skip to Main Content

ফুডচেইন I হাই হাইডিলাও!

বিশ্বের দাপুটে হটপট চেইন ব্র্যান্ডগুলোর অন্যতম। প্রথম রেস্তোরাঁ খোলার ৩০ বছর পর, এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি আলোচনায়। সৃজনশীলতার সঙ্গে দারুণ ব্যবসায়িক রূপরেখা ও পরিষেবার কারণে ভোজনরসিকেরা একটি টেবিল পেতে দুই ঘণ্টা সারিতে অপেক্ষা করতেও পিছপা হন না। চাইলেও একা খাওয়ার অবকাশ নেই; সঙ্গ দেয় টেডি বিয়ার

হাইডিলাওয়ের মালিক ঝাং ইয়ং মাত্র ১০ হাজার ইউয়ান (১ হাজার ৪৭০ ডলার) বিনিয়োগে চীনের সিচুয়ান প্রদেশের জিয়ানিয়াং অঞ্চলে তার প্রথম হটপট রেস্তোরাঁ স্থাপন করার পর থেকে তিন দশকের বেশি সময় পেরিয়েছে। ইতিমধ্যে এটি সে দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী হটপট চেইনে পরিণত। চীনজুড়ে এই রেস্তোরাঁর ভীষণ জনপ্রিয়তা। ২০২১ সালে বার্ষিক টার্নওভার ছিল প্রায় ৪১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ইউয়ান। সাংহাই থেকে শেনজেন পর্যন্ত ২০২৩ সালের শেষে হাইডিলাওয়ের আউটলেট সংখ্যা ১ হাজার ৩৫১। এ ছাড়া হংকং, ম্যাকাও ও তাইওয়ানে রয়েছে ২৩টি আউটলেট। প্রতিবছর এর আউটলেট সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। এখন পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানে ৬০ হাজারের বেশি মানুষ কাজ করছেন। সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ায় রেস্তোরাঁ খোলার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দাবড়ে বেড়াচ্ছে হটপট চেইনটি। চায়নিজ খাবার পরিবেশনকারী একটি রেস্তোরাঁ কীভাবে এত সফল হয়ে উঠল?
চীনজুড়ে হটপট রেস্তোরাঁয় সেদ্ধ করা টাটকা মাংস ও শাকসবজি ঝোলে ডোবানোর চল রয়েছে। তবে ঝাং ইয়ংয়ের উদ্ভাবনী কৌশলে ভর দিয়ে প্রচলিত রেসিপি পরিমার্জনের পাশাপাশি খাঁটি সিচুয়ান হটপট বাজারজাত করতে উচ্চ পরিষেবা, উচ্চ প্রযুক্তি ও উচ্চ মান বেছে নিয়েছে হাইডিলাও।
হাই সার্ভিস হটপট: ব্রেন ওয়াশিং স্টাফ
একটি বিষয় হয়তো অনেকের জানা নেই, এখানে সুস্বাদু হটপট পরখ করতে আসা ভোক্তারা অপেক্ষমাণকালে বিনা মূল্যে ম্যানিকিউর পেতে পারেন! রেস্তোরাঁটি এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, টেবিল পেতে এক বা দুই ঘণ্টা সারিতে অপেক্ষা করা খুব সাধারণ ঘটনা। এই সময় বিনোদন এলাকায় গ্রাহকদের জন্য বোর্ড গেমস, বিনা মূল্যে স্ন্যাকস, পানীয়, ম্যানিকিউর, মাসাজ, এমনকি জুতা পলিশ পরিষেবা দেয় হাইডিলাও। এ রকম আকর্ষণীয় অভিজ্ঞতা একে আলাদা করে তুলেছে।
প্রতিটি টেবিলের জন্য রয়েছেন পর্যাপ্ত কর্মী। যেসব গ্রাহকের চুল বড়, তারা খাওয়ার সময় তাদের চুল পেছনে বাঁধতে বিনা মূল্যে দেওয়া হয় হেয়ারব্যান্ড। যেসব গ্রাহক চশমা পরে আসেন, তাদের চশমা পরিষ্কারের জন্য সরবরাহ করা হয় টিস্যু। খাবারের দাগ এড়াতে বিশেষ অ্যাপ্রোন দেওয়ার পাশাপাশি ভোক্তাদের অতিরিক্ত জিনিসপত্রের সুরক্ষায় সরবরাহ করা হয় হ্যান্ডব্যাগ। হাইডিলাওয়ের টয়লেটে কর্মীরা গ্রাহকের হাতে তোয়ালে তুলে দেন এবং গ্রাহকদের প্রয়োজন অনুসারে প্রসাধনসামগ্রী সরবরাহ করেন।
কর্মীদের জন্য বাধ্যতামূলক বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে। প্রশিক্ষণ দেন চেইনটিতে ৩-৫ বছর কাজ করা ব্যক্তিরা। তাতে নতুন কর্মীদের করপোরেট কালচার এবং হাইডিলাওয়ের খাবার সম্পর্কে শেখানো হয়। অতিথিদের কীভাবে স্বাগত জানাতে হবে, একটি ভালো পরিবেশ তৈরি করতে কীভাবে কথা বলা চাই—এসবের পাশাপাশি রেস্তোরাঁর বিবিধ নিয়ম সম্পর্কেও শেখানো হয় এখানে। কর্মীদের ক্ষেত্রে সদা হাস্যোজ্জ্বল থাকার বিপরীতে কখনোই গ্রাহকদের সঙ্গে ঝগড়া করা একদম বারণ!
প্রশ্ন-উত্তর প্ল্যাটফর্ম জিহু ডট কমে সাবেক হাইডিলাও কর্মীদের প্রকাশ করা অভিজ্ঞতায় ফুটে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তাতে জানা যায়, কর্মীরা যেহেতু একসঙ্গে কাজ, জীবনযাপন এবং খাওয়া-দাওয়া করেন, তাই তাদের পুরো জীবন কর্মস্থলকে কেন্দ্র করেই কাটে। ব্যতিক্রম শুধু মাসে পাওয়া চার দিনের ছুটি। কেউ কেউ আছেন যারা কাজের নীতিনির্ধারণের পাশাপাশি তুলনামূলক বিলাসবহুল আবাসস্থল, ভালো ক্যানটিনের জন্য কোম্পানিটিকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। বিপরীতে এমনও অনেকে আছেন, যাদের অভিযোগ, হাইডিলাও যত ‘হাস্যকর নিয়ম’ দিয়ে কর্মীদের ‘মগজ ধোলাই’ করে! (কর্মীরা গ্রাহকের টয়লেট ব্যবহার করতে পারবেন না; শিফটের সময় মোবাইল ফোন চালু করতে না দেওয়া; টানা দীর্ঘ সময় কাজ করানো ইত্যাদি।)
হাইডিলাওয়ের স্টাফ ম্যানেজমেন্ট ও ট্রেনিং চীনের বিপণনকারী ও স্কলারদের জন্য গবেষণার একটি জনপ্রিয় বিষয়। সাম্প্রতিক সময়ে এই ফুড চেইনের ব্যবসায়িক মডেল উদ্ভাবন, পরিষেবা খাতে এর সৃজনশীলতা এবং গ্রাহক সন্তুষ্টির ওপর ফোকাস করে দেশটিতে বেশ কিছু একাডেমিক বই ও নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
হাই-টেক হটপট: আইপ্যাডে অর্ডার
যদিও হাইডিলাও নতুন আরেকটি ফুড চেইন ‘ওডি হুয়োগুয়ো’র মতো ডিজিটালাইজড নয়, তবে এটি চীনের ডিজিটাল উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। এখানকার প্রতিটি টেবিলে মোবাইল ফোনের জন্য চার্জ স্টেশন রয়েছে। মেনু থেকে হটপট ছাড়াও যেকোনো উপাদান ও পানীয় অর্ডার করার জন্য প্রত্যেক গ্রাহকের কাছে সরবরাহ করা হয় একটি ট্যাব। সেই ট্যাবের মাধ্যমে অর্ডার করা আইটেম কয়েক মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যায় টেবিলে। রেস্তোরাঁটির সব এলাকায় রয়েছে বিনা মূল্যে ওয়াই-ফাই ব্যবহারের সুবিধা।
বলা বাহুল্য, তারা উইচ্যাট ও আলিপে-কে অর্থ প্রদানের পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করে। হাইডিলাও অনলাইন রিজার্ভেশন ও অর্ডার সেবাও দিয়ে থাকে। গ্রাহকেরা তাই বাড়িতে বসে হটপট অর্ডার করতে পারেন। খাওয়া শেষে ব্যবহৃত পট নিয়ে যাওয়ার সার্ভিসও দেয় প্রতিষ্ঠানটি, যা নিঃসন্দেহে একটি পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ।
উইচ্যাট অ্যাপে হাইডিলাওয়ের বেশ কিছু ফিচার রয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, অনলাইন গেমিং জোনে গেমাররা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতে নিতে পারেন তাদের পরবর্তী হটপট বিলে বিশেষ ডিসকাউন্ট।
পরিষেবা যতই ভালো হোক না কেন, দিন শেষে গ্রাহকেরা খাবারের স্বাদ ও গুণমানকে বিবেচনায় রাখেন। মান নিয়ন্ত্রণে হাইডিলাও কঠোর এবং সাবধানে এর সরবরাহকারীদের নির্বাচন করে। এটি চীনা গ্রাহকদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, দেশটি গত দশকে প্রচুর খাদ্য কেলেঙ্কারির সাক্ষী হয়েছে।
প্রতিবছর নতুন রেসিপি ও খাবার যোগ করে হাইডিলাও স্ট্যান্ডার্ড হটপট রেসিপিগুলোতে বৈচিত্র্য আনে। তিলের ডিপ থেকে মসলাদার তেল, সেই সঙ্গে শসা, চিনাবাদাম ও তাজা ফলের মতো সাইড ডিশ ছাড়াও এই ফুড চেইনে রয়েছে ২০টির বেশি ডিপিং সসসহ একটি মসলা বার।
রেস্তোরাঁটি ধারাবাহিকভাবে প্রবাসী কমিউনিটির কাছ থেকেও ভালো পর্যালোচনা পাচ্ছে। টাইম আউট ও বেইজিংগারের মতো বিখ্যাত ম্যাগাজিনগুলোর প্রবর্তিত রেস্তোরাঁবিষয়ক পুরস্কারগুলোতে হাইডিলাও বিভিন্ন বছরে জিতে নিয়েছে নানা পুরস্কার। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বেস্ট হটপট’, ‘আউটস্ট্যান্ডিং সার্ভিস,’ ‘আউটস্ট্যান্ডিং চায়নিজ রেস্টুরেন্ট অব দ্য ইয়ার’ প্রভৃতি।
ইউ নেভার ইট অ্যালোন
ওয়েইবোতে হাইডিলাও অনেক নেটিজেনের প্রশংসা পেয়েছে; যদিও কারও কারও অভিমত, ‘এখানকার পরিষেবা এতই ভালো, যা আসলে বিব্রতকর!’ উদাহরণ হিসেবে একজন গ্রাহকের কথা বলা যেতে পারে, যিনি বলেছিলেন, ‘আমার শুধু একটি ব্যান্ড-এইড দরকার ছিল; অথচ ওয়েটার ব্যক্তিগতভাবে এসে আমাকে সাহায্য করেছেন।’
সম্প্রতি নেটিজেনরা হাইডিলাওয়ের সর্বশেষ পরিষেবা সংযোজনকে ‘মজার’ বলে অভিহিত করেছেন। আর তা হলো, কেউ সেখানে একা খেতে গেলে টেবিলে তাদের সঙ্গে থাকার জন্য একটি টেডি বিয়ার দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে একজন নেটিজেনের পোস্ট, ‘হাইডিলাওয়ের হাজির করা এই নতুন বন্ধুর সঙ্গ পেয়ে আমি দারুণ খুশি।’ অনেক নেটিজেন ওয়েইবোতে টেডি বিয়ারের ছবি পোস্ট করেন। আবার অনেকে অন্য টেবিলে অতিথি ও টেডি বিয়ারের ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘তাহলে এটা সত্যি যে হাইডিলাওতে ভোজনরসিকেরা টেডি বিয়ারের সঙ্গে খাবার খান!’
চলতি বছরের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রবৃদ্ধির দিক দিয়ে হাইডিলাও বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় রেস্তোরাঁগুলোর একটি। এই দুর্দান্ত দাপট চলমান থাকলে শিগগির সবকটিকে ছাড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব নয় এর পক্ষে।

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top