স্বাদশেকড় I খিচুড়ি খুশবু
খাদ্যরসিক বাঙালির বর্ষাকাল মানেই যেন খিচুড়ি খাওয়ার ধুম! এর আভিধানিক অর্থ ‘বৈসাদৃশ্যময় উপকরণে তৈরি মিশ্র খাদ্য’
খিচুড়ি। ভাত ও ডালযোগে রান্না করা খাবার। প্রাথমিকভাবে চাল ও মসুর ডাল দিয়ে তৈরি; তবে বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে বৈচিত্র্য। ভারতীয় উপমহাদেশে মসুরের ডাল ছাড়াও স্থান ও কালভেদে মুঞ্জ বা মুগ ডাল ভাতের সঙ্গে সেদ্ধ করে মাখন মিশিয়ে খাওয়ার চল ছিল। তারা একে কুশারি বলত এবং প্রতিদিন সকালের নাশতায় উপভোগ করত। মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা চতুর্দশ শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশে ভ্রমণ করেছিলেন। খিচুড়ি খেয়ে এর স্বাদের উল্লেখ করেছেন ইতিহাসসম্পর্কিত লেখায়। এ খাবার প্রস্তুতিতে চাল ও ডাল, নির্দিষ্ট করে মুগ ডালের কথা বলেছেন তিনি। অন্যদিকে, রুশ বণিক, অভিযাত্রী ও লেখক আফানাসি নিকিতিন ছিলেন ভারতে ভ্রমণকারী প্রথম ইউরোপীয়দের একজন। ১৪৬৯ সালে ভ্রমণকাহিনিতে লিখেছিলেন, কীভাবে তার ঘোড়াগুলোকে ‘ডাল ও খিচুড়ি’ খাওয়ানো হয়েছিল। তার লেখা থেকে জানা যায়, ভাত দিয়ে তৈরি এই খাবারে চিনি ও ঘি মেশানো হতো। সপ্তদশ শতাব্দীতে ফরাসি পর্যটক ও রত্ব ব্যবসায়ী জ্যঁ-বাপ্তিস্ত তাভার্নিয়ে ছয়বার ভারতে আসেন। তিনি খেয়াল করেন, সবুজ মসুর ডাল, চাল ও ঘি দিয়ে খিচুড়ি তৈরি করা হয়। একে তিনি ‘কৃষকের সন্ধ্যার খাবার’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তার মতে, সে সময় ভারতের প্রায় সব বাড়িতেই খিচুড়ি খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। অন্যদিকে, সুদূর অতীতে তাকালে দেখা যায়, ৩০৫ ও ৩০৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে ভারতে কিছু ধর্মযুদ্ধ হয়। সে সময়কার গ্রিক জেনারেল ও তৎকালীন সেলুকিড সাম্রাজ্যের সম্রাট সেলুকাস উল্লেখ করেন, ভারতীয় উপমহাদেশে তখন চালের সঙ্গে ডাল মেশানো খাবার খুব জনপ্রিয় ছিল।
বিভিন্ন সময়কালের নানা বিষয় পর্যালোচনা করে এ দাবি করাই যায়, খিচুড়ির থালা বহু শতাব্দী ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে টিকে রয়েছে। ইরানি পণ্ডিত ও বহুবিদ্যাবিশারদ আল বেরুনিও [৯৭৩-১০৫০ আনুমানিক] তার ‘ভারততত্ত্ব’ গ্রন্থে খিচুড়ির প্রসঙ্গ বাদ দেননি। প্রাচীন ভারতীয় অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক ও রাজ-উপদেষ্টা চাণক্যের [খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০-২৮৩ আনুমানিক] লেখা থেকে মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সময়কালে এ খাবারের উল্লেখ মেলে। ‘খিচুড়ি’ শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ‘খিঁচা’ থেকে এসেছে। প্রাথমিকভাবে চাল ও মসুর থেকে তৈরি করা বাজরা খিচুড়ি ও মুগ খিচুড়ি তুমুল জনপ্রিয় ছিল। সনাতন সংস্কৃতিতে শিশুরা প্রথম শক্ত যে খাবার খায়, সেটিও একধরনের খিচুড়ি।
অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ডিশ কেজরির পেছনেও অনুপ্রেরণা হিসেবে খিচুড়ি কাজ করেছে। কেজরি রান্না করা হয় ফ্লেকড মাছ (ঐতিহ্যগতভাবে স্মোকড করা হ্যাডক), সেদ্ধ চাল, পার্সলে, সেদ্ধ ডিম, কারি পাউডার, মাখন বা ক্রিম এবং কখনো কখনো সুলতানা (বীজহীন আঙুরবিশেষ) দিয়ে। লাল মরিচ ব্যবহারে তৈরি কেজরির এমন একটি স্কটিশ রেসিপিও পাওয়া যায়। খাদ্য ইতিহাসবিদদের মতে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্মকর্তারা এবং তাদের আত্মীয়রা এ খাবার ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে নিজেদের দেশে নিয়ে যান।
ভারতীয় উপমহাদেশে উদ্ভূত বিভিন্ন খাবারে ধর্মীয় ইতিহাস জুড়ে দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। এর মধ্যে মহাভারতে খিচুড়ির প্রথম উল্লেখ মেলে। প্রাচীন ভারতের অন্যতম প্রধান এই মহাকাব্য অনুসারে, খিচুড়ির সঙ্গে সম্পর্কিত ঘটনাগুলো সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব নবম ও অষ্টম শতাব্দীর।
খিচুড়ি ব্যাপক খ্যাতি লাভ করে মোগল সাম্রাজ্যের সময়কালে। সম্রাট আকবর [১৫৪২-১৬০৫] খুব সামান্য পরিমাণে খাবার গ্রহণ করলেও খিচুড়ি বেশ পছন্দ করতেন। আকবরের দরবারি আবুল ফজল ও খিচুড়ির সঙ্গে তার সম্পর্কের একটি দারুণ ঘটনা রয়েছে। ফজল প্রতিদিন ৩০ মণ খিচুড়ি রান্না করতেন এবং তার বাড়ির পাশ দিয়ে গেলে যে কেউ চাইলে তা খেতে পারত। ভারতীয় খাদ্য ইতিহাসবিদ কে টি আচায়ার মতে, লাজিজাঁ নামে একটি খাবার সম্রাট জাহাঙ্গীর [১৫৬৯-১৬২৭] খুব পছন্দ করতেন, যেটি ছিল মূলত খিচুড়ির গুজরাটি সংস্করণ। সম্রাট আওরঙ্গজেবও [১৬১৮-১৭০৭] থালাটি বেশ পছন্দ করতেন; বিশেষ করে রমজানের সময় এটি ছিল তার কাছে নির্ভরযোগ্য খাবার। মোগল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর [১৭৭৫-১৮৬২] মুগ ডালের খিচুড়ি খেতে এতই পছন্দ করতেন, খাবারটি ‘বাদশা পাসন্দ’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল।
১৮২৭ থেকে ১৮৩৭ সাল পর্যন্ত অযোধ্যার নবাব নাসির-উদ-দিন শাহ তার শেফের তৈরি একটি রাজকীয় খিচুড়ি পছন্দ করতেন। তাতে মসুর ও চালের দানার আকারে পেস্তা ও বাদামকে কুচিয়ে ফেলা হতো।
ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে, ভিক্টোরিয়ান যুগে [১৮৩৭-১৯০১] ইংল্যান্ডের হেঁসেলে ঢুকে পড়ে খিচুড়ি। রানি ভিক্টোরিয়ার শাসনামলে এটি ছিল বিশেষ এক পদ। রানিকে এর স্বাদ চেখে দেখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তার উর্দু গৃহশিক্ষক মুন্সি আব্দুল করিম। অনুষঙ্গ হিসেবে চালের সঙ্গে মসুর ডাল মেশানো পছন্দ করতেন রানি। এভাবেই ডালটি ‘মালিকা মাসুর’ নামে পরিচিতি পায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে মিসরীয়দের মধ্যে ‘কুশারি’ নামে একটি পদ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এটি তৈরি করা হতো চাল, ডাল, চানা, ভিনিগার, টমেটো সস, পেঁয়াজ, আদা, রসুন প্রভৃতি উপকরণ দিয়ে। রন্ধনপ্রণালি হিসেবে এই কুশারিকে খিচুড়ির ভিন্ন রূপ বলা যেতে পারে।
বর্তমানে আমাদের উপমহাদেশের প্রতিটি অঞ্চলের ক্ল্যাসিক এই খাবারের রয়েছে নিজস্ব বৈচিত্র্য। বাঙালি খিচুড়ি, কান্নাডিগা বিসি বেলে খিচুড়ি, তামিল পোঙ্গাল, হরিয়ানভি খিচুড়ি (বাজরা দিয়ে তৈরি), পারসি ভারুচি বাঘরেলি খিচুড়ি (ম্যারিনেট করা ও ভাজা বোম্বাই হাঁস ব্যবহার করে তৈরি) এবং ওড়িয়া আদাহেঙ্গু খিচুড়ি—নাম বিবিধ হলেও সবই খিচুড়ির ভারতীয় নিজস্ব প্রাচীন রন্ধনশৈলীর একেকটি সংস্করণ।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট