skip to Main Content

ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I ইচ্ছে পুতুল

অতীত কেটেছে অন্দরমহলে। প্রিয়জনের সান্নিধ্যের আকর্ষণে। এবার অবস্থান জনসমক্ষে। নারীত্বের দারুণ জয়জয়কারে। মূলমন্ত্র একই, তবে নকশায় নতুনত্ব নিয়ে। প্রত্যাবর্তনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড়

এ লাইন ফ্রক। হেমলাইন শেষ হয় হাঁটুর ওপরে। সিল্ক অথবা নেটে তৈরি। স্লিভলেস, কখনো পাফ স্লিভে আরাম-আরাম অনুভূতি। তাতে মাঝেমাঝে ফ্রিলের সংযুক্তি। বাহুল্যবর্জিত। গঠনগত নকশায় আবেদন। একসময় নাইটি হিসেবে পরিচিত ছিল এই পোশাক—বেবি ডল। আবেদনময় আউটারওয়্যার হিসেবেই গণ্য হতো। বিশ্বব্যাপী চাহিদা তৈরি হয়েছিল। কনের স্যুটকেসে একটি রঙিন বেবি ডল নাইটি মাস্ট হ্যাভ হিসেবে গুরুত্ব পেত। এখন সেখানে আমূল পরিবর্তন। শুধু শোয়ার ঘরের চারদেয়ালে আটকে থাকার দিন শেষ। সামার ড্রেস হিসেবে ফিরে এসেছে। শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে জানান দিচ্ছে সবাইকে।
শাভানা কলেজ অব আর্টের অধ্যাপক এবং ইতিহাসবিদ সারাহ্ কলিন্সের গবেষণালব্ধ তথ্য পাওয়া যায় অন্তর্জালের কল্যাণে। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘বেবি ডল থিমের পোশাক কবে থেকে তৈরি ও ব্যবহার শুরু হয়েছে, তা সেভাবে জানা যায় না। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময় খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। তবে প্রথমবারের মতো শব্দটি ব্যবহৃত হয় ১৯১২ সালে। অ্যাভেরি অ্যাবোট নামের এক লেখকের বইয়ের পাতায়। আবার বর্তমান সময়ে বেবি ডল ট্রেন্ডের যে সিলুয়েট, তা ১৯৩০ সালের লঞ্জারের নকশার একটি সংস্করণ বলা যেতে পারে।’ কলিন্সের মাধ্যমে আরও জানা যায়, বেবি ডল থিমে অনেক আগে থেকে পোশাক তৈরি হতো। পোশাকগুলোর হেমলাইন হাঁটুর ওপরে শেষ হয়ে যেত। জনসমক্ষে এ ধরনের নকশার গ্রহণযোগ্যতা কম ছিল; বরং বেডরুম পরিধান উপযোগী পোশাক হিসেবে ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলেন তখনকার ফ্যাশনিস্তারা।
কম দৈর্ঘ্যরে বেবি ডল থিম আদতে মেয়েলি এবং আদুরে হলেও জনপ্রিয়তার পেছনে আছে যুদ্ধের ইতিহাস। ১৯৩৯ সালে শুরু হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন সরকার ফ্যাব্রিক ব্যবহারে লাগাম টানার চেষ্টা করে। যতটা সম্ভব কম কাপড় ব্যবহার করে মেয়েদের পোশাক তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়; যা এল-৮৫ ওয়্যারটাইম রেশনিং হিসেবে পরিচিত। সেই দুর্যোগকালে আমেরিকান ডিজাইনার সিলভিয়া পেডলার তার ব্র্যান্ড আইরিশ লঞ্জারের রাতের পোশাকের দৈর্ঘ্য কমিয়ে আনেন। কলিন্সের ভাষ্যে, ডিজাইনার সিলভিয়া ব্যক্তিগতভাবে বেবি ডল শব্দটি ব্যবহারের বিপক্ষে ছিলেন বলে জানা যায়। নকশাটির ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ১৯৫৬ সালে। কারণ—চলচ্চিত্র। ব্ল্যাক কমেডি মুভি ‘বেবি ডল’ তখন সিলভার স্ক্রিনে প্রদর্শিত হয়। আবেদনময় এই নকশার পোশাক পরে লাস্যময়ী লুকে পর্দায় হাজির হয়েছিলেন নায়িকা। দর্শকদের মাঝে সাড়া তৈরি করে সেই পোশাক।
পরবর্তী সময়ে ১৯৫৮ সালে ব্র্যান্ড ব্যালেন্সিয়াগা বিশেষ ভূমিকা রাখে এটির প্রচলনে। নকশার মূল সূত্র ঠিক রেখে নিয়ে আসে দারুণ কিছু পরিবর্তন; যা এই পোশাককে একঘেয়েমি থেকে বের করে আনে। প্যারিসের এই লাক্সারি ব্র্যান্ড সে বছর বাজারে আনে বেবি ডল প্রাণিত ডে এবং ইভনিং ওয়্যার। ট্রেপেজ ড্রেস হিসেবে পরিচিতি পায় সেগুলো; যা পরে সুপার শর্ট এ লাইন ড্রেস তৈরিতে ভূমিকা রাখে। পোশাকগুলোতে পষ্ট প্রকাশ ছিল বালিকাসুলভ অবুঝপনা, দুরন্ত আবেগ আর নারীর স্বাধীনতার। পরবর্তী সময়ে জিভাঁশি যুক্ত হয় এই কাতারে। ১৯৬০ সালে পোশাকটির প্রতি আগ্রহের পালে হাওয়া লাগে। দৈর্ঘ্য আরও কমে আসে। ফ্যাশন ঘুরেফিরে আসে, এই তত্ত্বকে আরও শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যেই বোধ হয় আকর্ষণীয় পোশাকটির পুনরাবির্ভাব ঘটে।
সময়কাল ১৯৯০, আন্ডারগ্রাউন্ড ফেমিনিস্ট পাংক মুভমেন্ট ‘রায়ট গার্ল’ দারুণ আলোচনায়। যেখানে উঠে আসে তৎকালীন সামাজিক চাহিদা। বিদ্রোহীদের মতানুযায়ী সমাজ মেয়েদের কাছে বিপরীতধর্মী আচরণ আশা করে। তারা একই সঙ্গে চায় একজন নারী ‘ভালো মেয়ে’ হবেন আবার আবেদনময়ী রূপেও ধরা দেবেন। নারীরা তখন নিজের মতো করে বাঁচতে আগ্রহী। পারিবারিক, সামাজিক শিকল খুলতে বদ্ধপরিকর। জোর করে তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া আবেগ-নিষেধ-নির্দেশের বোঝা নামিয়ে রাখতে শুরু করেছেন। লুট হয়ে যাওয়া অতি গুরুত্বপূর্ণ যৌন স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বেবি ডল থিমে তৈরি পোশাকের বিষয়েও তারা তখন কথা বলেছেন। আবেদনময়তার ট্যাগ সরিয়ে শুধু একটি পোশাক হিসেবে পরিধান করতে চেয়েছেন। বেবি ডল তখন থেকে আর শুধু নাইটি নয়; বরং সামার স্ট্যাপল।
নব্বইয়ের দশক পার হয়ে আবার ২০২৩ সালে বেবি ডলে মজে ফ্যাশন বিশ্ব। ক্রেতার বড় অংশ জেনারেশন জেড। তাদের মনোভাব, চাহিদা, আকর্ষণ সম্পূর্ণ ভিন্ন, তা ফ্যাশন দুনিয়া বুঝে গেছে ইতিমধ্যে। শুধু অনুমান নয়, প্রমাণও প্রকট। বর্তমান সময়ের সোশ্যাল মিডিয়ায় বেবি ডল ইন্সপিরেশন খুঁজলে বোঝা যায়, এবারের ফিরে আসা নতুনত্বে ভরপুর। যারা এখন এই থিমে কাজ করে নজর কেড়েছেন, তাদের মধ্যে ড্যানিশ ডিজাইনার সিসিলি বানসেন অন্যতম। তিনি বেবি ডল থিমের ড্রেসে যৌনতা, লাস্যতার মতো ইঙ্গিত প্রকাশের বিরুদ্ধে। তার নকশার পোশাকগুলো বডি ফোকাসড নয়। বছরজুড়ে পরে নেওয়া যাবে অনায়াসে। আবার স্টাইলিংয়ের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা উপভোগ করা সম্ভব। এ বিষয়ে বানসেনের মতামত পাওয়া যায় ইন্টারনেটে। তিনি বলেছেন, ‘আমার মনে হয়েছে, মেয়েরা সেই পোশাকগুলো পছন্দ করে, যেগুলো একই সঙ্গে তাদেরকে একজন স্বাধীন নারীর অনুভূতি দেয়।’ এবারের স্প্রিং-সামার কালেকশনে নিজের এই চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি। নারীত্বকে আলিঙ্গনের উৎসবের আলোকচ্ছটা বেবি ডল থিম ঘিরে। এই পোশাকে তৈরি হওয়ার জন্য আলাদা করে কোনো ইভেন্ট জেন জিদের কাছে জরুরি নয়; বরং তাদের কাছে এই পোশাকই যেন উল্লাসের কারণ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটক ট্রেন্ড সেটিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ইদানীং। বেবি ডলেও ব্যতিক্রম নয়। প্রায় ১৭০ মিলিয়ন পোস্ট আছে বেবি ডল হ্যাশট্যাগে। ওয়ান পিস হিসেবে তো বটেই, লুস প্যান্টের সঙ্গে পেয়ার আপেও দেখা যাচ্ছে। ফুটওয়্যারে স্নিকারের সঙ্গে স্বছন্দ খুঁজে পাওয়া গেছে বলে ধারণা করা যায়। অতিরঞ্জন নেই, বরং আছে যত্নের ছোঁয়া। এভরি ডে কতুরের ধারণা যেমন প্রতিদিনের পোশাককে নান্দনিক করে তোলার, তার সঙ্গে মিল আছে এই নতুন ধারার। হাইপার ফেমিনিটির দারুণ প্রকাশ এই বেবি ডলে। পোস্ট-প্যানডেমিক ফ্যাশন বাজার নারীত্বকে বরণ করেছে মন খুলে। এখানেও তারই ছাপ।
শেষ কথায় ফিরে যাওয়া যাক সারাহ কলিন্সের কাছে। বিখ্যাত ফ্যাশন ম্যাগাজিন এল-এ এক সাক্ষাৎকারে বেবি ডল সম্পর্কে তিনি বলেছেন, একটি মেয়ের পোশাক নিয়ে গঠনমূলক চিন্তার মাধ্যমে পাওয়া যেতে পারে তার যাপিত জীবনের গল্প। কারণ, স্টাইল মূলত ব্যক্তিত্বের প্রকাশ।
বেবি ডল নারীজীবনের দৃপ্ততাকে আলিঙ্গন করে। সাহসী পদক্ষেপে এগিয়ে রাখে। বেবি ডল শব্দটি আদুরে আর অবুঝ মনে হলেও আদতে তা মোটেই নয়; বরং এখানে আছে আরামের স্পর্শ আর সৌন্দর্যের দ্যুতি। দুইয়ের পাশাপাশি অবস্থানে মন কেড়েছে তরুণ প্রাণের।

 সারাহ্ দীনা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top