দৃশ্যভাষ্য I রূপকথা রিলোডেড
খোলা আকাশের নিচে একপাল হাতি। সামনে মনোহর দেহশোভা ছড়িয়ে দাঁড়ানো এক রূপসী। যেন রূপকথার চিত্রায়ণ
বিংশ শতাব্দীর ফ্যাশন ম্যাগাজিনগুলোতে যত ছবি ছাপা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অনেকের বিবেচনায় সবচেয়ে স্মরণীয় ও আলোচিত ছবির শিরোনাম ‘ডভিমা উইদ এলিফ্যান্টস’। আমেরিকান মান্থলি উইমেন’স ফ্যাশন ম্যাগাজিন হারপার’স বাজার-এর সেপ্টেম্বর ১৯৫৫ সংখ্যায় প্রকাশিত। তাতে দেখা যায়, প্রখ্যাত ফরাসি ফ্যাশন ডিজাইনার ইভ সাঁ লরাঁর [১৯৩৬-২০০৮] নকশা করা, ফরাসি বহুজাতিক বিলাসবহুল ফ্যাশন হাউস দিওর-এর গাউন পরে যেন এক রাজকন্যা মার্জিত ও নাটকীয় ভঙ্গিমায় নিজের জাদুকরি সৌন্দর্য ছড়িয়ে পোষ মানিয়েছেন স্থলভাগের সবচেয়ে বড় জন্তু—হাতিগুলোকে। এ যেন রূপকথার বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট, অর্থাৎ রূপসী ললনা ও বুনো জন্তুর আবেগাত্মক রসায়নের অন্য রকম নিদর্শন! বলে রাখি, এই রূপসী আমেরিকান সুপারমডেল ডরোথি ভার্জিনিয়া মার্গারেট জুবা [১৯২৭-১৯৯০]। নামের প্রথম তিন শব্দ থেকে ইংরেজি দুটি করে অক্ষর নিয়ে, ডভিমা নামেই খ্যাত ছিলেন। গেল শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে কাঁপিয়েছেন ফ্যাশন দুনিয়া। শুধু তা-ই নয়, নাম হিসেবে একটিমাত্র শব্দ ব্যবহারকারী প্রথম মডেলও তিনি। অন্যদিকে, এই ছবি তুলেছেন তারই স্বদেশি প্রখ্যাত ফ্যাশন ও পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফার রিচার্ড অ্যাভেডন [১৯২৩-২০০৪]। আর ছবিতে জায়গা করে নেওয়া হাতিগুলো একটি সার্কাসের পোষা প্রাণী। ছবিটি প্যারিসে তোলা।
অর্ধশতকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ‘ডভিমা উইদ এলিফ্যান্টস’ এখনো ফ্যাশন দুনিয়ায় নিত্য আলোচনায়। কী এমন মহিমা একে এমন দীর্ঘায়ু দিয়েছে? আসলে এতে ওত কতুর ও মেলোড্রামা সঙ্গী করে জড়িয়ে রয়েছে ফ্যাশন ফেইরি টেল ও ট্র্যাজিক আমেরিকান ড্রিমের অন্তরস্পর্শী গল্প!
জুবার জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের কুইন্স অঞ্চলে। পোলিশ-আমেরিকান পুলিশ বাবা এবং আইরিশ মায়ের সন্তান। অল্প বয়সে আক্রান্ত হয়েছিলেন বাতজ্বরে। সে সময়ে এ রোগে আক্রান্তদের আরোগ্যের জন্য পুরো এক বছর বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নেওয়ার চল ছিল। কিন্তু মায়ের উৎকণ্ঠার কারণে তাকে বিছানায় কাটাতে হয়েছিল টানা সাত বছর। সেই দিনগুলোতে ঘরে বসেই পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। আর তার সঙ্গী হয়েছে চিরস্থায়ী শারীরিক দুর্বলতা। এ সময়ে মাঝেমধ্যেই ছবি আঁকতেন।
২০ বছর বয়সে ডভিমার জীবন পাল্টে যায়। নিউইয়র্কের লেক্সিংটন অ্যাভিনিউতে তাকে পাকড়াও করেন একজন ফ্যাশন এডিটর। সেদিন বিকেলেই তার একটি ফটোশুট করানো হয়। পরদিন আবারও ডাকা হয় ছবি তোলার জন্য। এবার ডাকেন প্রখ্যাত ফ্যাশন ফটোগ্রাফার আরভিং পেন [১৯১৭-২০০৯]। সেই সব ছবিতে মুগ্ধ হয়ে পড়েন ফ্যাশনবোদ্ধারা; বিশেষত তার হাসির জন্য। যেন সত্যিকারের মোনালিসার খোঁজ পেয়ে গেছেন! আর তার সেই মোনালিসাতুল্য হাসি ১৯৫০-এর দশকজুড়ে হাই ফ্যাশনে নিরন্তর জায়গা করে নেয়।
শুধু এই হাসিই তার সম্বল ছিল না; অ্যাভেডন একসময় তাকে ঘিরে বলেছিলেন, ‘তিনি ছিলেন মার্জিত, বনেদি সৌন্দর্যের শেষ উদাহরণ!’ এমনকি অনেকের বিবেচনায় ইতিহাসের অভিনব সৌন্দর্যের সেরা দেবী হিসেবে খ্যাত প্রাচীন মিসরীয় রানি নেফারতিতির [১৩৭০-১৩৩০ খ্রিস্টপূর্ব] সঙ্গে তাকে তুলনা করেছিলেন ওই আলোকচিত্রী। ফটোগ্রাফার-মডেল হিসেবে অ্যাভেডন-ডভিমা সম্পর্কটি ফ্যাশন ফটোগ্রাফির ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি প্রেরণা-উদ্দীপক সম্পর্কগুলোর অন্যতম হিসেবে বিবেচিত। ডভিমা সম্পর্কে একবার অ্যাভেডন আরও বলেছিলেন, ‘তিনি হলেন তার সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অপ্রচলিত রূপসী’। এই ফটোগ্রাফারের প্রতি এই মডেলের অনুরাগও ছিল একই রকম; বলেছিলেন, ‘মানসিকভাবে আমরা দুজন যেন সিয়ামিজ টুইনের [এক দেহে জোড়া লেগে থাকা যমজ] মতো হয়ে উঠেছিলাম; ফলে, তিনি আমাকে বলার আগেই বুঝতে পারতাম কী চাইছেন। (‘ডভিমা উইদ এলিফ্যান্টস’ তোলার সময়ে) আমাকে তিনি বিস্ময়কর কিছু করতে বলেছিলেন; তবে আগেই বুঝে গিয়েছিলাম, আমি একটি অসামান্য আলোকচিত্রের অংশ হতে যাচ্ছি।’
অন্যদিকে, ছবিটির আইডিয়া সম্পর্কে ফটোগ্রাফারের ভাষ্য, ‘বিশাল আকাশের নিচে হাতিগুলোর দেখা পেয়েছিলাম আমি। এবার আমার কাজ ছিল সঠিক পোশাক বেছে নেওয়া; আর জানতাম, এখানে একধরনের স্বপ্নতুল্য আলোকচিত্র তোলা সম্ভব।’
এই আলোকচিত্রের মাধ্যমে ফ্যাশন ইতিহাসে পাকাপোক্ত জায়গা করে নিলেও ডভিমার জীবনে ট্র্যাজেডি ছিল অপেক্ষমাণ। ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকার দিনগুলোতে, যখন গড় সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক ছিল ঘণ্টাপ্রতি ২৫ ডলার, তিনি হাঁকাতেন ৬০ ডলার! তাতেও ব্যস্ততা এতটুকু কমছিল না তার; বরং অনেকে তাকে ডলার-আ-মিনিট গার্ল নামে ডাকতেন। এমনকি রুপালি পর্দায়ও নাম লিখিয়েছিলেন; অভিনয় করেছিলেন ১৯৫৭ সালের হিট ফিল্ম ফানি ফেস-এ। তাতে সহশিল্পী অড্রে হেপবার্ন। কিন্তু সেই দাপট বেশি দিন টেকেনি। ষাটের দশকের শুরুতে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে থাকে তার ক্যারিয়ার। পরের দশকে নিউইয়র্ক ছেড়ে ফ্লোরিডায় পাড়ি জমান, বাবা-মায়ের সঙ্গে বসবাসের জন্য। আর ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকেন পাদপ্রদীপের আলো থেকে। এমনকি, ১৯৯০ সালে অনেকটাই অগোচরে মৃত্যুবরণের আগে, স্থানীয় একটি পিৎজ্জা শপে খাদ্য পরিবেশিকা হিসেবেও কাজ করতে হয়েছে ডভিমাকে!
সে যাক! আলোচ্য ছবিটিতে ডভিমার পরনে যে পোশাক ছিল, সেটি দিওর-এর হয়ে ডিজাইনার লরাঁর প্রথম কাজ। তার বয়স তখন ১৯। অবশ্য এর এক বছর আগে থেকেই হাউসটিতে কাজ করছিলেন; তবে ছোট ছোট প্রজেক্টে। হাউস অব দিওর-এর কতুর কালেকশনের জন্য আরও কিছু নকশার সঙ্গে এটিও জমা দিয়েছিলেন; আর এটির জন্য পেয়েছিলেন সবুজ সংকেত। পরবর্তীকালে তিনি দিওর-এর হেড ডিজাইনার এবং নিজ নামে ব্র্যান্ড [ওয়াইএসএল] গড়ে তোলেন। তবে তার ক্যারিয়ার বিকাশে এই পোশাকের ছিল অপরিসীম ভূমিকা, বলা বাহুল্য।
এদিকে, ২০১০ সালে প্যারিসে নিলাম প্রতিষ্ঠান ক্রিস্টি আয়োজিত ‘অ্যাভেডন: ফটোগ্রাফস ফ্রম দ্য রিচার্ড অ্যাভেডন ফাউন্ডেশন’ শীর্ষক নিলামে জায়গা করে নেয় ‘ডভিমা উইদ এলিফ্যান্টস’। তাতে ১১ লাখ ৫৩ হাজার ১১ ডলার দাম ওঠে ছবিটির, যা ছিল তখন পর্যন্ত এই আলোকচিত্রীর তোলা কোনো ছবির সর্বোচ্চ দামের রেকর্ড। সেই রেকর্ডও ভেঙে গেছে এক দশক পরে। ২০২০ সালে নিউইয়র্কে ক্রিস্টি আয়োজিত ‘ওয়ান: আ গ্লোবাল সেল অব দ্য টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি’ শীর্ষক নিলামে ছবিটির দাম ওঠে ১৮ লাখ ১৫ হাজার ডলার! এভাবে এই আলোকচিত্র আক্ষরিক ও নিগূঢ়—উভয় অর্থেই ফ্যাশন দুনিয়ার মহামূল্যবান সম্পদ হিসেবে পরিণত।
দায় স্বীকার:
ভ্যানিটি ফেয়ার; আর্ট নেট; দ্য আর্ট ইনস্টিটিউট অব শিকাগো
লাইফস্টাইল ডেস্ক