skip to Main Content

এডিটর’স কলাম I ভাগ বন্দনা

পৃথিবীতে মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী; তবে কাজের প্রভাব অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী। তা ইতিবাচক ও নেতিবাচক—উভয় অর্থেই। ফলে একজন মানুষ পৃথিবী থেকে চলে গেলেও তার কাজের রেশ রয়ে যায়

‘নিজের সম্পদ অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি না করে ভোগ করার মধ্যে আনন্দ নেই,’ বলেছেন ষোড়শ শতাব্দীর ডাচ মানবতাবাদী ও দার্শনিক ইরাসমাস। ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের জন্য ত্যাগের পাশাপাশি ভাগাভাগি করে নেওয়ার মহৎ বার্তা নিয়ে আসে পবিত্র ঈদুল আজহা। ধর্মতাত্ত্বিকদের মতে, কোরবানি একটি প্রতীকী ব্যাপার। মহান সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে আত্মত্যাগের একটি দৃষ্টান্তমাত্র। সারা বছর তার নৈকট্য লাভের প্রত্যাশায় নিজ সম্পদ অন্য মানুষদের কল্যাণে ত্যাগ, অর্থাৎ অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়া চাই। অন্যথায় এটি নামমাত্র ভোগবাদী অনুষ্ঠানই থেকে যাবে। আল কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা স্বীয় উপার্জন থেকে এবং যা আমি তোমাদের জন্যে ভূমি থেকে উৎপন্ন করেছি, তা থেকে উৎকৃষ্ট বস্তু ব্যয় করো’ [সূরা আল বাক্বারাহ]। তাই নিজেদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ মানবতার সেবায় ব্যয় করা আবশ্যক। এই ঈদকে উদাহরণ হিসেবে ধরে প্রশ্ন জাগতে পারে, সামর্থ্যবানদের কোরবানিলব্ধ মাংসের নির্দিষ্ট অংশ নিয়মমাফিক অন্যদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে কী মিলবে? এ কি শুধুই পবিত্র কোরআনের নির্দেশনা অনুসরণের ফলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ তথা পরকালে শান্তি পাওয়ার প্রচেষ্টা? হ্যাঁ, তা তো বটেই; তবে শুধু সেই মরমি পর্যায়েই সীমিত নয় এর প্রভাবের ব্যাপ্তি। ইহকালে অর্থাৎ আক্ষরিক জীবনযাপনেও এর সুফল সুনিশ্চিত। নিজের সম্পদ অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিলে সমাজে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে; পাশাপাশি কমে আসবে বৈষম্য।

দুই
পৃথিবীতে মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী; তবে কাজের প্রভাব অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী। তা ইতিবাচক ও নেতিবাচক—উভয় অর্থেই। ফলে একজন মানুষ পৃথিবী থেকে চলে গেলেও তার কাজের রেশ রয়ে যায়। ইতিবাচক বোধে এমনই এক অনুসরণীয় উদাহরণ হাজী মুহম্মদ মুহসীন (তার নামের বানান হিসেবে মুহাম্মদ মহসিনও প্রচলিত রয়েছে)। ‘দানবীর’ নামে খ্যাত। তার উদারতার গল্প অনেকে জানি; তবু সংক্ষেপে আরেকবার স্মরণ করলে আশা করি বাহুল্য হবে না। ৮০ বছর (১৭৩২-১৮১২) আয়ুর জীবনে তিনি নিজের সম্পদ জনকল্যাণে উদারচিত্তে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। তাতে পরিণত হয়েছেন কিংবদন্তিতে। ইতিহাস বলে, হাজী মুহসীন ছিলেন অঢেল সম্পদের মালিক। তার পূর্বপুরুষেরাও ধনী ছিল। ইরান থেকে বাংলায় আসা তার বাবা হাজী ফয়জুল্লাহ ছিলেন ধনী জায়গিরদার। মা জয়নব খানমেরও প্রচুর জমি ছিল হুগলি, যশোর, মুর্শিদাবাদ ও নদীয়ায়। বোন মন্নুজানের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারী হিসেবে বোনের সম্পত্তিরও মালিক হন মুহসীন। এত সম্পদের মালিক হয়েও তিনি ছিলেন নিরহংকার। সহজ-সরল জীবন যাপন করতেন। থাকতেন ছোট কুটিরে। একজীবনে নিজের টাকা দিয়ে তিনি বহু বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হুগলি মহসিন কলেজ ও চট্টগ্রামে সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ প্রভৃতি। এ ছাড়া ১৭৬৯-৭০ সময়কালে চলা দুর্ভিক্ষের দিনগুলোতে অসংখ্য লঙ্গরখানা স্থাপন এবং সরকারি তহবিলে অর্থ সহায়তা করেন তিনি। ১৮০৬ সালে গড়ে তোলেন মুহসীন ফান্ড নামের একটি তহবিল। সেখান থেকে ধর্মীয় কর্মকাণ্ড, পেনশন, বৃত্তি ও দাতব্য কর্মকাণ্ডে অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা রয়েছে। কালে কালে অসংখ্য হতদরিদ্র শিক্ষার্থী পড়াশোনার আলো দেখতে পেয়েছে তার অর্থানুকূল্যে। এই যে নিজের সম্পদ কবজায় না রেখে, উদারচিত্তে মানবকল্যাণে বিলিয়ে দেওয়া বা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া, এই মহানুভবতা মুহসীনকে মৃত্যুর এত কাল পরেও অমর করে রেখেছে।

তিন
দুঃখজনক হলেও সত্য, পৃথিবীতে কোনোকালেই সম্পদের সুষম বণ্টন হয়নি। ফলে বিবিধ বৈষম্যে ধুঁকতে হয়েছে মানবসভ্যতাকে; এখনো তা অব্যাহত। তবে সেই সব যন্ত্রণাকে প্রশমিত করতে কালে কালে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন অনেক মহানুভব ব্যক্তি। আর তেমনটা করার জন্য প্রত্যেককেই যে হাজী মুহম্মদ মুহসীনের মতো অঢেল সম্পদের অধিকারী হতে হবে, তা আবশ্যক নয়; বরং সদিচ্ছা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, একজন ব্যক্তিমানুষের মনোজগতে মানবকল্যাণের জন্য ইতিবাচক মানসিকতা গড়ে উঠলে, তার সম্পদ যত সামান্যই হোক, তা দিয়েও পৃথিবীর বুকে হিতকর পদচ্ছাপ রেখে যাওয়া সম্ভব। এই সম্পদ যে আক্ষরিক অর্থেই হতে হবে, তা নয়; অন্তর্নিহিত অর্থেও এর গুরুত্ব প্রবল। কখনো কখনো কোনো বিপন্ন মানুষের পাশে একটু বসে থাকা, তার দিকে একটু মুচকি হাসি দিয়ে তাকানোর মাধ্যমেও ভাগাভাগি করে নেওয়া যায় প্রাণস্পৃহা ছড়ানো অনুভূতি। তাতে হয়তো নতুন করে উঠে দাঁড়ানোর, নিজের জীবনকে অর্থবহ ভাবার প্রেরণা পাবেন আপাত-বিপদগ্রস্ত মানুষটি।

চার
ভাগাভাগির চর্চা শুধু সামাজিক জীবনে ইতিবাচক ভারসাম্য তৈরিতেই ভূমিকা রাখে না; ব্যক্তিমানুষের মনোজগতেও এনে দেয় প্রশান্তি। আর তা এমনই এক উপলব্ধি, যা কোটি কোটি টাকার বিনিময়েও অর্জন করা সম্ভব নয়। অথচ অতি সামান্যতেই পাওয়া সম্ভব। বোধ করি, আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ জীবনের নানা সময়ে উঁকি দিয়ে এর প্রত্যক্ষ উদাহরণ খুঁজে পাব। আর অবাক হয়ে খেয়াল করব, ভাগাভাগি করে নেওয়ার ইতিবাচক মানসিকতা হয়তো অজান্তেই নিজের ভেতর লালন করে এসেছি; শুধু এর নিয়মিত চর্চা করিনি, এই যা!

পাঁচ
নিজের যা কিছু আছে, তা থেকে প্রয়োজনের বাড়তি অংশ অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে জানলে, আপাতদৃষ্টে সম্পদ কমলেও প্রকৃত অর্থে তা বাড়বে বৈ কমবে না। কেননা, তাতে জীবনের প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করার সম্ভাবনা বাড়বে।

ভাগচর্চার তাৎপর্য ছড়িয়ে পড়ুক জনজীবনে। সবার মঙ্গল হোক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top