যাপনচিত্র I নিরীক্ষার নেশা
ওয়াই শেপের কিজেল গিটার আর বুট। সেই সঙ্গে হাতে নিখুঁত ট্যাটু। চোখে-মুখে আত্মবিশ্বাস নিয়ে গিটারে গর্জন তোলা তুখোড় রকস্টার অনি হাসান। প্রবাসজীবনের কারণে দীর্ঘ বিরতি শেষে সম্প্রতি আবারও মাতিয়েছেন ঢাকার কনসার্ট
আকর্ষণীয় স্টাইল, জীবনযাপনের ঢং—সবকিছু মিলিয়ে ব্যান্ড মিউজিশিয়ানরা বরাবরই তরুণদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো টানেন। গিটারিস্ট ও কম্পোজার অনি হাসানের কথাই ধরা যাক। ট্যাটু আঁকা হাতে গিটার নিয়ে যখন স্টেজে ওঠেন, বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে ভেসে যায় অসংখ্য দর্শক। গেল ১০ মে, দীর্ঘ ১০ বছর পর বাংলাদেশের মঞ্চে উঠেছিলেন তিনি। সেদিন আইসিসিবি এক্সপো জোনে ১৫ হাজার দর্শক যেন আকুল চিত্তে অপেক্ষায় ছিলেন গিটার হাতে তার পারফর্ম উপভোগের জন্য। প্রশ্ন জাগতেই পারে, তার এ জনপ্রিয়তা কি শুধু জাদুকরি সংগীতের কারণেই? পাশাপাশি ভিন্নধর্মী স্টাইল আর ব্যক্তিত্বের চমকও যে রয়েছে তাক লাগানো সব স্টেজ পারফরম্যান্সের পেছনে! সুরের মায়া আর স্টাইলের জাদুতেই অনি জয় করেছেন অগুনতি অনুরাগীর মন।
অনির লাইফস্টাইলের সবচেয়ে বড় অংশ তার মিউজিক। শুরুটা কীভাবে? বাবা ছিলেন বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী। পারিবারিকভাবে সাংস্কৃতিক পরিবেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে মিউজিকের প্রতি আগ্রহকে আকাঙ্খায় পরিণত করেছেন এই গিটারম্যান। কৈশোরে জর্জ মাইকেল, মাইকেল জ্যাকসন, ব্রায়ান অ্যাডামসদের গানে মেতে থাকতেন দিনরাত। তখন থেকেই বুঝতে শুরু করেন সুর ও সংগীতের ভিন্নতা আর মাধুর্যের গভীরতা। নব্বইয়ের দশকে বিশ্বব্যাপী এমটিভির মিউজিক-বিপ্লবই বদলে দেয় অনির জীবনের লক্ষ্য। সর্বকালের অন্যতম সেরা রক মিউজিক ভিডিওগুলোর একটি গানস অ্যান্ড রোজেসের ‘নভেম্বর রেইন’ দেখার পর কিংবদন্তি গিটারিস্ট স্ল্যাশ হয়ে ওঠেন তার আইডল। অনুপ্রেরণার কাতারে ধীরে ধীরে যোগ হতে থাকেন ডাইমব্যাগ ড্যারেল, জেসন বেকার, পল গিলবার্ট, র্যান্ডি রোডস, ভ্যান হেলেন, জো সেট্রিয়ানি, স্টিভ ভাই, জন পেটরুচ্চি ও মার্টি ফ্রিডম্যান। একসময় স্বপ্নকে কাছে পাওয়ার জন্য হাতে গিটার তুলে নেন অনি হাসান।
বাংলাদেশে বাজিয়েছেন ব্যান্ড ভাইব ও ওয়ারফেজের সঙ্গে। ভাইবের ‘চেনা জগৎ’ এবং ওয়ারফেজের ‘পথচলা’ ও ‘সত্য’ অ্যালবামের দারুণ সাফল্য তাকে এনে দেয় তারকাখ্যাতি। এরপর দেশ ছেড়ে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান পড়াশোনার কারণে। অবশ্য নেপথ্য কারণ ছিল মিউজিক নিয়ে নিরীক্ষা। নিজের ভেতরে থাকা বড় ও নতুন আইডিয়া বাস্তবায়ন করা। যুক্তরাজ্যে যাওয়ার ঘটনাকে ‘এক ঢিলে দুই পাখি শিকার’ বলে অভিহিত করেছেন অনি। এরপর ২০১৩ সালে পাড়ি জমান চীনে। এখনো সেখানেই মূল আবাস। সেখানেও মিউজিক তার ধ্যান-জ্ঞান। ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, স্পটিফাইসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও স্ট্রিমিং সাইটে নিয়মিত কনটেন্ট আপলোড করে জানান দেন উপস্থিতি।
ঢাকায় বসে চীনের জীবনযাপনকে অনি বললেন ‘সিম্পল, কোয়াইট ও কাম’। বিয়ে করেছেন সেখানকারই নাগরিক লিলিকে। তার ভাষ্য, ‘চীনে আমার লাইফে প্রাইভেসি আছে। হুটহাট করে মানুষ কাছে আসে না। অ্যাটেনশন কম। ফলে নিজের ওপর বেশি ফোকাস ধরে রাখতে এবং বেশি কাজ করতে পারি। ওখানে আমাকে তেমন কেউ চেনে না। তাই নিজের অবস্থান তুলে ধরতে বাংলাদেশের তুলনায় দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হয়।’
চীনের শ্যান্ডং প্রদেশের জিনান শহরে বাস অনির। ঘুম থেকে ওঠেন সকাল ৭টায়। ব্রেকফাস্ট সেরে প্রায় প্রতিদিন জিমে যান। সকালের পাতে থাকে কুসুমসহ চারটি এবং কুসুমবিহীন (সাদা অংশ শুধু) দুটি—মোট ছয়টি ডিম; সঙ্গে ওটস। জিমে সময় দেন গড়ে এক ঘণ্টা। বেশির ভাগ সময় কার্ডিও করেন। একেক দিন একেক বডি পার্টে ফোকাস থাকে। মাঝেমধ্যে স্ত্রীকেও নিয়ে যান সঙ্গে। জিম থেকে ফিরে গ্রহণ করেন প্রোটিন শেক। নিজের রান্না নিজেই করেন এই রকস্টার। তবে কোনো কাজে ব্যস্ত থাকলে সেই দায়িত্ব স্ত্রীই সামলান।
অনি মধ্যাহ্নভোজ সারেন বেলা ৩টার মধ্যে। মেনুতে থাকে ২০০ গ্রাম চিকেন এবং দুটি টর্টিলা ব্রেড। সাধারণত বিকেল ৪টায় তার বাসায় আসে গিটার স্টুডেন্ট। সে সময় থেকে চলতে থাকে পাঠদান। স্টুডেন্ট না এলে চলে নিজের প্র্যাকটিস। জানা গেল, বর্তমানে ১৫ জন গিটার স্টুডেন্ট রয়েছে তার, প্রত্যেকেই বেশ নিবেদিতপ্রাণ। দিনের শেষ খাবার অনি গ্রহণ করেন বিকেল ৫টায়। এরপর এমনকি পানি পর্যন্ত পান করেন না। রাতে ঘুমিয়ে পড়েন ১০টার মধ্যেই।
অনির মতে, ‘চীনের মিউজিক পরিসর অনেক বড়। তবে এর কেন্দ্রবিন্দু বেইজিং। বড় ব্যান্ড বা কনসার্ট—সবকিছুর মিলনমেলা সেখানেই। অনেকে আমাকে সেখানে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত জিনানেই থাকছি। আমার ইউনিভার্সিটি ছিল এ শহরে। স্ত্রীর সঙ্গে প্রথম দেখাও এখানে। তাই শহরটির সঙ্গে একধরনের আবেগ জড়িয়ে আছে আমার।’
স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, ‘এক বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয়। উইচ্যাটের একটি গ্রুপে ছিলাম আমরা, সেখান থেকেই কানেক্টেড। এরপর ওর বেশ কিছু ছবি আমার নিউজ ফিডে আসে। এভাবেই আমাদের কথা শুরু।’ লিলিকে তিনি ইনকারেজিং বলে আখ্যা দেন। অনি হাসানের মিউজিক্যাল জার্নির অবিচ্ছেদ্য অংশ লিলি। একসঙ্গেই মিউজিক শোনেন। এমনকি লিলির সবচেয়ে পছন্দের মিউজিক অনির ‘আনটিল উই মিট অ্যাগেইন’। দুজনে একসঙ্গে শপিং করতে আর ছবি তুলতে ভালোবাসেন।
রক মিউজিকে অনির ফ্যাশন আইকন কে? জবাবে নাম নিলেন স্ল্যাশের। বললেন, ‘আমি জানি না তাকে ফ্যাশন আইকন বলা ঠিক হবে কি না! রকস্টারদের ফ্যাশনে কিছু সাদৃশ্য থাকে। দেখবেন তাদের অধিকাংশই জিনস, ব্ল্যাক টি-শার্ট অথবা স্লিভলেস পরেন। তবে সবচেয়ে ইউনিক ব্যাপার হচ্ছে তাদের ট্যাটু।’ অনির শরীরে ট্যাটু আছে চারটি। বাঁ হাতে বাবা ও ডান হাতে মায়ের স্বাক্ষরসংবলিত ট্যাটু, যার পাশেই রয়েছে যথাক্রমে কিং ও কুইন সিম্বল। বাকি একটি ট্যাটুর থিম অ্যাবসলিউট পারফেকশন, আর সবশেষটির সিম্বল স্টার। স্টার সিম্বলের থিম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমাকে বলা হতো, স্টার ইজ দ্য মোস্ট বিউটিফুল থিং ইউ ক্যান এভার গেট ইন দ্য স্কাই। ইউ ক্যান সি ইট, এভরিওয়ান ক্যান সি ইট, বাট নো ওয়ান ক্যান টাচ ইট। ইন অর্ডার টু রিচ দ্য স্টার, ইউ হেভ টু বি দ্যাট গুড, ইউ হেভ টু বি দ্যাট নলেজেবল।’ তার ড্রেসআপ সিম্পল—জিনস, টি-শার্ট; বিশেষত স্লিভলেস টি-শার্ট, সঙ্গে বুট। বুটের ক্ষেত্রে পছন্দ ডক মার্টিনস। এর খোঁজ পেয়েছেন ওয়ারফেজের কিংবদন্তি গিটারিস্ট কমলের কাছ থেকে। পছন্দের অ্যাকসেসরিজ এয়ার রিং ও ঘড়ি। ঘড়ির প্রিয় ব্র্যান্ড ক্যাসিও। প্রিয় রং সাদা। অনির হেয়ারস্টাইল নিয়ে বলা বেশ মুশকিল! একসময় তার লম্বা চুলে স্টেজ অ্যাপিয়ারেন্স বেশ জনপ্রিয় ছিল। তবে বর্তমানে ছোট চুলেই দেখা যায় বেশি। হেয়ার কালার নিয়ে আছে নিরীক্ষার নেশা। অবশ্য তিনি যখন যে স্টাইল করেছেন, তা-ই তরুণদের কাছে পেয়েছে গ্রহণযোগ্যতা।
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সুর উপলব্ধি করার চাওয়া তার। সময়কে কাজে লাগিয়ে তাই নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে এগোচ্ছেন প্রতিনিয়ত। তবে কি অবসর পান না একেবারেই? তা নয়। অবসরে সামাজিক অনুষ্ঠান বা সবার সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার চেয়ে বরং যাদের সঙ্গে থাকলে জ্ঞানের পরিধি বাড়বে, তাদেরকেই বেছে নেন। চীনে হাতে গোনা যেসব বন্ধু আছেন, প্রত্যেকেই অনির চেয়ে ১০-১৫ বছরের বড়। মিউজিশিয়ান বলে এটা খুব স্বাভাবিক, তিনি সময় পেলে গান শোনেন। তার সবচেয়ে পছন্দের পাঁচটি অ্যালবাম মাইকেল জ্যাকসনের ‘থ্রিলার’, প্যানটেরার ‘কাউবয়েজ ফ্রম হেল’, গানস অ্যান্ড রোজেসের ‘অ্যাপেটাইট ফর ডিস্ট্রাকশন’, আর্টসেলের ‘অন্য সময়’ এবং নেমেসিসের ‘অন্বেষণ’। সময় পেলে প্রচুর ইনস্ট্রুমেন্টাল শোনেন। চীনের বিখ্যাত ইনস্ট্রুমেন্ট গুঝেং ও এরহুর কথা বিশেষভাবে জানালেন, যেগুলোর সুরের মূর্ছনা তার মতে বেশ আধ্যাত্মিক।
অনি হাসান ভ্রমণপিয়াসি। কোভিডের আগপর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন দেশে। বর্তমানে সেই ঝোঁক খানিকটা কম। তবে সদ্যই লিলিকে বাংলাদেশে নিয়ে আসার স্মৃতি তার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে বলে মনে করেন। কেননা, এবার বাবা-মা ও ভাইয়ের সঙ্গে স্ত্রীকে প্রথম দেখা করিয়ে দিতে পেরেছেন তিনি। মজার ব্যাপার হলো, এটি লিলির প্রথম বিমানভ্রমণ। ভিন্ন দেশ, ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর বিষয়টি ভালোভাবেই সামলেছেন অনির স্ত্রী। গুটিকয়েক বাংলা শব্দ রপ্ত করেছেন ইতিমধ্যে। বুঝতে পারেন অন্যদের বলা বিভিন্ন বাংলা কথাও। বাংলাদেশে এসে এখানকার প্রচলিত কিছু পোশাকও কিনেছেন।
স্টাইল দিয়ে অনুরাগীদের মাত করা প্রসঙ্গে অনির অভিমত, ‘আসলে যা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানিয়ে যায়, সেটিই স্টাইল।’ বর্তমানে ইনস্ট্রুমেন্টাল নিয়ে বেশি ব্যস্ততার কারণ, ‘আমি বিশ্বাস করি, মিউজিকের একটি নিজস্ব ভাষা আছে, যে ভাষায় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হতাশা কিংবা ভালোবাসার মতো অনুভূতি; করা সম্ভব প্রতিবাদ।’
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন
লোকেশন: লো মেরিডিয়েন