যাংজাইটি হলো স্বাস্থ্য নিয়ে এমন চিন্তা, যেখানে একজন ব্যক্তি কোনো উপসর্গ ছাড়াই নিজেকে গুরুতর অসুস্থ মনে করেন। কিংবা সামনে প্রাণঘাতী অসুখে আক্রান্ত হবেন—এমন মনোভাব পোষণ করেন। হেলথ অ্যাংজাইটিকে হাইপোকন্ড্রিয়া বা হাইপোকন্ড্রিয়াসিসও বলা হয়। যিনি স্বাস্থ্য নিয়ে অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন থাকেন, তাকে বলে হাইপোকন্ড্রিয়াক। সহজ ভাষায়, একে একধরনের উদ্বেগজনিত অসুস্থতা বলা হয়। এটি মূলত দীর্ঘমেয়াদি মানসিক অবস্থার কারণে হয়। কেউ কেউ এ ব্যাধিকে অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডারের (ওসিডি) সঙ্গেও তুলনা করেন। যেকোনো বয়সে এ ব্যাধি হতে পারে। চাণক্য বলেছিলেন, ‘প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত যা কিছু, তা-ই বিষ।’ সুতরাং প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্বাস্থ্য সংবেদনশীলতাও বিষের নামান্তর।
উদাহরণে স্পষ্টতা
ধরুন, আপনি অসুস্থ নন; তবে ক্রমাগত আপনার মনের আকাশে বেজে যাচ্ছে অসুখের সুর। অর্থাৎ আপনি ভাবছেন, শরীরের ভেতর হয়তো ক্যানসারের বীজ ধীরে ধীরে বাসা বাঁধছে, সামনের দিনে হয়তো হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হবেন, হয়তো কিডনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, মাথার ভেতর টিউমার হয়েছে, খুব অল্প পরিমাণে মিষ্টান্ন খেলে বুঝি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পায়ে পচন ধরে গেল, এই বুঝি আপনার প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে…ইত্যাদি। রাস্তায় বের হলে আপনি হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হবেন, কোষ্ঠকাঠিন্য হলে পাইলস হয়েছে ভেবে ভুল করা এবং তা থেকে মলদ্বারে ক্যানসার হতে পারে—এমন ভাবনাগুলোও হেলথ অ্যাংজাইটির লক্ষণ। ধরুন, গরুর মাংস খেলে আপনার অ্যালার্জি হয় না, কিন্তু আপনি মনে মনে ভীত হয়ে যাচ্ছেন এই ভেবে যে তা গ্রহণমাত্রই গুরুতর অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হবেন। এ রকম বিভিন্ন বিষয়ে আপনার অতিসচেতনতা বলে দেবে, আপনি হাইপোকন্ড্রিয়ায় আক্রান্ত। ছোটখাটো শারীরিক অসুস্থতাকে বিশাল পরিসরে গণ্য করেন। একই সঙ্গে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন।
বিশেষজ্ঞ বয়ান
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের ডিন এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী জানান, যেকোনো বিষয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, ভীতিকে হাইপোকন্ড্রিয়া বলে। এটি মনের একটি অবস্থা, যা তার স্বাস্থ্যেও বিরূপ প্রভাব ফেলে। হাইপোকন্ড্রিয়াতে আক্রান্ত ব্যক্তি স্বাস্থ্য ছাড়াও অন্য যেকোনো বিষয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ও ভীত থাকেন। এ ধরনের মানসিক অবস্থা যার মধ্যে গড়ে উঠেছে, তাকে মনোচিকিৎসকের কাউন্সেলিং নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এই বিশেষজ্ঞ।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও সাইক্রিয়াট্রিস্ট ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ জানান, হেলথ অ্যাংজাইটি হলো একধরনের অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার। এটি যে কারও হতে পারে। এ রোগে যারা আক্রান্ত হন, তারা সব সময় মনে করেন, তাদের স্বাস্থ্যগত কোনো সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে তাদের ধারণা, মরণঘাতী রোগ হয়েছে। ফলে পেটসহ সারা শরীরে অস্বস্তি অনুভব করেন।
অ্যাংজাইটি বনাম হেলথ অ্যাংজাইটি
বিভিন্ন অসুস্থতা যেমন মাথাব্যথা, পেটব্যথা, অবসাদগ্রস্ততা, দ্রুত হৃৎস্পন্দন, হাত-পায়ের পেশিতে টান ইত্যাদি হলে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক। এর মানে আপনার উপসর্গগুলো সঠিক। মনের এই অবস্থাকে অ্যাংজাইটি হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। চিকিৎসায় সেরে ওঠে এসব। যদি শারীরিক উপসর্গ না থাকে কিংবা স্বল্প উপসর্গকে পাহাড় সমান বিশাল মনে করেন, তাহলে এটি হেলথ অ্যাংজাইটির মধ্যে পড়ে। চিকিৎসক আশ্বস্ত করলেও হেলথ অ্যাংজাইটিতে ভোগা ব্যক্তি অনেক সময় স্বাভাবিক হতে পারেন না; বরং বারবার অসুখ নিয়ে ভাবতে থাকেন; গুগলে খুঁজতে থাকেন পুনরায় অসুখের উপসর্গ। অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অতি সচেতন হলে, সেটিও হেলথ অ্যাংজাইটির মধ্যে পড়বে। এটি শুধু বাবা-মা নন, যেকোনো বয়সের সন্তানদের মধ্যেও দেখা দিতে পারে।
বোঝার উপায়
আকাশ মেঘ-কালো হলে যেমন বোঝা যায়, একটু পর ঝুম বৃষ্টি নামতে পারে, তেমনি কিছু মানসিক অবস্থা দেখে বোঝা যাবে, কোনো ব্যক্তি হাইপোকন্ড্রিয়ায় আক্রান্ত কি না। যেমন গুরুতর শারীরিক অবস্থা নিয়ে বেশি ভাবা; ক্ষুদ্র অসুস্থতাকে গুরুতর মনে করা; শারীরিক উপসর্গ নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত থাকা; সম্ভাব্য অসুস্থতা নিয়ে দুশ্চিন্তা করা; সামান্য উপসর্গ দেখা দিলে বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা; স্বাস্থ্যের ক্ষতির কারণে বন্ধু, আত্মীয় ও বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে দেখা না করা এবং তাদের কাছ থেকে দূরে থাকা; নিজের স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে বারবার দুশ্চিন্তা করা; ইন্টারনেটে অসুস্থতাজনিত বিষয়গুলো অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট রোগের উপসর্গ, নিরাময় ইত্যাদি বারবার খোঁজা। হেলথ অ্যাংজাইটিতে ভোগা ব্যক্তি একধরনের ট্রমাটিক অবস্থায় দিনাতিপাত করেন।
বংশগত বালাই?
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, যেকোনো ধরনের অ্যাংজাইটি পরিবারের কারও থাকলে তা অন্যজনের হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সে ক্ষেত্রে হেলথ অ্যাংজাইটি থাকলে বংশের অন্যদেরও তা হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবে এ রোগ যে হবেই, তা নিশ্চিত নয়। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ মতো হাইপোকন্ড্রিয়া সে রকমভাবে বংশগত নয়। বাবা-মা, দাদা-দাদি কিংবা পূর্বপুরুষের হেলথ অ্যাংজাইটি কিংবা হাইপোকন্ড্রিয়া থাকলেও পরবর্তী প্রজন্মে এটি জিনগতভাবে ছড়াবেই—তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তার মানে ছড়াতেও পারে, না-ও পারে। যদি ব্যক্তি নিজে থেকে মানসিক এই অবস্থার মধ্য দিয়ে যান, তাহলে তিনি এ ব্যাধিতে আক্রান্ত হবেন। এর জন্য আক্রান্ত ব্যক্তির অতি সংবেদনশীলতা অনেক ক্ষেত্রে দায়ী।
ওসিডির সঙ্গে সংযোগ
ওসিডিতে আক্রান্ত ব্যক্তি যুক্তিহীন অবসেশন এবং কম্পালসিভ বিহেভিয়ারের চক্রে আটকা পড়েন। তারা নিজের বা অন্যের ক্ষতি হতে পারে কিংবা শরীর-কাপড় বা আসবাবে জীবাণু কিংবা ময়লা লেগে আছে—এমন অহেতুক চিন্তা বারবার করেন; যৌনতাবিষয়ক ঘোরে ভোগেন; রান্নাঘরের চুলা বন্ধ করা কিংবা দরজায় তালা লাগানো হয়েছে কি না—এ ধরনের চিন্তা বারবার করতে থাকেন; জীবাণু ও দূষণের ভয়ে বারবার হাত পরিষ্কার করেন। মূলত একধরনের মানসিক সমস্যার বশবর্তী হয়ে নানান কাজ করেন তারা। আবার হেলথ অ্যাংজাইটিতে আক্রান্তরাও একই চিন্তা, একই কাজ বারবার করতে থাকেন। ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যখন হেলথ অ্যাংজাইটি একজন ব্যক্তির মধ্যে বারবার দেখা দেয়, যখন তিনি বারবার চিকিৎসকের কাছে হাজির হন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা অর্থাৎ নিজের স্বাস্থ্য বারবার চেক করেন, নিজেকে পরিবর্তনের চেষ্টা চালান, একবার-দুবার চেক করেও তৃপ্ত হন না, তখন এই আচরণ ওসিডির পর্যায়ে চলে যায়।’
ফোবিয়ায় ফারাক
অনেকে উঁচু বিল্ডিংয়ে কিংবা ছাদে উঠলে ভয় পেয়ে যান। তাদের হাত-পা কাঁপতে শুরু করে। অনেকে আবার লিফটে উঠলে মৃত্যুভয়ে শিউরে ওঠেন। এগুলো ফোবিয়ার লক্ষণ। ফোবিয়াও উদ্বেগজনিত ব্যাধি; যা হলে ব্যক্তি অমূলক ও ভিত্তিহীন ভয় পেয়ে থাকেন। হেলথ অ্যাংজাইটিও ফোবিয়ার মতো অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার। তবে এটি সরাসরি ফোবিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। অবশ্য কারও কারও ক্ষেত্রে একধরনের অ্যাংজাইটি থাকলে আরেক ধরনের অ্যাংজাইটি হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
নিরাময়ের উপায়
হেলথ অ্যাংজাইটি নিরাময়যোগ্য। শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে আপনাকে যেমন ওষুধ সেবন করতে হবে, ঠিক এই অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার নিরাময়ে সাইকোথেরাপি কিংবা কাউন্সেলিং নেওয়া চাই; বিশেষ করে সিভিটি (কগনিটিভ বিহেভিয়েরাল থেরাপি) কাউন্সেলিং। এ ক্ষেত্রে যত্রতত্র না গিয়ে বিশেষজ্ঞ সাইকোলজিস্ট অথবা সাইকোথেরাপিস্টের শরণাপন্ন হওয়াই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। আক্রান্ত ব্যক্তিকে হেলথ অ্যাংজাইটি বিষয়টি সম্পর্কে ব্যাখ্যা নিতে হবে। পাশাপাশি বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে চিকিৎসকের প্রেসক্রাইব করা ওষুধ গ্রহণ করা চাই। তবেই আক্রান্ত ব্যক্তির মনের আকাশের কালো মেঘ দ্রুত কেটে যাবে।
রিক্তা রিচি
ছবি: ইন্টারনেট