বিশেষ ফিচার I বাবা চিরন্তন
বিরল ব্যতিক্রম বাদে, সন্তানের জীবনে ছায়া হয়ে থাকেন তিনি। বলছি বাবার কথা। তাকে নিবেদিত বিশেষ দিন ‘বাবা দিবস’। পালিত হয় জুনের তৃতীয় রোববার। এই বিশেষ দিবস ঘিরে, আধুনিক চিত্রকলার অনবদ্য সৃষ্টি, ফ্রিদা কাহলোর ‘পোর্ট্রেট অব মাই ফাদার’-এর ওপর কিঞ্চিৎ আলোকপাত
ফ্রিদা কাহলো [৬ জুলাই ১৯০৭—১৩ জুলাই ১৯৫৪]। ম্যাক্সিকান কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী। আত্মপ্রতিকৃতির জন্য বিশেষভাবে খ্যাত। কিশোরী বয়সে বাস দুর্ঘটনার শিকার হয়ে জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটাতে হয়েছে বিছানায়। সেই যন্ত্রণা ও লড়াই তার চিত্রকর্মের অন্যতম অনুষঙ্গ। বলা হয়ে থাকে, ব্যক্তিগত বেদনা সত্ত্বেও নারীজীবনের সঞ্জীবনী প্রেরণা এঁকে গেছেন তিনি চিত্রকলায়। এর মধ্যে তুলনামূলক কম আলোচিত একটি চিত্রকর্ম ‘পোর্ট্রেট অব মাই ফাদার’। তার বাবা গুইলের্মো কাহলোর [১৮৭১-১৯৪১] মৃত্যুর এক দশক পর, ১৯৫১ সালে, হুইলচেয়ারে বসে কাটানো দিনগুলোতে ছবিটি এঁকেছেন ফ্রিদা।
১৯০৭ সালে গুইলের্মো নিজের যে ছবি নিজেই তুলেছিলেন ক্যামেরায়, সেটি থেকে প্রেরণা নিয়েই কন্যা ফ্রিদা এই চিত্রকর্মের কম্পোজিশন তৈরি করেছেন। চিত্রকর্মটির নিচের দিকে মমতাভরে তিনি লিখে রেখেছেন, ‘আমি আমার বাবা ভিলহেম কাহলোর ছবি এঁকেছি, যিনি হাঙ্গেরিয়ান-জার্মান বংশোদ্ভূত একজন পেশাদার শিল্পী-আলোকচিত্রী; মহৎ চরিত্রের অধিকারী, ধীমান ও নির্ভেজাল, একই সঙ্গে সাহসী মানুষ। কেননা, ৬০ বছর মৃগীরোগে ভুগলেও কখনোই কাজ করা এবং হিটলারের বিরুদ্ধে লড়াই থামাননি।’ এই বয়ানের একদম নিচে ‘তার বন্দনা করি’ লিখে স্বাক্ষর করেছেন ‘তার কন্যা ফ্রিদা কাহলো’।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াইয়ের বিশেষজ্ঞ এনরিক জে. ক্যারাজানার একটি আর্টিকেল সূত্রে জানা যায়, গুইলের্মোর জন্ম জার্মানির ফর্জহেইমে। উন্নত জীবনের খোঁজে ১৯ বছর বয়সে মেক্সিকোতে পাড়ি জমান তিনি। দেশত্যাগের নেপথ্যে সৎমায়ের সঙ্গে গোলমালও একটি সম্ভাব্য কারণ। সে সময়ে মেক্সিকো সিটিতে প্রায় ৫০০ জার্মান নাগরিকের বসবাস ছিল। মেক্সিকান সমাজে সহজে মিশে যাওয়ার ঝোঁক ছিল তার। এ কারণে নিজের নাম ‘ভিলহেম’ থেকে পাল্টে এর স্প্যানিশ সংস্করণ ‘গুইলের্মো’ রাখেন। বিয়ে করেন এক মেক্সিকান নারীকে। আর চার বছরের মধ্যেই লাভ করেন দেশটির নাগরিকত্ব।
১৮৯৮ সালে প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু হলে বিয়ে করেন মাতিলদে কালদেরন গঞ্জালেসকে; ফ্রিদা তাদেরই সন্তান। পিয়ানোতে ধ্রুপদি সংগীত বাজানো, নিজের বিরাট লাইব্রেরিতে বই পাঠ, ছবি আঁকা এবং তোলা ছবি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটানো একজন সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন গুইলের্মো। ত্রিশ ছুঁই ছুঁই বয়সে ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। এই প্রেরণা সম্ভবত পেয়েছিলেন ফ্রিদার নানার কাছ থেকে। তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরে যায় ১৮৯৯ সালে; জার্মান মালিকানাধীন বকার ট্রেডিং হাউস মেক্সিকো সিটির কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত তাদের প্রধান কার্যালয়গুলোর ছবি তোলার দায়িত্ব তাকে দিলে। গুইলের্মোর তোলা ছবি দিয়ে ৪০ হাজারের বেশি কপি ব্রুশিয়ার ছেপেছিল প্রতিষ্ঠানটি। এরপর হরদম সরকারি কাজ পেতে থাকেন তিনি। নিজেকে একজন ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফার হিসেবে গণ্য করতেন; যার বিশেষত্ব স্থাপত্য ও শিল্প স্থাপনায়।
নিজ সন্তানদের মধ্যে ফ্রিদাকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন গুইলের্মো। পোলিওমাইলাইটিস থেকে ৬ বছর বয়সে ফ্রিদার সেরে ওঠার নেপথ্যে সক্রিয় ভূমিকা ছিল সেই পিতৃস্নেহের। অসুখ যেন শিশুকন্যার উচ্ছলতা ও খেলাধুলায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে, সে জন্য ফ্রিদাকে ইতিবাচক উৎসাহ জোগাতেন এই পিতা। পরবর্তীকালে ফ্রিদাও বলেছেন, বাবার কারণেই দুর্দান্ত এক শৈশব পেয়েছিলেন তিনি। অসুখ থেকে সেরে উঠে, ফ্রিদা যখন কৈশোর কাটাচ্ছেন, তখনো বাবার স্নেহ যেমন তাকে আগলে রেখেছে, একইভাবে বাবাকেও তিনি আগলে রাখেন। গুইলের্মো দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছিলেন বিষণ্নতা ও মৃগীরোগে। বিষণ্নতা থেকে বাবাকে বের করে এনে চাঙা রাখতে এবং মৃগীরোগ মাথাচাড়া দিলে তার প্রাণ বাঁচাতে, গুইলের্মোর সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন কিশোরী ফ্রিদা। এভাবে ঝটপট বাবার প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং একই সঙ্গে চুরি যাওয়া থেকে বাবার ছবি তোলার যন্ত্রপাতি সুরক্ষা দেওয়ায় দক্ষ হয়ে ওঠেন তিনি। অল্প বয়সের ব্যাধির অভিজ্ঞতা মেডিকেল স্কুলে পাঠের প্রতি ঠেলে দেয় ফ্রিদাকে; কিন্তু ১৮ বছর বয়সে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা সেই আশা করে দেয় গুঁড়েবালি। ওই দুর্ঘটনায় একটি ইস্পাতের দণ্ড গেঁথে যায় ফ্রিদার শরীরে; তার শ্রোণিচক্র ও মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। ফলে মাসের পর মাস বিছানায় থাকতে হয় তাকে। আর তা তার জীবনে বেদনাদায়ক দাগ ফেলে যায়। এই দ্বিতীয় দফার আরোগ্যকালে ওই পিতা-কন্যা সম্পর্ক আরও বেশি গাঢ় ভূমিকা রাখে। এ বেলায়ও কন্যার প্রাথমিক দেখভালের দায়িত্ব নেন গুইলের্মো। বাবার সহযোগিতাতেই ফ্রিদা ছবি আঁকতে শুরু করেন; তাতে নিজ আবেগ ও প্রতিভা প্রকাশের একটি নতুন ময়দান খুলে যায় তার সামনে।
নিজের শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার পাশাপাশি, সমাজে যৌনবাদের দাপটে নারীদের অধিকারহীনতা এবং ফ্যাসিবাদের উত্থানের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াইরত এক নারী হিসেবে ছবি আঁকা ও লেখালেখির মাধ্যমে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন ফ্রিদা। আর তাতে বাবার ও নিজের জীবনের ছাপ ফুটিয়ে তুলেছেন হরদম।
‘পোর্ট্রেট অব মাই ফাদার’ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রথম দিকের বেশির ভাগ চিত্রকর্মে ফ্রিদা নিজের বিষয়বস্তুগুলোকে যে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো—এমন অবস্থায় দেখাতে পছন্দ করতেন, এটি এর অন্যতম উদাহরণ। বাবার মৃত্যুর এক দশক পর তার প্রতিকৃতি আঁকতে গিয়ে ছবির রঙে ব্রাউনিশ টোন ব্যবহার করেছেন ফ্রিদা, যা বস্তুত আলোকচিত্রশিল্পের শুরুর দিকের সেপিয়া-টোনড ফটোগ্রাফগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়, যে ধরনের টোনে ছবি তুলতেন গুইলের্মো। এই চিত্রকর্ম ফ্রিদার মুনশিয়ানারও একটি প্রতিফলন। ছবিটিতে গুইলের্মো সরাসরি দর্শকের দিকে তাকিয়ে নেই; এর মাধ্যমে তাকে একধরনের নির্লিপ্ত ব্যক্তি হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছেন তার কন্যা। একই সঙ্গে, তার কানগুলো বড় বড় করে আঁকা, যা সাধারণ অর্থে তার বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। ছবিটিতে গুইলের্মো বেশ তরুণ; পরনে বিয়ের পোশাক। নিশ্চিতভাবেই এ পোশাকে বাবাকে দেখেননি ফ্রিদা; তবু মনের মধ্যে বাবার যে তারুণ্যদীপ্ত প্রাণস্পৃহা ধারণ করতেন, সেটিরই ঘটিয়েছেন বহিঃপ্রকাশ। এভাবে এক প্রখ্যাত কন্যার রংতুলির ভেতর দিয়ে গুইলের্মো পেয়েছেন চিরন্তন পিতার অন্যতর নমুনা—যার স্নেহচ্ছায়ায় পাড়ি দেওয়া সম্ভব জীবনের সকল দুর্গম গিরি, কান্তার মরু।
দায় স্বীকার:
পোর্ট্রেট অব মাই ফাদার: ফ্রিদা কাহলো’স ইনটিমেট রিলেশন টু এপিলেপসি/এনরিক জে. ক্যারাজানা; ফ্রিদা কাহলো ডট অর্গ
লাইফস্টাইল ডেস্ক
ছবি: সংগ্রহ