skip to Main Content

পাতে পরিমিতি I বর্ষায় সুস্থতায়

প্রকৃতিতে যখন বৃষ্টির রাজত্ব, শরীর সুস্থ রাখতে খাদ্যতালিকাও হওয়া চাই ঋতু উপযোগী। রইল পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশির পরামর্শ

বাদল দিনের ঝরো ঝরো বৃষ্টি কার না ভালো লাগে! শান্ত মনে একান্ত বৃষ্টির ফোঁটা উপভোগ করতে মন চায় প্রায় সবারই। তীব্র দাবদাহে যখন আমরা বেশ অস্থির, তারপরই বর্ষাকালের বৃষ্টি এনে দেয় স্বস্তি। তবে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিতে যেমন পরিবর্তন আসে, আমরাও নিজেদের শরীরে নানা পরিবর্তন টের পাই। সে ক্ষেত্রে ডায়েটের প্রতি মনোযোগী হওয়া জরুরি।
আমাদের মৌলিক চাহিদার প্রথমটিই হলো খাদ্য। সুস্থ থাকতে হলে পরিমিত খাবার গ্রহণ অনিবার্য। তবে ঋতু ও সময়ভেদে খাবারের সহজলভ্যতায় ভিন্নতা দেখা যায়। যদিও আমাদের দেশের ছয়টি ঋতুই আলাদা, তবে বর্ষাকাল একেবারেই ভিন্ন রকম। এ সময়ে চারপাশ যেহেতু পানিতে সয়লাব থাকে, খাবার নির্বাচন একটু বুঝেশুনেই করা চাই। যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম, তারা এই মৌসুমে ত্বক থেকে শুরু করে পেটের বিভিন্ন সমস্যায় ভুগতে পারেন। বর্ষাকালে সুস্থ থাকতে তাই পাতে রাখতে পারেন যেসব খাদ্য উপাদান—
 কালো গোলমরিচ: পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাংগানিজ, জিংক আর ক্রোমিয়ামের দারুণ উৎস এটি। এতে আরও রয়েছে ভালো পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট; যেমন ভিটামিন এ ও ভিটামিন সি। বিভিন্ন ধরনের কারি তৈরিতে এর যেমন কদর রয়েছে, তেমনি ফ্রাইড রাইস বা নানা রকম কাবাব তৈরিতেও ব্যবহার করা যেতে পারে। অবশ্য খাবারে খুব অল্প পরিমাণে ব্যবহার করা চাই। গুণাগুণ বেশ ভালো হওয়ায় এটি কফ ও বায়ুনাশক হিসেবে কাজ করে; রুচি বাড়ায়। বর্ষাকালে হুট করেই ফুসফুসের নানা সংক্রমণ, কাশির প্রবণতা থাকে অনেকের। তারা হালকা গরম সুপে কালো গোলমরিচ গ্রহণ করলে উপকার পাবেন।
 লবঙ্গ: ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ভিটামিন ই, ভিটামিন সি, ভিটামিন কে, ম্যাঙ্গানিজ ও ফাইবার সমৃদ্ধ লবঙ্গ আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় থাকেই। বর্ষাকালে অনেকে শরীরব্যথা, গিঁটে গিঁটে ব্যথায় ভোগেন। তারা এ সময়ে প্রচলিত চা বা কফির বদলে লবঙ্গ যোগে এক কাপ গরমমসলা চা তৈরি করে নিলেই এ ধরনের ব্যথা থেকে অনেকটা আরাম পাবেন। তা ছাড়া বর্ষাকালে নানা ধরনের মাইক্রো অর্গানিজমের গ্রোথ বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে ই-কোলাই, স্টেপটোকক্কাস, স্ট্যাফিলোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া নির্মূলেও লবঙ্গ বেশ সহায়ক।
 এ ছাড়া বর্ষাকালে সুস্থ থাকতে ডায়েটে কিছু অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার রাখা চাই; যেমন হলুদ, তুলসী, আদা, এলাচি ইত্যাদি।
এই ঋতুতে ব্যাকটেরিয়াল বা ফাঙ্গাস ইনফেকশনগুলো বেশি হওয়ার ঝুঁকি থাকায় কিছু শাকসবজি এড়িয়ে চলাই শ্রেয়; যেমন—
 গ্রিন লিফি ভেজিটেবল বা শাক কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ এবং পরিপাকতন্ত্র ভালো রাখার জন্য আমরা সাধারণত খাদ্যতালিকায় সব সময় রাখি। তবে বর্ষাকালে এসব শাক কম খাওয়া ভালো। শাকের পাতায় আর্দ্রতা থাকায় এ সময় এগুলো আমাদের ডাইজেস্টিভ সিস্টেম নষ্ট করে দিতে পারে। তাতে পাতলা পায়খানা, গ্যাসের সমস্যা ইত্যাদি ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। এ ছাড়া বৃষ্টির মৌসুমে শাকের পাতাগুলো সহজেই জীবাণুর জন্য উপযুক্ত প্রজননক্ষেত্র হয়ে পড়ে। তাই বর্ষাকালে পাতাজাতীয় সবজি কিংবা সরাসরি শাক একটু কম খাওয়া শ্রেয়।
এ সময়ে অনেক ক্ষেত্রে বারবার রান্না করার ইচ্ছা কমে যায়, আবার খাবার গ্রহণে অনীহাও কাজ করে। অথচ সুষম বা ব্যালেন্স ডায়েট সব সময় আমাদের শরীরকে পারফেক্ট রাখতে সাহায্য করে। তাই পাতে রাখতে পারেন এই খাবারগুলো—
 আচারি-খিচুড়ি: চাল-ডালের মিশ্রণে তৈরি হয় খিচুড়ি। যাতে অ্যামাইনো অ্যাসিড সম্পূর্ণরূপে পাওয়া যায়। ফলে ভরপুর প্রোটিন আমাদের দেহ গঠন ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধিতে দারুণ কাজ করে। এতে সামান্য কাঁচা আম অথবা জলপাইয়ের আচার যোগ বর্ষাকালে যাদের মুখের রুচি কমে যাওয়ার প্রবণতা কিংবা খাবারে অনীহা থাকে, তাদের ক্ষেত্রে উপকারী হতে পারে। গরম-গরম খিচুড়ি যেমন সুস্বাদু, তেমনি যথেষ্ট ক্যালরিসমৃদ্ধ। তাই যাদের একটু ফাসি বা পিকি ইটিং হ্যাবিট রয়েছে, তারা রেসিপি পরিবর্তন করে সকালে বা দুপুরে ভাতের বদলে উপভোগ করতে পারেন আচারি-খিচুড়ি। বিশেষত অফিস লাঞ্চের জন্য এটি দারুণ রেসিপি।
 পোহা: ইভনিং স্ন্যাকস হিসেবে ভারী খাবার গ্রহণ খুবই প্রচলিত। এতে ওজন বাড়ার পাশাপাশি ফিটনেস নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই আকাশ যখন ঘন মেঘে ঢাকা, তখন ভাজা পোড়া খাবার বাদ দিয়ে সবজিযোগে রান্না করা মুচমুচে চিড়ার পোহা একটু ভিন্ন স্বাদ এনে দেবে; স্বাস্থ্যের জন্যও মঙ্গল।
 স্যুপ: বর্ষাকালে চারপাশে পানি আর আমাদের খুব একটা পিপাসা না থাকায় সারা দিনে ওয়াটার ইনটেক অনেক সময় পর্যাপ্ত হয় না। এতে মূত্রনালির সংক্রমণসহ (ইউটিআই) নানা সমস্যা হানা দিতে পারে শরীরে। সুস্থ থাকতে পর্যাপ্ত পানি পানের বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে বিকেলের নাশতা কিংবা রাতের খাবার হিসেবে স্যুপ হতে পারে দারুণ অপশন। নানা রকমের সবজি, চিকেন আর ডিমের সাদা অংশ দিয়ে ঝটপট তৈরি করে নেওয়া সম্ভব লো ক্যালরির বিভিন্ন ধরনের স্যুপ। তাতে কর্নফ্লাওয়ার, টেস্টিং সল্ট কিংবা প্যাকেট স্যুপ না দিয়ে, সামান্য রসুনের ফোড়ন অথবা ব্ল্যাক পেপার ব্যবহার করলে মিলবে ভিন্ন স্বাদ। এমন স্যুপে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান থাকায় স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশের কারণে ম্যাজম্যাজে শরীর চাঙা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বাড়বে।
 চিকেন-ভেজিটেবল পাকোড়া: ডায়েটারি মডিফিকেশন করলেই তেল মসলা জিরোতে নামাতে হবে—এমন কোনো কথা নেই। প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ মিলিলিটার ভেজিটেবল অয়েল রাখা যেতেই পারে খাদ্যতালিকায়। সে ক্ষেত্রে সবজি ও চিকেন সেদ্ধ করে চপ বানিয়ে অল্প তেলে ভেজে নিলে পাওয়া যাবে বর্ষণমুখর সন্ধ্যা উপভোগের চমৎকার স্ন্যাকস। সবজি গ্রহণে যাদের অনীহা, বিশেষত বাচ্চারা, এই নাশতা বাসায় তৈরি ধনেপাতার চাটনি কিংবা টমেটো সসের সঙ্গে পরিবেশন করলে তাদের জন্য বেশ উপভোগ্য হবে বলেই ধারণা। এতে শিশুদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতার পাশাপাশি শারীরিক বৃদ্ধিতে উন্নতি ঘটার সম্ভাবনা বাড়বে।
অবশ্য বর্ষায় সুস্থ থাকতে এই মৌসুমের শুরুতেই কিছু প্রস্তুতি নিয়ে রাখা ভালো। শুধু ডায়েটারি মোটিফিকেশন না করে পুরো লাইফটাইল ও ফুড হ্যাবিটে বদল আনা চাই। খেয়াল রাখতে হবে—
 যারা গরমের উত্তাপ থেকে স্বস্তি পেতে ঠান্ডা পানি ও ঠান্ডাজাতীয় খাবার অতিরিক্ত গ্রহণে অভ্যস্ত, তারা বর্ষার শুরুতেও তা ধরে রাখলে গলা খুসখুসে, গা ব্যথা ইত্যাদি সমস্যায় পড়তে পারেন। তাই এ সময় অতিরিক্ত ঠান্ডা খাবার গ্রহণ বন্ধ রাখাই মঙ্গল।
 বর্ষাকালে কখন বৃষ্টি হবে, তার কোনো ঠিক নেই! বাড়িতে তাই কিছু ড্রাই ফুড রাখতে পারেন; যেমন মুড়ি, চিড়া, রাইস ক্র্যাকার, নাটস ইত্যাদি।
 এ সময় ত্বকের সুস্থতায় গাজর, টমেটো, ক্যাপসিকাম রাখা যেতে পারে খাদ্যতালিকায়।
মোটকথা, যেকোনো ঋতুতে সুস্থ থাকতে চাইলে সচেতনতার পাশাপাশি সময় অনুযায়ী লাইফস্টাইল ও ডায়েটারি মডিফিকেশন করে নেওয়া উত্তম।

লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top