skip to Main Content

দৃশ্যভাষ্য I স্পর্ধিত স্পৃহা

লাঞ্চ আটপ আ স্কাইক্রেপার। আলোকচিত্রশিল্পের ইতিহাসে ভীষণ উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। তবে তা বানোয়াট! আর রহস্যে ঘেরা

আলোঝলমলে শহরে মাথা উঁচু করে থাকা দালানগুলোকে পায়ের নিচে রেখে, আকাশরেখায় বসে আছেন ১১ ব্যক্তি। তাদের পায়ের ১১ জোড়া জুতা ঝুলে রয়েছে স্পর্ধিত দুঃসাহসিকতায়। নিউইয়র্ক সিটির স্কাইক্রেপারে এভাবে বসে তারা দিব্যি মধ্যাহ্নভোজ সারতে মগ্ন। একদম বাঁ পাশের জনকে সিগারেট ধরিয়ে দিচ্ছেন তার বাঁ পাশের ব্যক্তি। বাঁ থেকে তৃতীয়জন আলাপ করছেন চতুর্থজনের সঙ্গে। পঞ্চম ও সপ্তমজন এবং অষ্টম ও দশমজন যথাক্রমে তাকিয়ে রয়েছেন ষষ্ঠ ও নবমজনের হাতে থাকা খাবারের প্যাকেটের দিকে। এগারোতম ব্যক্তি, অর্থাৎ ফ্রেমে একেবারে ডানে থাকা লোকটি বোতল হাতে, সরাসরি তাকিয়ে ক্যামেরায়। এভাবে এত উঁচুতে পা ঝুলিয়ে বসে আহার গ্রহণে কোনো ভয়ডর নেই তাদের চোখে-মুখে।
এ ঘটনা ১৯৩২ সালের সেপ্টেম্বরের। গ্রেট ডিপ্রেশন বা মহামন্দা যখন চরমে। শুধু ঝলমলে এই শহর নয়, যুক্তরাষ্ট্রজুড়েই বেকারত্ব ও অনিশ্চয়তার থাবায় জনজীবন বিপর্যস্ত। সেই দিনগুলোতে এক মুঠো আহার জোগানোর নিশ্চয়তা দেবে—এমন যেকোনো কাজ তা যতই ঝুঁকিপূর্ণ হোক, লুফে নিতে সদা প্রস্তুত মানুষের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। এমন কিছু মানুষের জন্য আশার বার্তা নিয়ে এসেছিল ওয়েস্ট ফোরটি নাইনথ স্ট্রিটের একটি আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণের কাজ। একটি আর্ট ডেকো স্কাইক্রেপার, যেটি পরবর্তীকালে থার্টি রকফেলার প্লাজা নামে পরিচিত।
এর ৭০ ফ্লোরের কাজ করার ফাঁকে, মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে, মাটি থেকে শত শত ফুট ওপরে, অনেকটাই আকাশসীমায়, ইস্পাতের একটি সরু কড়িকাঠের ওপর এভাবে বসেই আহার ও ধূমপান সারছিলেন লৌহকর্মীরা। এমন সময়ে ছবিটি তোলা। সহসাই দুনিয়ার সবচেয়ে আইকনিক ইমেজগুলোর একটিতে পরিণত হওয়া এই আলোকচিত্রকে আমেরিকান শ্রমিকদের স্পৃহার একটি প্রতিমূর্তি হিসেবেও গণ্য করা হয়। এখনো সে দেশের অনেক পানশালা, শ্রেণিকক্ষ ও শ্রমিক সংগঠনের অফিসে ঝুলিয়ে রাখা হয় ছবিটি। বিশেষত প্রতিবছর আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে, একটি রাষ্ট্রের গড়ে ওঠার নেপথ্যে যারা ঘাম ঝরিয়েছেন এবং নিবেদিতপ্রাণ থেকেছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই ছবি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
বলে রাখা ভালো, ছবিটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনো মুহূর্তকে ঘটনাচক্রে ক্যামেরাবন্দি করা নয়; বরং আলোকচিত্রপ্রেমীদের অনেকে ইতিমধ্যে জানেন, ধ্রুপদি এই সৃষ্টির নেপথ্যের সত্য হলো, এটি একটি সাজানো বা বানোয়াট ছবি! এতে দেখা মেলা ১১ ব্যক্তি অবশ্য সত্যিকার অর্থেই ছিলেন লৌহকর্মী। এই অবকাঠামো নির্মাণে তারা শ্রম দিয়েছেন, যেটি বর্তমানে নিউইয়র্ক সিটির ২২তম উচ্চতম ভবন এবং এনবিসি স্টুডিওর কার্যালয়—এ কথাও সত্য; তবে মধ্যাহ্নভোজের মাঝখানে ওই কড়িকাঠের ওপর তাদের আসলে আলোকচিত্রী নিজের মর্জিমতো বসিয়ে একাধিক ছবি তুলেছিলেন। আর এর মূল উদ্দেশ্য ছিল, সেই ছবিকে নতুন এই অবকাঠামোর বিজ্ঞাপনচিত্র হিসেবে ব্যবহার করা।
ইস্পাতের কড়িকাঠের ওপর এই শ্রমিকদের শুধু এভাবে বসিয়েই নয়, আমেরিকান পতাকা হাতে ধরানো কিংবা ঘুমানোর ভাব করানোর পাশাপাশি তাদের ফুটবল খেলার ছবিও তোলা হয়েছিল সেদিন। দালানটির উদ্বোধনের সাত মাস আগে, সে বছরের অক্টোবরে নিউইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবিউন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল মধ্যাহ্নভোজের এই ছবি।
সে সময়ে ইস্পাত ছিল আমেরিকান ড্রিমের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সদ্য আগত অভিবাসী শ্রমিকে ভরপুর ছিল ইন্ডাস্ট্রি, যারা দেশটির ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধির নেপথ্যে উৎপাদন ও নির্মাণযজ্ঞে ভূমিকা রাখতে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে কাজ করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। ইতিহাসবিদ জিম রাজেনবার্গার তার ‘হাই স্টিল: দ্য ডেয়ারিং মেন হু বিল্ট দ্য ওয়ার্ল্ডস গ্রেটেস্ট স্কাইলাইন’ বইয়ে লিখেছেন, ‘গাড়ি, বিমান, জাহাজ, ঘাস কাটার যন্ত্র, অফিসের ডেস্ক, ব্যাংকের ভল্ট, সেলাই মেশিন…বিশ শতকের আমেরিকায় জীবনযাপনের ক্ষেত্রে এসব মিলিয়ে ছিল ইস্পাতের এক দুনিয়ায় বসবাসই বটে। ভবন নির্মাণে স্টিলের ফ্রেম আরও বেশি কার্যকারিতা ও সাশ্রয় এনে দিয়েছিল।…নিজেদের পক্ষে যত উঁচুতে ওঠার সাহস দেখানো সম্ভব, তা দেখানোর সক্ষমতা মানুষকে এনে দিয়েছিল ইস্পাত।’ ‘লাঞ্চ আটপ আ স্কাইক্রেপার’ নামে খ্যাত এই আলোকচিত্রের ১১ ব্যক্তির স্পর্ধা তারই সাক্ষী। অবশ্য আজও এই লোকগুলোর পরিচয় পুরোপুরি শনাক্ত করা যায়নি।
২০০৩ সালে ‘হেভ ইউ সিন দিজ মেন?’ শিরোনামে একটি জরিপ চালিয়েছিল নিউইয়র্ক পোস্ট। তাতে সাড়া দিয়ে ফোন করেছিলেন শত শত লোক; ছবিতে থাকা শ্রমিকদের কাউকে কাউকে নিজ নিজ আত্মীয় দাবি করে। এ সময়েই আয়ারল্যান্ডের গ্যালওয়ের এক পানশালার ভেতরে বড় করে টাঙিয়ে রাখা এই ছবির এক অনুলিপিতে কেউ একজন লিখে রেখেছিলেন, ‘একদম ডানের জন আমার বাবা আর একেবারে বাঁয়ের জন আমার চাচাশ্বশুর’। আর তা নজরে পড়েছিল ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার দুই ভাই শন ও ইয়ামন ও’কুয়ালাইনের। কথাটি লিখে রাখা লোকের সন্ধান চালিয়ে তারা তার পরিবার সম্পর্কে জানার পাশাপাশি ছবিতে থাকা বাকিদের পরিচয়ও প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছিলেন। এ নিয়ে তাদের সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও শন ও’কুয়ালাইনের ২০১২ সালের ফিল্ম ‘মেন অ্যাট লাঞ্চ’ আদতে নিজ পরিবার সম্পর্কে ওই লোকের নিশ্চয়তার কোনো প্রমাণ জাহির করতে পারেনি। বেশির ভাগ শ্রমিকের নাম যাচাই করতে পারেননি তারা, কিংবা হরদমই এমন দাবি তুলেই নিরস্ত হয়েছেন—ছবির মাঝখানে, মুখে সিগারেট থাকা লোকটির নাম পিটার রাইস, যিনি মোহাক জাতিগোষ্ঠীর একজন লৌহকর্মী এবং নিউইয়র্ক সিটির আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণে শ্রম দেওয়া অসংখ্য নর্থ আমেরিকান ইন্ডিয়ানের একজন।
রকফেলার সেন্টার আর্কিভিস্ট ক্রিস্টিন রুসেলের সাহায্য নিয়ে, ও’কুয়ালাইন ভ্রাতৃদ্বয় এই ছবির দুজন লোকের হদিস বের করতে অবশ্য সক্ষম হয়েছিলেন: ডান থেকে তৃতীয়জনের নাম জো কার্টিস এবং বাঁ থেকে তৃতীয়জন জোসেফ একনার। তবে এদের সম্পর্কে খুব সামান্যই জানা গেছে।
ছবিটি কার তোলা—সে প্রশ্নও রহস্য রয়ে গেছে। এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং ও এলিস আইল্যান্ডের ছবি তোলার জন্য খ্যাত লুইস হাইন এই ছবিগুলো তুলেছেন—এমন ভুল ধারণা অনেকে পোষণ করলেও সেদিন আসলে রকফেলার সেন্টারের ওই শুটিংয়ে ছবি তুলেছিলেন বেশ কয়েকজন আলোকচিত্রী। ‘বিখ্যাত এই ছবি আমারই তোলা’—তাদের মধ্যে কারও পক্ষে এমন নিশ্চিত দাবি করা সম্ভব হয়নি।
নানা শিল্পমাধ্যমে এই আলোকচিত্রের বেশ কিছু পুনঃসৃষ্টি ইতিমধ্যে ঘটেছে। এগুলোর মধ্যে বিশ^খ্যাত ভাস্কর ও পুল আর্টিস্ট সার্জিও ফারনারি ছবিটিতে থাকা মানুষগুলোর মুখে বাড়তি রহস্য জুড়ে দিয়ে, দীর্ঘ সময় নিয়ে গড়েছেন দারুণ এক ভাস্কর্য। নিউইয়র্কের আওয়ার টাউন পত্রিকাকে ২০১৭ সালে তিনি বলেন, ‘সিসিলির মানুষ বলে এর সঙ্গে অন্তরের একটি আশু সংযোগ আমি অনুভব করেছিলাম। ওই কড়িকাঠের মধ্যে একগুচ্ছ সিসিলিয়ান প্রেক্ষাপটের পেয়েছিলাম দেখা।’ ২০০০ সাল পর্যন্ত তার ভাস্কর্যগুলো ছিল হাতে বহনযোগ্য আকারের। কিন্তু আলোচ্য আলোকচিত্রটির মধ্যে প্রবল শক্তি অনুভব করে, এই ভাস্কর্যকে বিরাট আকারে বানানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ১৯৯০-এর দশকে শুরু করলেও ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ঠিক পরপরই, ৪০ ফুট দীর্ঘ, প্রমাণ-আকারের ভাস্কর্যটির কাজ শেষ করেন ফারনারি। কেননা, টুইন টাওয়ার হামলার ঘটনায় ওই সময়কালে আবির্ভূত গ্রেট ডিপ্রেশনের মতো পরিস্থিতিতে আমেরিকানদের মধ্যে জাগরণের নতুন স্পৃহা জোগানোর প্রয়োজন তিনি অনুভব করেছিলেন।

দায় স্বীকার: ওয়াশিংটন পোস্ট, টাইম ম্যাগাজিন, নিউইয়র্ক পোস্ট, আওয়ার টাউন
 লাইফস্টাইল ডেস্ক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top