skip to Main Content

মনোযতন I মূক ও মুখরতার দ্বন্দ্ব

এমনিতে কথাবার্তা আর চালচলনে খলবলে। অথচ অচেনা পরিবেশে, জনসমাগম কিংবা অনুষ্ঠানে মুখ দিয়ে শব্দ বের হয় না! আপনার সিলেকটিভ মিউটিজম নেই তো? এই ব্যাধি শিশুদের বেশি হয়। তবে কিশোর ও বড়রাও এতে ভুগতে পারেন

অরিত্রীর বয়স ছয় বছর। প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। পরিবারের সদস্যদের সামনে খুব স্বাভাবিক আচরণ করে। কথা বলে, বায়না ধরে, বাবা-মা-ভাই-বোনদের সঙ্গে খেলে। কিন্তু স্কুলে গেলে হয়ে যায় নিশ্চুপ। মেশে না কারও সঙ্গে। তাই তার কোনো বন্ধু নেই। শিক্ষক পড়া ধরলে খুব ফিসফিস করে জবাব দেয়। অন্য বাড়ির দাওয়াতে কিংবা কারও জন্মদিনের পার্টিতেও তাকে খুব চঞ্চল, মিশুক দেখা যায় না। তার মানে, পরিবারের বাইরের কোনো পরিবেশে অরিত্রী স্বাভাবিক থাকে না। কথা বলতে স্বচ্ছন্দবোধ করে না। যোগাযোগ স্থাপন করতে ভয় পায়। শিশুদের এ ধরনের মানসিক অবস্থাকে বলে সিলেকটিভ মিউটিজম। স্পষ্ট করে বললে, এতে আক্রান্ত শিশু নির্দিষ্ট পরিবেশের বাইরে বেশ নীরব ও নিশ্চুপ থাকে। সুনির্দিষ্ট পরিবেশ ছাড়া কথা বলতে আরামবোধ করে না। যখনই কোনো শিশু, কিশোর কিংবা যুবকের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রাখা, নির্দিষ্ট পরিবেশের বাইরে এবং পছন্দের মানুষ ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে যোগাযোগে অনীহা কিংবা ভয় দেখা যায়, বুঝতে হবে তার মনোজগতে ভর করেছে সিলেকটিভ মিউটিজম।
পরিচয় পর্ব
সিলেকটিভ মিউটিজম একধরনের অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার। সাধারণত অ্যাংজাইটি বা উৎকণ্ঠা থেকে দুশ্চিন্তা, হতাশা, অস্থিরতা, হীনম্মন্যতা, কাজে অমনোযোগ, খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদি দেখা দেয়। যাদের মধ্যে অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার আছে, সাধারণত তারাই এই মনোব্যাধির শিকার। তাই একবাক্যে বলা যায়, অ্যাংজাইটির সঙ্গে সিলেকটিভ মিউটিজমের যোগসূত্র গাঢ়। ডিজঅ্যাবলড চাইল্ড ফাউন্ডেশনের মনোবিজ্ঞানী এবং প্রকল্প সমন্বয়কারী নাঈমা ইসলাম অন্তরা জানান, যেসব শিশুর অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার রয়েছে, তারা নিজে থেকে কারও সঙ্গে মিশতে পারে না। কেননা তাদের মধ্যে ভয় কাজ করে। নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারে না। হতে পারে শিশুকে নতুন স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে। কিন্তু সেই পরিবেশে সে আরামবোধ করছে না। অন্যদের সঙ্গে মিশছে না। কথা বলছে না। কখনো কখনো কান্নাও করতে পারে। তবে সিলেকটিভ মিউটিজমে যারা ভোগে, স্বাভাবিক অবস্থায় তাদের কথা বলতে অর্থাৎ ভাষার ব্যবহারে কোনো সমস্যা হয় না। অর্থাৎ তাদের ভোকাল কর্ডে কোনো সমস্যা থাকে না। বরং তারা অ্যাংজাইটির কারণেই কথা বলতে স্বচ্ছন্দবোধ করে না। সামাজিকভাবে নিজেদের অনেকটা বিচ্ছিন্ন করে রাখে।
হেতুর হদিস
বংশগত কারণে শিশুরা সিলেকটিভ মিউটিজমের শিকার হতে পারে। পরিবারের কেউ এ অসুখে আক্রান্ত হলে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে এর প্রভাব পড়ার ঝুঁকি থাকে। তা ছাড়া যাদের স্পিচ ও ল্যাঙ্গুয়েজ প্রবলেম রয়েছে, তাদেরও সিলেকটিভ মিউটিজম হতে পারে। হতে পারে ভাষার সঠিক ব্যবহার, উচ্চারণের নানাবিধ সমস্যা রয়েছে। এ কারণে তারা কিছু কিছু জায়গায় নীরব থাকে। হয়তো বাংলা, ইংরেজি কিংবা অন্য কোনো ভাষা বুঝতে পারে না। অন্যের ভাষা বুঝতে না পারার কারণেও সিলেকটিভ মিউটিজম হতে পারে।
পরিবেশগত কারণেও সিলেকটিভ মিউটিজম হতে পারে। কোনো শিশু যদি অতীতে ট্রমাটিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে যায়, ট্রমার মধ্যে পড়ে, অথবা বুলিংয়ের শিকার হয়, তা তার মনের ওপর বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে।
তরুণদের মধ্যে অনেক সময় অ্যাংজাইটি বেড়ে যায়। একই সঙ্গে হতাশা কাজ করে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা কিংবা কর্মক্ষেত্রের চাপের কারণেও হতাশা বেড়ে যেতে পারে কারও কারও। আবার কখনো কখনো রাগও বেড়ে যেতে পারে। পরিণামে মনের ঘরে বাসা বাঁধতে পারে সিলেকটিভ মিউটিজম।
সামাজিক পরিবেশে মূক
অনেক শিশুই সামাজিক পরিবেশ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সিলেকটিভ মিউটিজমে ভোগে। চাকরির কারণে যাদের মা-বাবার কর্মস্থল বারবার পাল্টে যায়, সেই শিশুদের স্কুলও ঘন ঘন পরিবর্তন হয়ে থাকে। এমন শিশুরা নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বারবার বাধাপ্রাপ্ত হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের ডিন এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী জানান, সিলেকটিভ মিউটিজম হলে সামাজিক পরিবেশে শিশু মূক হয়ে থাকে, অথচ স্বস্তিকর পরিবেশে তারা থাকে মুখর। দেখা যায়, স্কুলে যাওয়ার পূর্বমুহূর্তেও শিশুরা উচ্ছল থাকে; অথচ স্কুলে গেলেই নীরব হয়ে যায়। যেন একটি কথাও তার মুখ থেকে বের হয় না। শিক্ষকের সঙ্গেও কথা বলতে চায় না। এমনকি তার কথা শিক্ষকের কান অব্দি পৌঁছায় না। এটি মূলত দুশ্চিন্তা থেকে হয়ে থাকে।
অটিজমের সঙ্গে তফাত
সিলেকটিভ মিউটিজমকে অটিজমের সঙ্গে মেলানো যাবে না। অটিজম হলে তা শৈশবে শুরু হয়; বড় হলেও স্থায়ী থাকে। শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যাকে অটিজম বলে। এতে আক্রান্তদের সামাজিক যোগাযোগ, সামাজিক আচরণ, সামাজিক কল্পনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বেশ সমস্যা দেখা যায়। অটিজমে আক্রান্ত হলে শিশুরা ঘরে বাইরে একই আচরণ করে। কিন্তু সিলেকটিভ মিউটিজম দুশ্চিন্তা, ভয় ও উদ্বেগ থেকে হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে শিশুরা আরামদায়ক পরিবেশে উচ্ছল ও প্রাণবন্ত থাকে। সামাজিক পরিবেশে বোবা হয়ে যায়। অর্থাৎ ইচ্ছে করেই কথা বলতে আরামবোধ করে না। আচরণগত থেরাপি ও বিভিন্ন কৌশল মানলে তা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
অন্তর্মুখী স্বভাবের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া
যেসব শিশু খুব অন্তর্মুখী স্বভাবের, তারা অন্যদের সঙ্গে মিশতে পারে না। নিজের মতো একা থাকতে ভালোবাসে। নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে চলাচলে স্বস্তি পায় না। নিজেকে আইসোলেটেড করে রাখতে স্বচ্ছন্দবোধ করে। এমনকি সব বিষয়ে লজ্জা পায়। অন্তর্মুখী স্বভাবের অধিকারীরা সিলেকটিভ মিউটিজমে ভুগতে পারে।
যারা ভোগে বেশি
সিলেকটিভ মিউটিজমে ভোগে বেশি শিশু-কিশোরেরা। বড়দের মধ্যেও দেখা যায়। তবে তা খুব কম। আবার অনেক ক্ষেত্রে যেসব শিশু ছোটবেলায় সিলেকটিভ মিউটিজমে ভুগেছে, বড় হলেও তাদের মধ্যে এর প্রভাব থাকতে পারে। কারণ, তাদের মধ্যে সিলেকটিভ মিউটিজম সুপ্ত অবস্থায় থাকে। ছোটবেলায় চিকিৎসা না করালে বড় বেলায় প্রভাব ভয়াবহ হতে পারে। দেখবেন, বড়দের মধ্যেও কেউ কেউ কোনো অনুষ্ঠানে সবার সামনে কথা বলতে ভয় পান। প্রেজেন্টেশনে উদ্বিগ্ন থাকেন। সামাজিক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলেন। অনেকে খুব কম কথা বলেন। খুব বেশি মানুষের সঙ্গে মেশেন না। ভিড় থেকে নিজেকে দূরে রাখতে ভালোবাসেন। বড়দের মধ্যে যারা সিলেকটিভ মিউটিজমে ভোগেন, তারা মিটিংয়ে আলোচনা করতেও ভয় পান। রোমান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের সমস্যা হতে পারে। অনেক সময় প্রতিদিনের কাজগুলো ঠিকঠাক করতে পারেন না।
মুক্তির উপায়
কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপির (সিবিটি) মাধ্যমে সিলেকটিভ মিউটিজম কমিয়ে আনা সম্ভব। ফ্যামিলি থেরাপিও কার্যকর হতে পারে। সন্তানের আচরণগত ও ব্যবহারসংক্রান্ত সমস্যা হলে এর সঙ্গে কেয়ারগিভার জড়িত। বাবা-মা, ভাই-বোন সবাইকে একসঙ্গে ফ্যামিলি থেরাপি দিলে মিলতে পারে সমাধান।
যেসব শিশুর স্পিচ বা ল্যাঙ্গুয়েজ প্রবলেম আছে, তাদের জন্য ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি কার্যকরী হতে পারে। সোশ্যাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট ট্রেনিং দিতে পারে কাজে। সামাজিক কার্যক্রমে শিশুকে বেশি বেশি যুক্ত করা যেতে পারে। তাদের স্বচ্ছন্দে কথা বলা ও চলাফেরার জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা চাই। খেয়াল রাখতে হবে পরিবেশ যেন তাদের জন্য খুব কঠোর না হয়। তীব্র সিলেকটিভ মিউটিজম থাকলে তাদের সোশ্যাল স্কিল কম থাকে। এ ক্ষেত্রে মেডিকেশন প্রয়োজন। নেওয়া চাই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ।
অ্যাংজাইটির কারণে সিলেকটিভ মিউটিজম হয়ে থাকে বলে অ্যাংজাইটি ম্যানেজমেন্ট, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিংও করানো যেতে পারে। মোটকথা, সিলেকটিভ মিউটিজমের সুতা অ্যাংজাইটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে বাঁধা। তাই অ্যাংজাইটির চিকিৎসা আগে করানো শ্রেয়। অ্যাংজাইটি হলে একজন মানুষ কারণ ছাড়াই সব সময় চিন্তিত থাকে। খিটখিটে মেজাজের হয়। অস্বস্তি অনুভব করে। কোনো কাজে মনোনিবেশ করতে পারে না। সব সময় ক্লান্তিবোধ করে। বিভিন্ন ধরনের শারীরিক উপসর্গ, যেমন হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, ঘাম হওয়া, মাথা ঘোরা, বদহজম বা পেট ব্যথা করা, মুখ শুকিয়ে যাওয়া, মাংসপেশিতে টান টান অনুভব করা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। অতিমাত্রার উদ্বেগ থেকে প্যানিক অ্যাটাকও হতে পারে। তাই সবার আগে অ্যাংজাইটির চিকিৎসা করিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা চাই। প্রয়োজনে থেরাপি নেওয়ার পাশাপাশি রুটিনমাফিক জীবন যাপন করা মঙ্গল। বাড়ানো চাই যোগব্যায়াম ও পাঠাভ্যাস। যেকোনো পরিবেশে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করা চাই।

 রিক্তা রিচি
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top