ফুডচেইন I লাকি লাকিন
লাকিন কফি। দারুণ উত্থানের পর চরম পতনের অভিজ্ঞতালব্ধ; ভাগ্যিস, তবু থামতে নারাজ
ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে দুর্দান্ত দাপট দেখানো চীনা কফি কোম্পানি ও কফি হাউস চেইন লাকিন কফি ২০২০ সালের এপ্রিলে হিসাবরক্ষণ-সম্পর্কিত কেলেঙ্কারির কারণে বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এনএএসডিএকিউ (ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব সিকিউরিটিজ ডিলারস অটোমেটেড কোটেশনস) স্টক এক্সচেঞ্জে তার বেশির ভাগ বাজার মূলধন হারায়। শেয়ারের দাম প্রায় ৯৫ শতাংশ কমায় শেয়ার লেনদেন স্থগিত হয়ে যায়; এমনকি শেষ পর্যন্ত এনএএসডিএকিউ স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে ডিলিস্টিং হওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। এসবের নেপথ্য কারণ কী ছিল?
পুরো কেলেঙ্কারির মূল কারণ ছিল আগের বছরের রাজস্ব আংশিকভাবে মিথ্যা উপস্থাপন করা এবং প্রায় ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ইউয়ান বা ৩১০ মিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত দেখানো। কেলেঙ্কারিটি একেবারেই ব্যতিক্রমী এই কোম্পানির একটি বড় পতন ত্বরান্বিত করে। তারা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জেনি ঝিয়া কিয়ানকে বরখাস্ত করে, যিনি উল্লেখযোগ্য চীনা ইউনিকর্ন নারী উদ্যোক্তাদের অন্যতম।
২০২০ সালের এই কেলেঙ্কারির আগে লাকিন কফির বিকাশ ও মাইলফলকের কিছু দিক একঝলকে জেনে নেওয়া জরুরি:
২০১৭ সালের অক্টোবরে চীনের বেইজিংয়ে এর প্রথম স্টোর খোলা হয়।
পরের বছরের জানুয়ারিতে দেশটির ১৩টি শহরে খোলা হয় স্টোর; এ সময়ে তাদের বার্ষিক অর্ডারের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ মিলিয়ন এবং গ্রাহকসংখ্যা ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন।
সেই বছরের এপ্রিলে লাকিনের অ্যাপটি চীনের অ্যাপল অ্যাপ স্টোরে খাদ্য ও পানীয়ের ব্র্যান্ডের মধ্যে ১ নম্বরে উঠে আসে।
একই বছরের মে মাস নাগাদ কফি হাউস চেইনটির ৫২৫টি স্টোর চালু হয়।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে তারা প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করে, যার বাজারমূল্য ছিল ১ বিলিয়ন ডলার।
২০১৯ সালের মে মাসে এনএএসডিএকিউতে তালিকাভুক্ত হয়; তখন তাদের কাছে ছিল ৬৯৫ মিলিয়ন ডলার, যার বাজারমূল্য ৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার।
সেই বছরের জুলাইতে তারা চায়ের বাজারে প্রবেশ করে।
একই বছরের ডিসেম্বরে তাদের স্টোরসংখ্যা দাঁড়ায় ৪ হাজার ৫০৭।
২০২০ সালের এপ্রিলে আর্থিক হিসাবে গরমিলের কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে শেয়ার কেনাবেচার নিষেধাজ্ঞায় পড়ে।
এত বড় কেলেঙ্কারি কাটিয়ে এখনো তারা কীভাবে মার্কেটে প্রভাব বিস্তার করছে? ব্র্যান্ডিং, পরিচ্ছন্ন কার্যকলাপ ও উদ্ভাবনী প্রযুক্তির চমৎকার সংমিশ্রণে ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র তিন বছরে কোম্পানিটির প্রবৃদ্ধি ও সাফল্য ছিল ঈর্ষণীয়। বিদ্যমান ব্যবসায়িক মডেলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে, প্রযুক্তিগত বিকাশ ও অন্যান্য ব্যবসায়িক ধারণার তুলনায় একে আরও উন্নত ও আধুনিক করে তোলার ক্ষেত্রে লাকিন কফির সক্ষমতা দুর্দান্ত। অবিশ্বাস্য বৃদ্ধির একটি উদাহরণ হলো, আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল কফি হাউস চেইন স্টারবাকস দুই দশকে সারা দুনিয়ায় যত স্টোর খুলেছে, ২০১৮-২০২০ সময়কালে চীনে তার চেয়েও বেশি স্টোর খোলার অনন্য নজির দেখিয়েছে লাকিন কফি।
বৈপ্লবিক প্রযুক্তিগত ধারণা, ব্যবসায়িক মডেল প্রবর্তনে সময়ের চেয়ে আগুয়ান পরিকল্পনা প্রভৃতি লাকিন কফিকে চীনা বাজারে আধিপত্য বিস্তারে সাহায্য করেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—
শুধু ফোনের মাধ্যমে অর্ডার: লাকিন কফি থেকে কফি কেনার একমাত্র উপায় হলো এর অ্যাপের মাধ্যমে অর্ডার দেওয়া। ফোন ছাড়া অর্ডার করা সম্ভব নয়। তবে এটি তেমন বড় সমস্যা নয়; কেননা, লাকিন কফির টার্গেট গ্রুপ সব সময় নিজেদের সঙ্গে ফোন রাখে। কফি নির্বাচনের পর পণ্যের স্পেসিফিকেশন, যেমন চিনির পরিমাণ অথবা গরম নাকি ঠান্ডা হবে; তা অ্যাপের মাধ্যমে নির্বাচন করা হয়। অর্ডার করার প্রক্রিয়া শেষে অ্যাপে উইচ্যাট, আলিপে, লাকিন কফি ব্যালেন্স অ্যাকাউন্ট বা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করতে হয়। মূলকথা, সম্ভাব্য নগদ অর্থ প্রদান এড়িয়ে যাওয়া হয় এতে। এরপর গ্রাহককে পিকআপ টাইম দেওয়া হয় আনুমানিক ৩ মিনিট; আর একটি পুশআপ নোটিফিকেশনে জানিয়ে দেয়, কফি পিকআপের জন্য প্রস্তুত কি না। অ্যাপটিতে একটি কিউআর কোড প্রদর্শিত হয়, যা কফি তোলার সময় স্ক্যান করা চাই। এই পদ্ধতির প্রধান সুবিধা, এতে গ্রাহকের সময় বেশ সাশ্রয় হয়; কেননা, কফি প্রস্তুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দোকানে প্রবেশ করতে পারেন তিনি। এই প্রক্রিয়ায় কফি প্রস্তুত হওয়ার জন্য সারিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয় না।
বিজ্ঞাপন, পুশ নোটিফিকেশন, কুপন: অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধনের সুবিধা হলো, এতে ব্যবহারকারীর সঙ্গে লাকিন কফির সরাসরি যোগাযোগের চ্যানেল তৈরি হয়। স্ট্যাটিসটিকা ২০১৩-এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ৫০ শতাংশ গ্রাহক সাধারণত পুশ নোটিফিকেশনটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠোদ্ধার করেন। এই চ্যানেলের মাধ্যমে গ্রাহককে নতুন পণ্য সম্পর্কে অবহিত করা, কুপন প্রদান কিংবা ডিসকাউন্টের মতো বিষয়গুলো জানিয়ে দিতে লাকিন কফি প্রচারমূলক নোটিফিকেশন পাঠায়। এই সম্ভাব্য যোগাযোগ ব্যবহারকারীর সঙ্গে সংযোগ বজায় রাখতে এবং বারবার ফিরে আসতে উৎসাহিত করার কার্যকরী একটি পন্থা।
কমিউনিটি অ্যাপ্রোচ: অ্যাপের ফিচার এবং লাকিন কফির পণ্যগুলোর সঙ্গে ব্যবহারকারীর যোগাযোগকে আরও উন্নত করতে অ্যাপে কমিউনিটির বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক দিক অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যেমন বন্ধুকে বিনা মূল্যে কফি কার্ড পাঠানো থেকে শুরু করে কফির পানের নিমন্ত্রণ জানানোর সুযোগ। ডিজিটাল মেম্বারশিপ কার্ডও দেওয়া হয়, যাতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর কিছু কুপন পাওয়া যায়। আরেকটি উদাহরণ হলো, আপনি যদি লাকিন কফিতে এমন কোনো নতুন গ্রাহক নিয়ে আসেন, যিনি আগে কখনো এই অ্যাপ ব্যবহার করেননি, তাহলে আপনি ও আপনার বন্ধু বিনা মূল্যে একটি করে কফি ড্রিংক পাবেন।
ডেলিভারি সার্ভিস: নিয়মিত পিকআপ পরিষেবার পাশাপাশি লাকিন কফি অ্যাপটি সমস্ত কফি ও নন-কফি পণ্য সরবরাহের নিশ্চয়তা দেয়। ডেলিভারি তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে দেওয়া হলেও সব গ্রাহকের সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকশন লকিন কফি অ্যাপের মাধ্যমেই করা হয় বলে এই অ্যাপের লেআউট বিশেষভাবে গ্রাহকদের প্রয়োজন অনুসারে তৈরি করা হয়েছে। ডেলিভারি সার্ভিসের জন্য সবচেয়ে নামকরা খাদ্য সরবরাহকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করে এই ফুড চেইন। প্রক্রিয়াটি এতই গ্রাহকবান্ধব, ফলে এটি যে একটি ইন্টার-কোম্পানি কর্মকাণ্ড, তা গ্রাহকেরা হয়তো খেয়ালই করেন না।
অন্যান্য খুচরা পণ্য বিক্রি: কফি পণ্য ছাড়াও অংশীদার কোম্পানির পণ্য বিক্রি এবং একটি মার্কেটপ্লেস হিসেবে কাজ করে লাকিন কফি। খাঁটি কফি ছাড়াও তারা কিছু প্রাতরাশ ও অন্যান্য খাদ্যপণ্য বিক্রি করে। কফি কাপের মতো কফির সঙ্গে সম্পর্কিত পণ্যের পাশাপাশি অ্যাপলের এয়ার পডসের মতো পণ্যও পাওয়া যায় লাকিনের অ্যাপে। তার মানে, অ্যাপটি শুধু একটি অর্ডারিং প্ল্যাটফর্ম নয়, বরং গ্রাহকপিছু মোট আয় বাড়ানোর ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মও। একজন ব্যবসায়িক গ্রাহক হিসেবে এখানে একটি ভেন্ডিং মেশিনও অর্ডার করতে পারবেন, যা আপনার অফিসে লাকিন কফি ইনস্টল করে দেবে এবং সেটির সার্বিক তত্ত্বাবধান করবে। এটি লাকিন কফির জন্য একটি বিজনেস-টু-বিজনেস (বিটুবি) আয়ের প্রবাহ তৈরি করে।
ভিডিও লাইভস্ট্রিম: চীনের শিথিল ডেটা প্রোটেকশন রেগুলেশনের কারণে অনেক কফি শপ লাইভস্ট্রিম ফাংশন অফার করে, যেখানে গ্রাহক দেখতে পারেন কীভাবে কফি প্রস্তুত করা হচ্ছে। এমন অভিজ্ঞতাকে জার্মানির মতো ইউরোপীয় অনেক দেশে অদ্ভুত কাণ্ড মনে হতে পারে; তবে চীনে একে স্রেফ গ্রাহক পরিষেবা ফাংশন হিসেবে দেখা হয়।
লাকিন কফি একটি নতুন উচ্চাভিলাষী চীনা কোম্পানি হিসেবে অনুপ্রেরণামূলক উদাহরণ, যা অনন্য ও উন্নত গ্রাহক অভিজ্ঞতা তৈরি করতে নতুন প্রযুক্তিগত পদ্ধতি ব্যবহার করে। পুরো ধারণাটি বৈপ্লবিক। লাকিন কফির সার্বিক সাফল্যে এটি ভূমিকা রেখেছে। অবশ্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কোম্পানিটি বিপুল পুঁজি হারিয়ে ঘাটতির মুখে পড়েছিল। হিসাব কেলেঙ্কারির কারণে দেউলিয়া হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছিল এবং ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয় নতুন মূলধন সংগ্রহ করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবু নতুন প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে তারা থেমে যায়নি।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট