দেহযতন I কোলেস্টেরল সামাল
এই ঈদের মৌসুমে না চাইলেও উচ্চ কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার খাওয়া হয়ে যায় অনেক সময়। তাতে শরীরে হানা দিতে পারে নানা বিপত্তি। তবে রক্ষার আছে উপায়। করা চাই যথাযোগ্য কসরত
কোলেস্টেরল। শরীরে কোষ, ভিটামিন ও হরমোন তৈরি করতে এবং কিছু চর্বিযুক্ত খাবার হজমে সাহায্যকারী। তবে উচ্চমাত্রার মন্দ কোলেস্টেরল (এলডিএল) হতে পারে বিপজ্জনক। এর কারণে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যসমস্যায় পড়তে পারেন যে কেউ। বিশেষজ্ঞ মতে, মানুষের দেহে দুটি প্রধান ধরনের কোলেস্টেরল রয়েছে। এলডিএলের কথা তো জানলামই; অন্যটি ভালো কোলেস্টেরল (এইচডিএল)। কেউ যখন কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানোর কথা বলেন, তারা মূলত এলডিএলকেই বোঝান।
নিয়মিত ব্যায়াম কোলেস্টেরল ও স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে কাজে দেয়। এ ক্ষেত্রে দ্রুত হাঁটা, দৌড়ানো, সাইক্লিং ও রেজিস্ট্যান্স ট্রেনিং হতে পারে দারুণ ফিজিক্যাল অ্যাকটিভিটিজ। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের (এএইচএ) মতে, সপ্তাহে ন্যূনতম ১৫০ মিনিট মাঝারি তীব্রতার ব্যায়াম করলে মন্দ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে আসে।
নিয়মিত ব্যায়াম ফিট ও সুস্থ থাকার এবং শরীরে এলডিএল কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমানোর উপযুক্ত উপায়। এ ক্ষেত্রে উপকারী এমন কিছু ব্যায়ামের দিকনির্দেশনা জানা যাক সার্টিফাইড ফিটনেস ট্রেইনার সাদিয়া শীলার কাছ থেকে:
হাঁটা
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে চিকিৎসকেরা অনেক রোগীকেই নিয়মিত হাঁটার পরামর্শ দেন। ফিটনেস ধরে রাখতেও এর যেন বিকল্প নেই। হাঁটলে হার্ট ভালো থাকে। হাঁটা কোলেস্টেরল ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে। পেশি করে তোলে মজবুত। নিয়মিত হাঁটার ক্ষেত্রে কিছু টিপস অনুসরণ করলে ভালো ফল পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
নিজেকে অতিক্রম: শুরুতেই হেঁটে বহুদূর পাড়ি দেওয়ার পরিকল্পনা না করাই ভালো; বরং নিজের স্বাভাবিক গতিতেই হাঁটুন। এক কিলোমিটার যেতে যদি ২০ মিনিট লাগে, তাহলে পরবর্তী দিন থেকে চেষ্টা করুন সেই দূরত্ব ১৫ মিনিটে অতিক্রম করার। এভাবে প্রতিদিন ধীরে ধীরে হাঁটার গতি বাড়াতে থাকুন।
জুতা-বিলাস: আরামদায়ক জুতা হাঁটার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দ্রুত হাঁটতে চাইলে স্টাইলের দোহাইয়ে যেকোনোটি নয়, বরং পায়ের জন্য সঠিক মাপের নিচু জুতা পরুন।
ট্র্যাকের মূল্য: যারা নিয়মিত হাঁটেন, তাদের কাছে ফিটনেস ট্র্যাকার বেশ জনপ্রিয়। হাঁটার সময় ট্র্যাকার অন রাখুন। তাতে আপনি কত স্টেপ ফেলছেন, কতটুকু পথ অতিক্রম করছেন এবং কত ক্যালরি পুড়ছে—সবই জানতে পারবেন। এটি আপনার ব্যায়ামের রুটিন ঠিক করতে কাজে দেবে।
পর্যাপ্ত বিশ্রাম: নিয়মিত হাঁটা একটি শারীরিক পরিশ্রম। তাই সপ্তাহে এক দিন এই চর্চাকে ছুটি দিন। সাপ্তাহিক বিরতিতে বিশ্রাম নিন। এতে শরীর পরবর্তী ব্যায়ামের জন্য আরও কার্যক্ষম হবে।
দৌড়
ফিট হতে, ওজন কমাতে এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে দৌড় উপকারী। রক্তে এলডিএল কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমাতেও কাজে দেয়।
সঙ্গী সন্ধান: একা দৌড়ানো অনেক সময় ঝামেলার হয়ে পড়ে। তাই শুরুর দিকে অভ্যাস গড়ে তুলতে আশপাশে নিয়মিত দৌড়ান—এমন কারও সঙ্গ নিতে পারেন। চাইলে পরিবারের কাউকেও করতে পারেন রানিং-পার্টনার।
রানিং ক্লাব: দলবেঁধে দৌড়ানোর আনন্দ দারুণ। তাই নিয়মিত দৌড়ানোর চর্চা করে—এ রকম কোনো রানিং ক্লাবে যোগ দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে তাদের সঙ্গে দৌড়াতে পারেন। এতে আপনি বাকি রানারদের কাছ থেকে টিপস নিতে এবং একটি বৃহত্তর কমিউনিটির অংশ হতে পারবেন।
বিরতির হিসাব: অনেক সময় নানা কারণে দৌড়াতে ইচ্ছা করে না। সেই দিনগুলোতে আপনি না-ই দৌড়াতে পারেন। তবে একটানা বেশি দিন দৌড়ানোর অভ্যাস বন্ধ রাখলে আলসেমি পেয়ে বসতে পারে। তাই বিশেষ কারণ বাদে প্রথম প্রথম নিয়মিতই দৌড়ানো উচিত। অন্যদিকে, কোনোমতেই টানা তিন-চার দিন দৌড়ানো বন্ধ রাখা কাজের কথা নয়।
ট্রেডমিল ট্রেন্ড: বাইরে দৌড়ানো অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে বাসায় একটি ট্রেডমিল কিনে আনতে পারেন। তাতে ইচ্ছেমাফিক সময়ে দৌড়-চর্চার সুবিধা পাবেন।
সাউন্ড ট্র্যাক: দৌড়ানোর সময় শুনতে পারেন পছন্দের গান, মিউজিক কিংবা পডকাস্ট। সেদিকে মনোযোগ দেওয়ার কারণে ক্লান্তি সাময়িকভাবে কম অনুভূত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে; দেহ-মন থাকবে চনমনে।
পরিবার-যোগ: অনেকে নিজের ছোট ভাই, সন্তান অথবা পরিবারের শিশুদের নিয়ে বিকেলে বাইরে বের হন। এই সময়ে দৌড়ানোর অভ্যাস গড়ে তুললে মন্দ হয় না। বাচ্চাকে সাইকেল চালানো শিখিয়ে তার পাশে দৌড়াতে পারেন।
দৌড়ানোর সময় কিছু বিষয় খেয়াল রাখা চাই—
পানি পান: দৌড়ানোর কারণে নিজেকে ডিহাইড্রেটেড লাগতে পারে। তাই পর্যাপ্ত পানি পান করুন। তা ছাড়া সারা দিন নিয়মিত বিরতিতে পরিমাণমতো পানি গ্রহণের অভ্যাস গড়ে তুলুন।
পুষ্টিকর খাবার: দৌড়ানোর কারণে শরীরে কিছু বিশেষ পুষ্টিকর খাবারের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। কোনো পুষ্টিবিদের সঙ্গে কথা বলে নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী খাবার গ্রহণ করুন। এ ক্ষেত্রে সাধারণত প্রোটিন জাতীয় খাবার বেশি খেতে বলা হয়।
ওয়ার্মআপ এক্সারসাইজ: ইনজুরি এড়াতে দৌড় শুরুর আগে অল্প কিছু ব্যায়াম করে নিন। যেমন কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে নিতে পারেন।
গতি নিয়ন্ত্রণ: অনেকে শুরুতে আচমকা বেশি গতিতে দৌড়াতে থাকেন কিংবা ধীরগতিতে শুরু করে হঠাৎ মাত্রাতিরিক্ত গতি বাড়িয়ে ফেলেন। উভয়ই বিপজ্জনক! বরং ধীরে ধীরে, ক্রমান্বয়ে গতি বাড়ানো ও কমানো শ্রেয়।
দৌড়ানোর জন্য দরকারি কিছু অনুষঙ্গ—
রানিং শু: দৌড়ানোর উপযোগী বিশেষ কিছু জুতা পাওয়া যায়। রানিং শু নামে পরিচিত। আপনি এক জোড়া ভালো জুতা ব্যবহার করে দৌড়ালে ইনজুরিতে পড়ার ঝুঁকি অনেকটা লাঘব হবে।
কস্টিউম সেন্স: দৌড়ানো একটি কার্ডিও এক্সারসাইজ। এতে আপনার দেহ থেকে বেশ তাপ বের হয়। এ ক্ষেত্রে বাতাস প্রবাহযোগ্য ট্রাউজার ও টি-শার্ট বেশ কাজের। সাধারণত জার্সি কাপড়গুলো বাতাস প্রবাহ উপযোগী।
স্মার্ট ডিভাইস: দৌড়ানোর সময় নিজের হার্ট-রেট, গতি, সময় এবং দূরত্ব পরিমাপের জন্য স্মার্ট ওয়াচ কিংবা স্মার্ট ব্যান্ড ব্যবহার করতে পারেন।
সাইক্লিং
এলডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানোর আরেকটি কার্যকর উপায়। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সাইকেল চালিয়ে কাজ করেন, তাদের উচ্চ কোলেস্টেরল হওয়ার ঝুঁকি কম। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকিও কমে। বসে, দাঁড়িয়ে ও পেটের ওপর ভর দিয়ে সাইক্লিং করা যায়। সাদিয়া শীলার পরামর্শ, নিজের শক্তির ওপর নির্ভর করে শুরুর দিকে টানা ৫ থেকে ১৫ মিনিট কিংবা তারও বেশি সময় ধরে সাইক্লিং করতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে প্রতি ২ মিনিট দ্রুতগতির পর ১ মিনিট ধীরলয়ে সাইক্লিং করা উত্তম।
রেজিস্ট্যান্স ট্রেনিং
রেজিস্ট্যান্স ট্রেনিং পেশি শক্তি বাড়ায়। অনেকে একে ওয়েট ট্রেনিংও বলেন। এতে ওজনের ব্যবহার অন্তর্ভুক্ত থাকে; যেমন ডাম্বেল বা কেটলবেল, ওজন মেশিন। সাদিয়া শীলার মতে, খুব সাধারণ ও প্রচলিত রেজিস্ট্যান্স ট্রেনিং হলো—
পুশআপ: শরীরের ওজন ও শক্তির দিকে খেয়াল রাখুন। পুশআপগুলো বুক, বাহু ও অ্যাবসের জন্য উপকারী। শুরুর দিকে ১০ থেকে ১৫টি পুশআপের চেষ্টা করুন।
ক্রাঞ্চ: আপনার পেটের পেশি শক্তিশালী এবং টোন করার পাশাপাশি কোলেস্টেরল কমানোর জন্য ক্রাঞ্চ একটি দুর্দান্ত ব্যায়াম। নতুনদের জন্য ক্রাঞ্চগুলো কীভাবে করবেন, সে সম্পর্কে কিছু পরামর্শ—
১. হাঁটু বাঁকানো এবং পা মাটিতে সমতল রেখে একটি মাদুরের ওপর পিঠে ভর দিয়ে শুয়ে থাকুন।
২. হাত মাথার পেছনে কিংবা বুকের সামনে জড়ো করে রাখুন।
৩. অ্যাবস সংকুচিত করে মূল পেশিগুলোর ওপর জোর দিন এবং কাঁধ ও পিঠের ওপরের অংশ মেঝে থেকে ওপরে তুলুন। এ সময়ে পিঠের নিচের অংশটি মাদুরের সংস্পর্শে রাখা চাই।
৪. ওপরে ওঠার সময় শ্বাস ছাড়ুন এবং নিচে যাওয়ার সময় শ্বাস নিন।
৫. পুরো প্রক্রিয়ায় ওপরের চারটি সেটের প্রতিটি একটানা ১০-১৫ বার পুনরাবৃত্তি করুন।
এ পর্যায়ে চেস্ট প্রেসেস, ডেড লিফটস, অথবা কার্লের মতো ওয়েট লিফটিং এবং স্কোয়াটসকেও যুক্ত করতে পারেন দেহচর্চায়। সে ক্ষেত্রে কোনো বিশেষজ্ঞ পরামর্শ কিংবা ইন্টারনেটের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।
খেলাধুলা ও অন্যান্য অ্যাকটিভিটি
খেলাধুলা ও অন্যান্য ক্রিয়াকলাপও কোলেস্টেরল কমাতে এবং সাধারণ স্বাস্থ্যের উন্নতির ঘটাতে সহায়ক। এগুলোতে কতটা শক্তি ব্যবহার এবং কত ঘন ঘন চর্চা করা হবে, তার ওপর নির্ভর করছে সুফল। সাঁতার, যোগব্যায়াম, বাস্কেটবল-ফুটবলের মতো টিমগত খেলা, হাই ইনটেনসিটি ইন্টারভ্যাল ট্রেনিংয়ের মতো খেলাধুলা ও কার্যকলাপ এ ক্ষেত্রে উপকারী হতে পারে।
সময়ব্যাপ্তি
শীলার মতে, প্রাপ্তবয়স্কদের সুস্থ থাকার জন্য প্রতি সপ্তাহে একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে ব্যায়াম করা শ্রেয়; যেমন—
প্রতি সপ্তাহে ১৫০ থেকে ৩০০ মিনিট মাঝারি তীব্রতার অ্যারোবিক কার্যকলাপ করা;
প্রতি সপ্তাহে ৭৫-১৫০ মিনিট জোরালো তীব্রতার অ্যারোবিক কার্যকলাপ করা;
সপ্তাহজুড়ে মাঝারি ও জোরালো অ্যারোবিক কার্যকলাপের মধ্যে সমন্বয় ঘটানো।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট