skip to Main Content

কভারস্টোরি I মননশীলতায় উদরপূর্তি

খাবারের কারণে অনেক সময় রোগ বাসা বাঁধে শরীরে। আবার খাবারের কারণেই সারে। খাবার কেবল শরীরের ক্ষুধা মেটায় না, মনের ক্ষুধাও নিবারণ করে। কী খাওয়া হবে এটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কীভাবে খাওয়া হবে, সেটাও জরুরি। প্রযুক্তির উৎকর্ষে যাপিত জীবনে অনেক বদভ্যাস এসে জুটেছে। মোবাইল ফোনে কার্টুন না চালালে শিশুরা আজকাল খাবার মুখে তোলে না। বড়রাও ওই খাবারের ফাঁকেই চেক করে নেন ইনবক্স। সিনেমা দেখতে দেখতে খাওয়া তো পুরোনো রীতি। কিন্তু এসব বদভ্যাস দীর্ঘ মেয়াদে বাড়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকি। তাই তো সচেতনেরা এখন ঝুঁকেছেন মাইন্ডফুল ইটিংয়ের দিকে। বিষয়টির ফিরিস্তি দিচ্ছেন শিবলী আহমেদ

কী খাওয়া হচ্ছে, সেটার ওপর সুস্বাস্থ্য নির্ভর করে। তবে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, কীভাবে খাওয়া হচ্ছে। বেখেয়ালে মানুষ অনেক সময় বেশি খাবার খেয়ে ফেলে। সিনেমা দেখতে বসে খেতে খেতে সাবাড় করে দেওয়া যায় অনেকটা, যা শরীরে হিতের বদলে করে বিপরীত। অমনোযোগী না হয়ে খাবারের প্রতি মনোযোগী হওয়াকেই এককথায় ‘মননশীল খাদ্যাভ্যাস’ বলে। ইংরেজিতে ‘মাইন্ডফুল ইটিং’। তবে যত সহজে একে সংজ্ঞায়িত করা হলো, বিষয়টি মোটেই তত সহজ নয়। এর রয়েছে অনেক ধাপ। তা ছাড়া রাতারাতি এই অভ্যাস গড়ে তোলা সহজ কর্ম নয়।
মননশীল খাদ্যাভ্যাস হলো খাবারের সঙ্গে মানসিক যোগাযোগ স্থাপন। তবে এটি মোটেই খাবার নিয়ে ধ্যান বা সাধনা করার মতো আধ্যাত্মিক বিষয় নয়। খাদ্যের সঙ্গে নিজের পঞ্চেন্দ্রিয়ের সংযোগ স্থাপনই মাইন্ডফুল ইটিং। এর মধ্যে পড়ে খাবার স্পর্শ করা, এর স্বাদ বোঝার চেষ্টা চালানো এবং রয়েসয়ে আরাম করে খাওয়া।
পুরো মনোযোগটা খাবারের ওপর কেন্দ্রীভূত করাই মাইন্ডফুল ইটিংয়ের প্রাথমিক কাজ। এর শুরুটা হওয়া চাই বাজারে খাদ্যপণ্য কিনতে যাওয়ার আগে থেকেই। কী খাওয়া হবে, সেটা ভেবে সদাইপাতি কেনা জরুরি। গোড়ায় গন্ডগোল হলে আখেরে ভালো ফল মিলবে না। এরপর রান্না ও পরিবেশন—সব ক্ষেত্রেই চাই খেয়াল ও প্রখর মনোযোগ। খাবারে মননশীল হতে হলে এই চর্চায় উদাসীনতার ঠাঁই নেই। মাইন্ডফুল ইটিং হলো খাবারে উদাসীনতার ঠিক বিপরীত অভ্যাস।
ব্যস্ত শহরে ঘড়ির কাঁটায় চলে নাগরিকেরা। খাবারের প্রতি মনোযোগী হওয়ার ফুরসত মেলে না তাদের। কোনোমতে একটি পাউরুটি মুখে গুঁজে অফিসের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়া, কিংবা কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই দুপুরের খাবার সেরে নেওয়া—এসবই সুস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি, যা দীর্ঘ মেয়াদে হানিকর। এর থেকে রেহাই পেতে সমাধান হাতড়ে বেড়াচ্ছেন আধুনিক মানুষ। সেই সমাধান রয়েছে মাইন্ডফুল ইটিং চর্চায়।
কখনো কখনো অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো কাণ্ডও ঘটে। ক্ষুধা নেই, তবু অনুরোধ অথবা সমাজ রক্ষার জন্য এটা-ওটা খেয়ে বসেন অনেকে। তা ছাড়া কোনো একটি খাবার চেখে দেখার সময় ভালো লাগলে গোগ্রাসে অনেকটা খেয়ে ফেলেন কেউ কেউ। এসবই ঘটে খাবারের প্রতি উদাসীনতা থেকে। মাইন্ডফুল ইটিংয়ে এমন স্বভাবের ব্যক্তিদের ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন ভোজনরসিক’ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ খুবই অস্বাস্থ্যকর একটি অভ্যাস হিসেবে বিবেচ্য। তবে এর মানে কিন্তু এই নয়, একেবারে চামচ মেপে মেপে ঘড়ি ধরে খেতে হবে। মনে রাখা ভালো, মাইন্ডফুল ইটিংয়ের সঙ্গে ডায়েট কিংবা ক্যালরি মেপে খাওয়ার সংযোগ নেই। এই অভ্যাস রপ্ত করতে যে বেশ কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে যেতে হবে, তেমনটাও নয়। প্রয়োজন শুধু মনোযোগ। নিজের ইন্দ্রিয়গুলোর সঙ্গে খাবারের দৃঢ় যোগাযোগ ঘটিয়ে দিতে হবে, ব্যস।
প্রতি বেলায় খাবারের ওপর সূক্ষ্ম মনোযোগ ধরে রাখা হয়তো কারও কারও কাছে বেশ কঠিন ব্যাপার মনে হতে পারে। তাতে কি! সপ্তাহে এক দিন অন্তত এমন চর্চা করা যেতে পারে। তারপর ধীরে ধীরে চর্চা বাড়িয়ে নিলেই হলো। খাদ্যে মনোযোগ দিলে খাওয়া এমনিতেই পরিমিত হয়ে আসে। এটা প্রমাণিত। তা ছাড়া অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস থেকেও বেরিয়ে আসা যায়। এ দুটিই সুস্থতার জন্য অপরিহার্য।
মাইন্ডফুল ইটিং চর্চায় টিভি দেখা কিংবা মাঠে গিয়ে খেলা উপভোগকালে হাতে কোনো খাবার নিয়ে না বসাই ভালো। কেননা সে সময় খেয়াল থাকে কেবল টিভিতে কিংবা ওই খেলায়। ফলে কতটুকু খাবার গ্রহণ করা হলো, সেদিকে ঠিকঠাক মনোনিবেশ করা সম্ভব হয় না। এ নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। এক ব্যক্তি নাকি চিড়ার বস্তা নিয়ে গাড়ির ছাদে ভ্রমণ করছিলেন। চারপাশের প্রকৃতি উপভোগ করতে করতে তিনি বস্তার অনেকটুকু চিড়া খেয়ে ফেলেছিলেন; পরে পানি পান করায় পড়েন মহাবিপদে। সেযাত্রায় হাসপাতালে গিয়ে তার প্রাণ বাঁচে। এমনটা ঘটেছিল শুধু খাবারের প্রতি বেখেয়াল থাকায়। আবার কখনো কখনো এমনও হয়, সিনেমা কিংবা খেলা দেখতে দেখতে অনেকটুকু খাবার খেয়ে ফেলেছেন; অথচ মস্তিষ্ক আপনাকে বলছে, কিছুই খাননি! মানে মনোযোগটাই আসল। মাইন্ডফুল ইটিং আপনাকে খেতে বারণ করে না; বরং খাবারের প্রতি মনোযোগী হওয়ার তাড়না দেয়।
খাবারে মনোযোগী থাকলে খাদ্যের স্বাদ উপভোগ করা যায় ভালোভাবে। খাদ্য উপভোগ করতে চাইলে এর রং, গন্ধ ও স্বাদের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ স্থাপন খুব জরুরি। এমনটা করা সম্ভব হলে শরীরও খাদ্যকে স্বাগত জানায়। সম্পূর্ণ পুষ্টি শুষে নিয়ে সুস্থতা নিশ্চিত করে। কেননা, খাবারের প্রতি আপনার মনোযোগ মগজে সংকেত পাঠায়। মগজও শরীরকে প্রস্তুত করে একটি ভালো খাবার গ্রহণ করতে।
ডায়েটিশিয়ান রাচেল হার্টলি মননশীল খাবারের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, এর মানে হলো, মনোযোগ দেওয়ার ইচ্ছা নিয়ে খাদ্য গ্রহণ। তার ভাষ্য, এটি শুধু খাদ্যের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ ঘটানো নয়; বরং ভোজনরসিকের দৈনন্দিন চিন্তার সঙ্গে খাবারের সংযোগ গড়ে দেওয়ার ব্যাপার।
মননশীল খাওয়া সাধারণত ব্যক্তির মনন থেকে উদ্ভূত। তবে এটি অনুশীলনের মাধ্যমে লাভ করতে হয়। এককথায় একে এমন একটি অভ্যাস বলা যেতে পারে, যা ব্যক্তির চিন্তা, অনুভূতি, পরিবেশ ও শরীরের সঙ্গে সম্পর্কিত।
মাইন্ডফুল ইটিং কনসেপ্টটি মোটেই নতুন নয়। সনাতন ও বৌদ্ধ সংস্কৃতিতে অনেক আগে থেকে এর অস্তিত্ব বিদ্যমান। তবে কালক্রমে এর সঙ্গে বেশ কিছু ভুল ধারণাও যুক্ত হয়েছে। যেমন কিছু ধর্মীয় সংস্কৃতির সঙ্গে এর সংযোগ থাকায় একে অনেকে ধ্যান কিংবা সাধনা করে খাদ্য গ্রহণের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। বিষয়টি তা নয়। খাবারে মনোযোগ দেওয়া, আর খাবার সামনে নিয়ে ধ্যানমগ্ন হওয়া—দুটি পুরোপুরি আলাদা। তা ছাড়া একে অনেকে ডায়েটের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলেন। মনে করেন, মাইন্ডফুল ইটিং মানেই হয়তো কম খাওয়া। অথচ পেট পুরে খাওয়াও মাইন্ডফুল হতে পারে, যদি তা মনোযোগসহকারে গ্রহণ করা হয়।
আরেকটি বিষয়, এটি কোনো চিকিৎসাপদ্ধতিও নয়। ব্যক্তির খাবারের ওপর কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করে না এ ধরনের খাদ্যাভ্যাস। এটি কেবল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খাবারে মনোযোগী হয়ে ওঠার একটি চর্চামাত্র। কেউ এ বিষয়ের অনুশীলন করলে তাকে তার পছন্দের খাবার ত্যাগ করতে হবে না। নিত্যনৈমিত্তিক খাবার খেয়েই যে কেউ মাইন্ডফুল ইটিংয়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে পারবেন। আবার কেউ যদি মনোযোগসহকারে না খান, তাহলে অপরাধবোধে ভোগারও কোনো কারণ নেই। কেননা, এটি এক দিনে গড়ে ওঠার মতো বিষয় নয়। মননশীল খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে বছরের পর বছর চলে যেতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয় শিশুদের মধ্যে শৈশবেই এই অভ্যাসের বীজ বপন করে দিতে পারলে।
তবে হ্যাঁ, মননশীল খাবার শুধু একটি বিষয়কেই নিরুৎসাহী করে, সেটা হলো—খাবারে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে অতিরিক্ত খেয়ে ফেলা। কোনো কিছুই অতিরিক্ত ভালো নয়; তা সেটা মন দিয়ে হোক, কিংবা না দিয়ে।
মাইন্ডফুল ইটিং নিয়ে আরও একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। অনেকে মনে করেন, খাদ্য গ্রহণের এই পদ্ধতিতে হয়তো একমাত্র ক্ষুধা পেলেই খেতে হবে; অন্য সময় কোনো কিছুই চেখে দেখা যাবে না। বিষয়টি তা নয়। ক্ষুধা না পেলেও পরিমিত খাওয়া যাবে, তবে সে খাবারে যেন মনঃসংযোগ থাকে, সেদিকে লক্ষ রাখা চাই। অবশ্য বিরক্ত ও মেজাজ খারাপ থাকা অবস্থায় খাদ্য গ্রহণ করতে বসা উচিত হবে না। কারণ, এই অবস্থায় খাবারের পরিমাণ নিয়ে সচরাচর কোনো হুঁশ থাকে না। তাই এ সময়ে অনেকে অবিবেচকের মতো বেশি কিংবা কম খেয়েই বেলা পার করেন।
অন্যদিকে ‘মননশীল খাদ্য গ্রহণ’ ও ‘খাদ্য গ্রহণে সজাগ থাকা’—এ দুটি বিষয়কে অনেকে এক করে ফেলেন। বিষয় দুটিতে অনেক মিল থাকলেও এগুলো আলাদা। কেননা, খাদ্য গ্রহণে সজাগ থাকা মূলত স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের বিষয়। কীভাবে খাওয়া হবে, সে বিষয়ে আলোচনা এতে নিষ্প্রয়োজন। অন্যদিকে মাইন্ডফুল ইটিং হলো কীভাবে খাওয়া হলে সেটির সঙ্গে মনের সংযোগ ঘটবে এবং তাতে সেই খাবার শরীরে কতটা ভালো প্রভাব ফেলবে, সে বিষয়ের আলোচনা। তবে মননশীল খাওয়া ওই সজ্ঞাত খাদ্য গ্রহণেরই একটি অংশ। তা ছাড়া মাইন্ডফুল ইটিং খাবারকে উপভোগ করতে সহায়তা করে।
মাইন্ডফুল ইটিংয়ের বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। যেমন মনোযোগ দিয়ে খেলে খাবার ভালো হজম হয়। কেননা এ সময় তাড়াহুড়ো করে খাওয়া হয় না। ফলে খাবার অনেকক্ষণ ধরে চিবোনো হয়, যা হজমে সহায়ক। এ কারণে মনোযোগসহকারে খেলে পরিপাকতন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। তা ছাড়া হজম ভালো হলে শরীরের অন্য অঙ্গগুলোও সুস্থ থাকে। হার্টলির মতে, মননশীল খাদ্য গ্রহণ পদ্ধতি অবলম্বন করলে ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (আইবিএস) সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই সমস্যা বেড়েই চলেছে। ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম থেকে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ডিজঅর্ডার হয়; এতে ব্যক্তি অস্বস্তিতে ভোগেন, যা কখনো কখনো রোগীকে অনেক বেশি দুর্বল করে তোলে। তা ছাড়া অতিরিক্ত গ্যাস, পেটব্যথা ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি—এসবই হানা দিতে পারে খাবারের অনিয়ম এবং বাজেভাবে খাদ্য গ্রহণের কারণে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে মাইন্ডফুল ইটিংয়ের সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়া চাই। এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মাইন্ডফুল ইটিংয়ের কারণে অস্বস্তি কমে। আইবিএস সমস্যা থেকে রেহাই দেওয়ার পাশাপাশি শরীরের অন্য রোগগুলো প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখে এই খাদ্যাভ্যাস। শরীরের পাশাপাশি মনও ভালো রাখে মননশীল খাদ্যপদ্ধতি। দ্য জার্নাল অব ট্রিটমেন্ট অ্যান্ড প্রিভেনশনে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, এ ধরনের খাদ্যাভ্যাস ব্যক্তির চিন্তাভাবনারও উন্নতি ঘটায়।
অনেক সময় অকারণেই নানা কিছু খেতে মন চায়। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় নানা ধরনের পথখাবারে প্রলুব্ধ হন পথচারী। সেই ফাঁদে পড়ে কেউ যদি সবই গোগ্রাসে খেতে শুরু করেন, তাহলে একসময় স্বাস্থ্যহানি ঘটে। তবে যারা প্রতিবেলায় খাবারে মনোনিবেশ করেন, কিংবা খাবারের সঙ্গে যাদের ইন্দ্রিয়ের যোগাযোগ ঘটে, তাদের পরবর্তীকালে ওসব পথখাবার প্রলুব্ধ করে না। কারণ, মনোযোগ দিয়ে খাওয়ার জন্য ওই ভোজনরসিকের অন্তর অতৃপ্ত থাকে না। ফলে খাওয়ার পরও খাবার চেখে দেখার জন্য ছোঁক-ছোঁক ভাবটা তার স্বভাব থেকে দূর হয়ে যায়। এতে দীর্ঘ মেয়াদে স্বাস্থ্য ভালো থাকার সম্ভাবনা বাড়ে।
এবার আসা যাক মননশীল খাদ্যাভ্যাস রপ্ত করার উপায়ের ফিরিস্তিতে। মূল বিষয় হলো, এই অভ্যাস নিজের ভেতর গেঁথে নেওয়ার কোনো সহজ নিয়ম নেই। এটি পুরোটাই ব্যক্তির মন ও ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। কাজের চাপে তড়িঘড়ি খাওয়ার অভ্যাস বাদ দিতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় খাওয়ার জন্য একটি রুটিন তৈরি করলে। খাদ্যের পেছনে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় বের করার মানসিকতা থাকতে হবে। শুধু খাওয়াই নয়; বাজার করা ও রান্নার ক্ষেত্রেও ধৈর্যের পরিচয় দেওয়া চাই। অর্থাৎ তাড়াহুড়া দূর করাই মাইন্ডফুল ইটিংয়ে পৌঁছানোর প্রথম সোপান। অবশ্য এটা করার জন্য কিছু টিপস রয়েছে। যেমন খাওয়ার আগে একটি ‘চেক-ইন’ লিস্ট করে নেওয়া যেতে পারে। খাদ্য গ্রহণের আগে ভেবে নিন, আপনি কতটা ক্ষুধার্ত। তা ছাড়া খাওয়ার জন্য আপনার মন ও শরীর প্রস্তুত কি না, হাতে খাওয়ার মতো সময় আছে নাকি—এসব বিষয়েও সজাগ থাকা চাই। আগের ও পরের চিন্তা বাদ দিয়ে খাবার সামনে নিয়ে কেবল ওই সময়টার দিকেই ফোকাস দিন; বর্তমানে বসবাস করুন। এভাবেই শুরু হতে পারে মাইন্ডফুল ইটিংয়ের প্রথম ধাপ। অনেকে খাবারে মনোযোগ দেওয়ার জন্য মৃদু লয়ের কোনো মিউজিক শোনেন। চাইলে এই পদ্ধতিও অনুসরণ করা যেতে পারে।
খাবার সামনে নিয়ে ভাবুন, এই খাদ্য উৎপাদন, পরিবহন ও রান্নার পেছনে কত মানুষের শ্রম রয়েছে। এতে খাবারের প্রতি কৃতজ্ঞতা চলে আসবে। তখন খাদ্যে মনোযোগ দেওয়া সহজ হবে। যদি প্রিয়জনদের সঙ্গে নিয়ে খান, তাহলে তাদের খাবারের দিকেও খেয়াল রাখুন। তাদের কিছু লাগবে কি না খোঁজ নিন। তাদের তৃপ্তির দিকেও নজর রাখুন। খাবার ভাগ করে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
দ্রুত খাওয়াকে অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। খাওয়ার সময় প্রতিটি কামড় উপভোগের চেষ্টা করা চাই। কেননা, তখন জিভ মানুষের মস্তিষ্কে সিগন্যাল পাঠায়। পাকস্থলীও সেই অনুসারে প্রস্তুত হয়। পেটে যাওয়ার আগেই খাবার ভালোভাবে চিবিয়ে নিলে তা হজম হতে কম সময় নেয়; তা ছাড়া খাবারের স্বাদও বোঝা যায় ভালো।
খাদ্য গ্রহণের সময় মনকে বিক্ষিপ্ত অবস্থা থেকে ফিরিয়ে একটি কেন্দ্রে নিয়ে আসার চেষ্টা করা শ্রেয়। বর্তমানে মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে খাবার খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। মননশীল খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে এই অভ্যাস ত্যাগ করা জরুরি। খাওয়ার সময় ফোন চাপলে কিংবা টেলিভিশন দেখায় ব্যস্ত থাকলে মস্তিষ্ক বিভ্রান্ত হয়। এতে পাকস্থলীও বিপদে পড়ে। তা ছাড়া খাবারের পরিমাণ ও স্বাদ সম্পর্কে হুঁশ থাকে না, যা দীর্ঘ মেয়াদে স্বাস্থ্যের জন্য বেশ ক্ষতিকর।
খেতে বসে খাবারের রং দেখুন, প্রাণভরে ঘ্রাণ নিন, ধীরে ধীরে স্বাদ উপভোগ করুন, হাতে স্পর্শ করে খাবারের তাপ বোঝার চেষ্টা চালান, আর সম্ভব হলে পাশের মানুষটির কাছ থেকে ওই খাবারের সুনাম শুনে নিন। এভাবে ওই খাবারের সঙ্গে আপনার পাঁচটি ইন্দ্রিয়েরই সংযোগ ঘটবে। এতে খেতে বসার পর আগের ও পরের চিন্তাগুলো আপনার মগজে চাপ দেবে না। তখন পুরো মনোযোগটাই খাবারের দিকে দেওয়া সম্ভব হবে।
খাবারে কামড় বসানোর কিছুক্ষণ পরপর দীর্ঘ একটি শ্বাস টেনে নিন। এতে খাদ্যের স্বাদের সঙ্গে আপনার মানসিক সম্পর্ক বাড়বে। তা ছাড়া প্রতিটি কামড়ের আগে ভাবুন, আপনি তখনো ক্ষুধার্ত কি না। এতে খাদ্য গ্রহণে পরিমিতি আসবে। তবে কম খেয়ে উঠে পড়া চলবে না। খেয়ে পুরোপুরি তৃপ্ত হওয়া চাই।
যেকোনো খাদ্যাভ্যাসে পুষ্টিকর খাবার বেছে নেওয়া প্রয়োজন। মাইন্ডফুল ইটিংয়ের বেলাতেও। পুষ্টিকর এবং যেসব খাবার আপনাকে তৃপ্ত করবে, টেবিলে সেসব পদ থাকা জরুরি। খাবারে বৈচিত্র্য রাখার চেষ্টা করুন। আমিষের সঙ্গে নিরামিষের সংযোগ ঘটাতে পারলে ভালো। নিয়মিত ফল ও শাকসবজি খেলে মানসিক চাপ কমে। খাবারে মনোযোগ দিতে চাইলে এই চাপ কমানো অপরিহার্য। মাইন্ডফুল খাবারের ক্ষেত্রে খাবার সুস্বাদু হওয়াও জরুরি। কেননা, খাবার পেট ভরালেও খাদ্যের স্বাদ মানুষের মন ভরায়।
মননশীল খাদ্যাভ্যাসের জন্য খাওয়ার পরের সময়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের চর্চায় খাওয়ার পর খাদ্য নিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করা চাই। আহার শেষে নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি কেমন অনুভব করছেন, খাদ্য তৃপ্তিদায়ক ছিল কি না, আপনার ক্ষুধা মজেছে কি না। এতে করে খাবারের সঙ্গে আপনার মনস্তাত্ত্বিক যোগাযোগ আরও দৃঢ় হবে।
মাইন্ডফুল ইটিং মানুষের শারীরিক ক্ষুধা মেটানোর পাশাপাশি মানসিক ক্ষুধাও মেটায়। একা একা এ ধরনের খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা যদি কঠিন মনে হয়, তাহলে দল বেঁধে এর অনুশীলন করা যেতে পারে। অথবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক গ্রুপ আছে, তাদের সঙ্গে যুক্ত থেকে ধীরে ধীরে এই অভ্যাস আয়ত্ত করে নেওয়া সম্ভব।

মডেল: তানজিয়া জামান মিথিলা
মেকওভার: পারসোনা
হসপিটালিটি পার্টনার : হলিডে ইন, অ্যান আইএইচজি হোটেল, ঢাকা সিটি সেন্টার
ছবি: কৌশিক ইকবাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top