স্বাদশেকড় I পনির পাঠ
ভোজনরসিকদের অনেকের পছন্দের তালিকার ওপরের দিকেই থাকে। উৎপত্তি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এই অঞ্চলের খাদ্যতালিকায় বহুকাল ধরে জায়গা করে নিয়েছে
কটেজ চিজ বা পনির নিঃসন্দেহে অনেকের পছন্দের ফুড আইটেম। ছানা থেকে তৈরি দুগ্ধজাত খাবার। ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরের শাহি পনির থেকে শুরু করে পশ্চিমের পনির নু শাক, পূর্বের পনিরের ডালনা, দক্ষিণের পনির চেট্টিনাদ—সবই মুখরোচক। মাছ-মাংসের বিকল্প হিসেবে এটি প্রোটিনেরও ভালো উৎস। আমিষ হোক বা নিরামিষ—পনির দিয়ে তৈরি করা যায় নানা লোভনীয় পদ।
খাবারটির উৎপত্তি নিয়ে বিতর্ক আছে। ভারতীয়, আফগান, ইরানি ও পর্তুগিজরা এ খাবার নিজেদের বলে দাবি করেন। তবু সত্য হলো, পনির ভারতীয় উপমহাদেশের স্থানীয় খাদ্য নয়। এর ইতিহাস জানতে পিছিয়ে যেতে হবে ষোড়শ শতাব্দীতে। কথিত আছে, বৈদিক সমাজে গরুকে পবিত্র প্রাণী হিসেবে গণ্য করা হতো বলে দুধে অ্যাসিড ব্যবহার করে দুধ কাটিয়ে ছানা তৈরি করার পদ্ধতিকে অপবিত্র মনে করা হতো। বেদ-এ মাখন, দই ও ঘিয়ের কথা থাকলেও পনির বা ছানার মতো কিছুর উল্লেখ নেই। শোনা যায়, পনিরের ধারণাটি এসেছে ভারতের বাইরে থেকে। স্কটিশ সাংবিধানিক আইনজীবী, সংস্কৃত পণ্ডিত ও ভারতবিদ আর্থার বেরিডেল কিথের মতে, প্রাচীন ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃত স্তোত্রাবলির সংকলন ঋগ্বেদে ৬.৪৮.১৮-এ এক ধরনের পনিরের কথা ‘সম্ভবত উল্লেখ রয়েছে’।
যাহোক, জার্মান ফিলোলজিস্ট অটো শ্রেডার ১৮৯০ সালে বলেন, ঋগ্বেদে শুধু ‘টক দুধের চামড়া বা ল্যাকটোডার্মের উল্লেখ থাকলেও সঠিক অর্থে পনিরের কথা বলা হয়নি।’ বৈদিক সাহিত্যে এমন একটি পদার্থের কথা বলা হয়েছে, যেটিকে ভারতের বিশিষ্ট খাদ্য ইতিহাসবিদ কে টি আচায়া, ওম প্রকাশ এবং সঞ্জীব কাপুর পনিরের সম্ভাব্য রূপ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন; তবে এর পেছনে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ভারমন্টের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞানের অধ্যাপক ক্যাথরিন ডনেলি তার লেখা ২০১৬ সালের বই ‘দ্য অক্সফোর্ড কম্প্যানিয়ন টু চিজ’-এ বলেছেন, বৈদিক সাহিত্য মতে, পনির তৈরিতে ব্যবহৃত হতো পলাশগাছের ছাল, বরইয়ের মতো ফল, জমাট এনজাইমসহ পুঁইশাকের মতো লতা।
চাভুন্দরায় রচিত আদি কৃষিবিষয়ক গ্রন্থ ‘লোকোপকার’-এ গাছপালা ও শিকড় ব্যবহার করে মিষ্টি তৈরির জন্য মহিষের দুধ থেকে তৈরি জমাটবদ্ধ পনিরের দুটি রেসিপি দেওয়া হয়েছে। লেখা অনুসারে, মহিষের দুধ আমরান্থ গাছের শিকড় বা মার্শ বারবেলের পাতা (হাইগ্রোফিলা অরিকুলাটা) ব্যবহার করে জমাট করা হতো। এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত নরম পনিরকে বলা হতো হালুভুগা। দ্বিতীয় রেসিপিতে, মহিষের দুধকে ভারতীয় ম্যালো (অ্যাবুটিলন ইন্ডিকাম) বা দেশীয় ম্যালো (সিডা কর্ডিফোলিয়া) দিয়ে জমাট করে মিষ্টির জন্য বল তৈরির কথা বলা হয়েছে।
দ্বাদশ শতাব্দীতে অধুনা কর্ণাটক ভূখণ্ডের শাসক তথা কল্যাণী চালুক্য রাজা তৃতীয় সোমেশ্বর রচিত ‘মানসোল্লাস’ গ্রন্থে টক পদার্থ ব্যবহার করে সেদ্ধ দুধ আলাদা করার পরে দুধের কঠিন পদার্থ থেকে তৈরি অনুরূপ মিষ্টি খাবারের উল্লেখ রয়েছে। আরেকটি তত্ত্ব অনুযায়ী, পনিরের উৎপত্তি পারস্যের ভূমিতে এবং মুসলিম শাসনের অধীনে তা ভারতীয় উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই তত্ত্ব অনুসারে, দিল্লি সালতানাত এবং মোগল সাম্রাজ্যের অধীনে স্থানীয় স্বাদযোগে বিকশিত হয়েছিল যে খাবার, সেটি বর্তমানে পনির হিসেবে পরিচিত। আরেক তত্ত্ব বলছে, পনিরের উৎপত্তি আফগানিস্তানে; সেখান থেকেই এটি ভারতে ছড়িয়ে পড়ে।
ভারতের ন্যাশনাল ডেইরি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, যেসব আফগান ও ইরানি শাসক ভারত আক্রমণ করেছিলেন, তাদের মাধ্যমে পনির এই উপমহাদেশে প্রসার লাভ করে। ভারতীয় পরম্পরাগত ঔষধি ব্যবস্থা আয়ুর্বেদের এক প্রাচীন গ্রন্থ ‘চরক সংহিতা’র মতো বইপত্রের ওপর ভিত্তি করে বি এন মাথুর লিখেছেন, ভারতে তাপ-অম্ল জমাটবদ্ধ দুধের পণ্যের প্রথম প্রমাণ কুশান-সাতাবাহন যুগে পাওয়া যায়। লেখক সুনীল কুমার এট আল ২০১১ সালের এক লেখায় এই পণ্যকে বর্তমান সময়ের পনির হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। তার মতে, ষোড়শ শতাব্দীতে উত্তর ভারত শাসনকারী পারস্য ও আফগান শাসকেরা পনির খেতেন। সেই সময়ে ছাগল বা ভেড়ার দুধ ব্যবহার করে এ খাদ্য তৈরি করা হতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পনিরও রূপান্তর হয়েছে। এখন আমরা যে খাদ্যকে পনির হিসেবে চিনি, সেটি আসলে সপ্তদশ শতাব্দীতে প্রবর্তিত। আধুনিক পনির যে প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয়, তাতেও অ্যাসিড ব্যবহার করে দুধ কাটিয়ে ছানা করার চল রয়েছে। এই প্রক্রিয়া পর্তুগিজ পদ্ধতি থেকে উদ্ভূত।
জানা যায়, সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলায় বসবাসকারী পর্তুগিজরা দুধ কাটাতে সাইট্রিক অ্যাসিড ব্যবহার করতেন। তারা তাদের দেশীয় তাজা পনির তৈরি করতে এই কৌশল ব্যবহার করেছিলেন। একই সঙ্গে বাঙালিদেরও শিখিয়ে দিয়েছিলেন কৌশলটি। এখনো আমাদের এখানে এই কৌশল অবলম্বনে তৈরি করা হয় পনির।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট