ফিচার I আজব খাদ্যরীতি
দেশ ও জাতিভেদে খাবারের আজব সব রীতি! এই দেশে যা স্বাভাবিক, আরেক অঞ্চলে সেটিই হয়তো চরম অশোভন আচরণ। খাবার টেবিলে কিংবা অতিথি আপ্যায়নে বিশ্বজুড়ে এমন কিছু রীতি আছে, যা বেশ অবাক করে। কিছু আবার প্রাণঘাতী
খাবারের সঙ্গে মানুষের ‘পাগলামি’র কোথায় যেন একটা গভীর সংযোগ আছে। এক দেশের খাদ্যসংশ্লিষ্ট রীতিগুলো দেখে ভিনদেশি লোকদের চোখ কপালে উঠতে পারে। ঠোঁটের কোণে জমতে পারে কৌতুকপূর্ণ হাসি। ডিমের অমলেটের কথাই ধরা যাক। ১৫ হাজার ডিম দিয়ে তা বানানো আপাতদৃষ্টে বাড়াবাড়ি মনে হলেও ফরাসিদের কারও কারও কাছে এটিই উৎসব। ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চল বেসিয়েরেসে প্রতি ইস্টার সানডেতে আয়োজিত হয় এমন ‘ডিমযজ্ঞ’! ১৫ হাজার ডিম দিয়ে তৈরি অমলেটের ছিটেফোঁটার ভাগ পেতে সেখানে ভিড় জমায় অসংখ্য মানুষ। দেশটির গোটাকয়েক শহরে এমন অমলেট ফেস্টিভ্যাল উদ্যাপিত হয়। অক্টোবরে লুইজিয়ানা ও আবেভিলে গেলেই এমন আয়োজনের দেখা পাওয়া সম্ভব।
এই অমলেট উৎসবের পেছনে একটি ইতিহাস রয়েছে। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট নাকি একবার ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চল দিয়ে যাওয়ার পথে বেসিয়েরেসে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেখানকার এক ভোজনালয়ের রসুইকরের বানানো অমলেট খেয়ে তিনি এতই তৃপ্ত হয়েছিলেন, পরের দিনই শহরের সব ডিম নিজের দখলে নিয়ে নেন। এরপর তার সৈন্যবাহিনীর জন্য বিশাল এক অমলেট বানানোর হুকুম দেন। সেই ঐতিহ্যই চলছে বেসিয়েরেসে।
খাদ্যসংশ্লিষ্ট কিছু রীতি দেশ ও জাতিভেদে বেশ আজব মনে হতে পারে। যেমন বাংলাদেশের কিছু জায়গায় কাঁটাচামচ দিয়ে খাওয়াকে ভদ্রতা মনে করা হলেও থাইল্যান্ডের কোথাও কোথাও এ ধরনের কাজকে চরম অভদ্র আচরণ হিসেবে গণ্য করা হয়। তারা মূলত গোলচামচে খাবার তোলার জন্য কাঁটাচামচ ব্যবহার করেন।
শব্দ করে খাবার খাওয়াকে কোথাও কোথাও অসভ্যতা মনে করা হলেও জাপানে বিষয়টি একেবারেই উল্টো। সশব্দে নুডলস ও সুপ খাওয়া সে দেশের ভদ্ররীতি। গবগব করে খেতে পারলে আরও ভালো। এটিই তাদের ঐতিহ্য। জাপানিদের ধারণা, গরম খাবার শব্দ করে খাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। এভাবে খেতে পারলেই দেশটির কিছু অঞ্চলের মানুষ ভোজনকারীকে সভ্য ভাববে।
এদিকে ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যে বাঁ হাত দিয়ে খাওয়া একপ্রকার নিষিদ্ধ বলা চলে। এসব অঞ্চলে ডান হাতে খাওয়াই অভিজাত ও শুভ হিসেবে ভাবা হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার কিছু জায়গায় দেখা মেলে আরেক আজব রীতির। যতক্ষণ না সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি মুখে খাবার তুলবেন, ততক্ষণ টেবিলের কেউ খাওয়া শুরু করেন না। টেবিলে যমজ কেউ থাকলে মিনিট-সেকেন্ড ধরে হিসাব করা হয়—তাদের মধ্যে বড় কোনজন!
ইতালিতে অজানা এক কারণে সি-ফুডের সঙ্গে পনির খেতে মানা। একে একেবারে মহাপাপের শামিল মনে করেন তারা। এ কাজ যিনি বা যারা করেন, তাদের অসভ্য ভাবা হয়। অন্যদিকে, কানাডায় ঘটে আরেক কাণ্ড। দেশটির উত্তরাঞ্চলের কিছু আদিবাসী গোষ্ঠীতে খাওয়ার পর বায়ু ত্যাগ করাই ঐতিহ্য। মেহমান বায়ু ত্যাগ করে আপ্যায়নকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এই বায়ু হলো সম্মান ও শুভেচ্ছার বহিঃপ্রকাশ!
চীনে খাবারের পাত্রে চপস্টিক আটকে রাখাকে অভদ্রতা মনে করা হয়। কেননা তারা এই পদ্ধতিতে মৃতের প্রতি আচারানুষ্ঠানিক খাবার উৎসর্গ করেন। তা ছাড়া চপস্টিক নাড়িয়ে কাউকে ডাকা, কারও দিকে তাক করে কথা বলা কিংবা তা দিয়ে খাবারের পাত্রে শব্দ করাকে ভীষণ বাজে স্বভাব বলে গণ্য করেন চীনারা।
আজব খাদ্যরীতিগুলোর মধ্যে খালি প্লেটের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ভারত ও জাপানে খাবার শেষ করে প্লেট খালি করাই সভ্য আচরণ। কিন্তু চীনে আবার একেবারেই বিপরীত নিয়ম। সে দেশে প্লেট খালি রাখার মানে ভোজনকারীর খাওয়া এখনো বাকি অথবা তাকে ঠিকমতো খাওয়ানো হয়নি। অন্যদিকে বেদুইন সংস্কৃতিতে খাবার পেয়ালা শেষ হওয়া মাত্রই পূর্ণ করে দেওয়ার রীতি। না দেওয়াকে অশোভন আচরণ ভাবেন তারা। পানকারী যতক্ষণ পর্যন্ত না নিজে নিষেধ করেন, ততক্ষণ পানীয় দেওয়া হয় পেয়ালায়।
খাবার নিয়ে কতক পাগলামি এখন কিছু জাতির মধ্যে প্রায় ঐতিহ্য হয়ে গেছে। তারা এমন কিছু রীতি পালনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, যেগুলো অনেক সময় প্রাণঘাতী। তবু ওসব কাজ করা এবং প্রতিবছর নিয়ম করে নির্দিষ্ট সময়ে ওসব খাওয়া তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। যেমন ইংল্যান্ডের ডরসেটে রসুন নিয়ে ঘটে এক কাণ্ড। সেখানকার চিডিওক নামের ছোট একটি গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় কাঁচা রসুন খাওয়ার প্রতিযোগিতা। ওই গাঁয়ে রয়েছে রসুনের একটি খামার। সেখানেই প্রতিবছর ‘বিশ্ব রসুন খাওয়া প্রতিযোগিতা’ অনুষ্ঠিত হয়। অংশগ্রহণকারীদের এক মিনিটের মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক কাঁচা রসুনের কোয়া চিবিয়ে খেয়ে হয়। শর্ত হলো, কোয়া গেলা যাবে না; চিবিয়েই খেতে হবে, যাতে এর ঝাঁজ বেরিয়ে আসে। এ সময় পানি পানও নিষেধ। অতীতে রসুন খেতে মিনিট পাঁচেক সময় দেওয়া হতো। এখন তা কমিয়ে এক মিনিটে নামিয়ে আনা হয়েছে। এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের শরীর থেকে পরের চার-পাঁচ দিন রসুনের গন্ধ বেরোয়। তা দূর করতে অনেক হ্যাপায় পড়তে হয় তাদের।
রসুনের মতো মরিচ খাওয়ার প্রতিযোগিতা হয়, ঐতিহ্যগতভাবেই। দেশ-বিদেশের অনেক জায়গায় ঝাল খাওয়ার বাজি ধরা হয়। এসব বাজি ধরে মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরার ঘটনাও শোনা গেছে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত একটি মেডিকেল জার্নালে এমন এক ব্যক্তির কথা উঠে আসে, যিনি একটি প্রতিযোগিতায় বিশ্বের অন্যতম ঝাল ‘ঘোস্ট পিপার’ খেয়েছিলেন। এ ধরনের মরিচে স্কোভিলের পরিমাণ ১ মিলিয়নের বেশি! স্কোভিল হলো ঝাল পরিমাপের একক। সুইট পিপারে এর পরিমাণ শূন্য। জালাপিনো মরিচে তা থাকে প্রায় ৫ হাজার ইউনিট। ঘোস্ট পিপার খাওয়ার পর ওই ব্যক্তি নাকি ক্রমাগত বমি শুরু করেছিলেন। এমনকি হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়েছিল তাকে। অতিরিক্ত বমির ফলে তার খাদ্যনালিতে ছিদ্রের সৃষ্টি হয়েছিল। মারাও যেতে পারতেন তিনি। তবে ভাগ্যগুণে বেঁচে ফিরেছিলেন।
পানি নিয়েও এমন কাণ্ড ঘটে। ২০০৭ সালে পানি পানের একটি ঘটনা উঠে আসে খবরে। ঠিক কোথায় ঘটেছিল, তা অজানা। তবে ওই প্রতিযোগিতার কথা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের প্রতি শর্ত ছিল, প্রতি ১৫ মিনিট পরপর প্রায় ১ কাপ পানি পান করতে হবে। এ সময় কেউ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলে সে হেরে যাবে। প্রতিযোগিতার শুরুতে বড় বড় পানির বোতল দেওয়া হয়। স্ট্রেঞ্জ নামের এক প্রতিযোগী সেবার প্রথম হয়েছিলেন। ২ গ্যালন পানি পান করেছিলেন তিনি। তাতে তার পেট প্রচণ্ড ফুলে গিয়েছিল।
পানি পানের কিছুক্ষণের মধ্যে তার মাথাব্যথা শুরু হয়। পরে বাসায় ফিরে ওয়াটার ইনটক্সিকেশনে মারা যান তিনি। একে হাইপোনাট্রেমিয়াও বলে। অতিরিক্ত পানি পানের ফলে শরীরের লবণ কমে যায়। তখন শুরু হয় মাথাব্যথা ও বমিভাব। মস্তিষ্ক ফুলে গিয়ে ফুসফুসে তরল জমতে থাকে। এতে মগজে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। তাই শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যান আক্রান্ত ব্যক্তি।
আহমেদ সজিব
ছবি: ইন্টারনেট