রম্যরস I থ্রিপিস -সুমন্ত আসলাম
‘বাসায় ফিরে কলবেল চাপব, বউ হাসি হাসি মুখে দরজা খুলে দেবে। তারপর হাতের ব্যাগটা নিয়ে বলবে, “ইশ্, কেমন ঘেমে গেছ তুমি!” তারপর আঁচল দিয়ে…, তা না…!’ গৃহকর্মী দরজা খুলে দিলে, সোফার দিকে তাকাই আমি। ঝিম মেরে বসে থাকা বউকে দেখে প্রসঙ্গ বদলে ফেলি, ‘…অনলাইনে কোনো থ্রিপিস পছন্দ হয়েছে তোমার, কিন্তু অর্ডার দিতে গিয়ে জেনেছ—সোল্ড আউট। মেজাজ এ জন্য খারাপ?’
‘না।’ বউয়ের সংক্ষিপ্ত উত্তর।
‘গত সপ্তাহে যে দুটো থ্রিপিস কিনেছ, তা কি পাশের বাসার ভাবিও কিনেছেন?’
‘না।’
‘তাহলে ভাবি যে দুটো কিনেছেন, তা এখনো কেনা হয়নি তোমার?’
‘এসব বলছ কেন তুমি!’
‘সমস্যা কী তোমার? মন খারাপ করে রেখেছ।’ বউয়ের পাশে বসি আমি, ‘পুরাতন কোনো কথা মনে পড়েছে?’
‘পুরাতন কী কথা!’ এবার শব্দ করে বলে উঠল বউ, নড়েচড়েও বসল একটু।
হাসতে থাকি আমি, ‘কে না জানে—আমাদের প্রত্যেকেরই কস্টলি একটা অতীত আছে, অতীত থাকে। না না, এটা আমার কথা না, রুদ্রর কথা।’
‘কোন রুদ্র?’
‘কয়জন রুদ্রকে চেনো তুমি?’ হাসিটা বাড়িয়ে দিই আমি, ‘রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কথা বলছি আমি।’
‘এসব প্যাঁচাল রাখো এখন।’ সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল বউ, ‘চলো, খাবে।’
হাত টেনে ধরি বউয়ের, পাশে বসাই সোফায়, ‘মন খারাপের কারণটা বলো, তারপর খেতে যাব।’
ঝিম মেরে আরও কিছুক্ষণ বসে রইল বউ, সোফায়। তারপর মিনমিনে গলায় বলল, ‘দুটো থ্রিপিস অর্ডার দিয়েছিলাম অনলাইনে।’
‘এখনো ডেলিভারি দেয় নাই?’
‘দিয়েছে।’
‘তাহলে তো খুশি হওয়ার কথা, মন খারাপ কেন?’
‘অর্ডার দিয়েছিলাম কাপড়, ডেলিভারি দিয়েছে ত্যানা। ত্যানা চেনো তো, যে পুরাতন কাপড় দিয়ে রান্নাঘর, মেঝে, ঘরের জিনিসপত্র পরিষ্কার করা হয়।’ গজগজ করতে থাকে বউ, ‘অনলাইনে কী দেখলাম, কী অর্ডার দিলাম, আর দিল কী আমাকে!’
‘এটা কি এই প্রথম হলো?’
বউ কোনো জবাব দিল না। খাবার টেবিলের দিকে চলে গেল। সর্বশ্রান্ত একটা মানুষের মতো দেখাচ্ছে তাকে এখন—পুরাই নিঃস্ব!
২
চার মাস পর বউ উৎফুল্ল হয়ে ফোন দিল আমাকে। জটিল একটা লেখা এডিট করছিলাম। টেবিল থেকে মোবাইলটা নিয়ে কানে ঠেকিয়ে বললাম, ‘নতুন কোনো সিরিয়াল শুরু হচ্ছে নাকি স্টার জলসায়?’
‘স্টার জলসা এখন কেউ দেখে নাকি?’
‘ব্যাংককে যাওয়ার কোনো অফার দিয়েছে নাকি কোনো ট্রাভেল এজেন্সি?’
‘আমরা তো এবার ব্যাংককে যাচ্ছি না।’
‘তাহলে নিশ্চয় কোনো ভাতা পেয়েছ। তোমরা আমাদের চেয়ে দু-একটা ভাতা বেশি পাও। মাঝে মাঝে বাইরের কোনো পরীক্ষার ডিউটি পড়ে তোমাদের, বেশ অনারিয়াম দেয় তাতে।’
‘ওসব কিছু না।’
‘তাহলে আসল কারণটা বলো।’
‘কোনো কারণ-টারণ নেই। অনলাইনে একটা ড্রেস অর্ডার দিয়েছিলাম, হেভভি সুন্দর, দামও রিজনেবল।’ বউ একটু থেমে রহস্যের ভঙ্গিতে বলল, ‘বলো তো কত দাম?’
‘দশ হাজার।’
‘ধ্যাত, অত দামের থ্রিপিস আমি কখনো কিনেছি নাকি! মাত্র নয় হাজার দুশো টাকা। যা সস্তায় পেয়েছি!’
‘কনগ্রাচুলেশনস। তোমার খুশি আমার খুশি।’
বাসায় ফেরার সঙ্গে সঙ্গে বউ বলল, ‘কয়দিন পর রোজা শুরু হবে। এবার ঈদের শপিংটা আগেই করতে চাই। আগামী সোমবার কী একটা ছুটি আছে। আমার সঙ্গে শপিংয়ে যাবে।’
সানরাইজ প্লাজা বউয়ের খুব পছন্দের শপিং সেন্টার। বিকেলের দিকে গেলাম সেখানে। গোটা পাঁচেক আত্মীয়ের জন্য কেনাকাটা করে বউ একটা থ্রিপিসের দোকানে ঢুকল। আমার দুহাতে শপিংয়ের ব্যাগ। পাশেই একটা কাঠের টুলে বসলাম আমি। দোকানদার পরিচিত। বরাবরের মতো কোল্ড ড্রিংকস অফার করল আমাদের। দুটো বোতল এলো দ্রুতই। আমি একটার স্ট্রয়ে ঠোঁট চেপে ধরলাম, বউ আরেকটাতে। সামনে অনেকগুলো থ্রিপিসের স্তূপ। আমাদের আগে কেউ দেখেছেন এসব। দোকানের এক কর্মচারী গোছাচ্ছেন। হঠাৎ একটা থ্রিপিসে চোখ আটকে গেল আমার। ওটার দিকে তাকাই একবার, বউয়ের গায়েরটার দিকে আরেকবার—দুটো একই জিনিস, একই রং, যে ‘হেভভি’ জিনিসটা বউ কয়দিন আগে অনলাইনে নয় হাজার দুশো টাকা দিয়ে কিনেছে।
থ্রিপিসটা ভাঁজ করছিলেন কর্মচারীটি। আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘এটার দাম কত?’
কর্মচারীটি হাসতে হাসতে বলল, ‘এটার দাম শুনে কী করবেন, স্যার? ম্যাডাম তো এটা নেবেন না। অলরেডি একটা কিনে বানিয়ে পরে এসেছেন।’
‘তবু শুনি না।’
‘খুব বেশি না, স্যার, তিন হাজার চারশো।’
বউ খুব আনন্দ নিয়ে স্ট্রয়ে টান দিচ্ছিল এতক্ষণ। বুদ্বুদ দেখাচ্ছিল কাচের বোতলে। এখনো বুদ্বুদ দেখাচ্ছে; কিন্তু বউ স্ট্রয়ে টান দিচ্ছে না, অথচ বুদ্বুদ করছে বোতলে। বউয়ের গোপন নিশ্বাস, গরম শ্বাস তোলপাড় করে দিচ্ছে বোতলের পুরো ড্রিংকস। আমি টের পাচ্ছি—কোল্ড ড্রিংকস আর কোল্ড নেই, হট হয়ে গেছে এরই মধ্যে।
৩
দুদিন ধরে ইন্টারনেট নেই সারা দেশে। মোবাইলগুলো পড়ে আছে অবহেলায়—সোফায়, বিছানায়, টেবিলের কোনায়। কারফিউ চলছে বাইরে। বাসায় নিরাপদ আর নিরুদ্বেগ ঘুম। দ্বিতীয় দিন হন্তদন্ত হয়ে ঘুম থেকে উঠল বউ। ঘুম ভেঙে গেল আমারও, ‘কোনো স্বপ্ন দেখেছ নাকি?’
‘হ্যাঁ।’
‘খুব খারাপ স্বপ্ন?’
‘খারাপ না ভালো, বুঝতে পারছি না।’
‘তাহলে এভাবে ঘুম থেকে উঠলে যে!’
‘স্বপ্নে দেখলাম—আমার কেবিনেটটার কাপড়ের স্তূপে একখণ্ড সোনা লুকানো আছে।’
‘বলো কী! ওই একখণ্ডটা ঠিক কতটুকু সোনা, মনে আছে?’
ঘরের আশপাশে তাকায় বউ। কারও সঙ্গে তুলনা করার কোনো কিছু খুঁজে পায় না সে। শেষে আমতা-আমতা করে বলল, ‘বুঝতে পারছি না।’
‘ওকে, সকাল হতে বেশ দেরি। আজ দুজনের কারও অফিস নেই। ঘুমাও।’
‘না।’ বউয়ের বলিষ্ঠ গলার স্বর।
‘কী করবে তুমি এখন?’
‘কেবিনেটের সব কাপড় নিচে নামাব, নতুন করে গোছাব। অনেক দিন কেবিনেটটা গোছানো হয় না। সময় পাই না। আজ সময় পেয়েছি, গোছাব।’ বউ বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, ‘তুমি ঘুমাও।’
কিছুক্ষণ পর চিৎকার করে উঠল বউ, ‘হায় হায়, এ দুটো এখানে কেন!’
চমকে যাই আমি। বিছানায় উঠে বসি। চোখ কচলাতে কচলাতে বলি, ‘সোনার খণ্ডটা পেয়েছ নাকি?’
‘এখানে সোনার খণ্ড আসবে কোথা থেকে। এই যে দেখো—।’ দুটো থ্রিপিসের প্যাকেট এনে বউ বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে, ‘কবে যে এ দুটো কিনে কেবিনেটে তুলে রেখেছিলাম, মনেই ছিল না। যা সুন্দর দুটো থ্রিপিস। আজকেই বানাতে দিতে হবে।’ বউয়ের চেহারায় রাজ্য জয়ের হাসি, ‘ভাগ্যিস, স্বপ্নটা দেখেছিলাম। একখণ্ড সোনা না পাই, থ্রিপিস তো পেলাম।’ বউ একটু থেমে বলল, ‘আজ তো ছুটি আমাদের। এই চলো না, এই দুটো থ্রিপিসের সঙ্গে মিলিয়ে কিছু অর্নামেন্ট কিনে আনি।’
৪
দুদিন ধরে টের পাচ্ছি, বউ কিছু বলবে আমাকে, কিন্তু আমি বলার সুযোগ দিচ্ছি না। পাশের বাসার ভাবি ইন্ডিয়া গিয়েছিলেন, বেশ কয়টা শাড়ি কিনে এনেছেন। বউ বলেছিল, ‘কী যে সুন্দর শাড়িগুলো, আমাদের দেশের চেয়ে দামও কম। আচ্ছা…’
বউকে এই ‘আচ্ছা’ পর্যন্তই থামিয়ে দিয়েছি, তারপরেরটুকু আমি জানি তো। চারটা শাড়ি কেনার জন্য ভিসা ফি, বিমানভাড়া, হোটেল ভাড়া, কয়দিন বেড়ানো বাবদ লাখ দুয়েক টাকা খরচ করার কোনো মানে হয়! তবে ওই আচ্ছা থেকেই শুরু করেছিলাম আমি, ‘…আচ্ছা, মার্কেটিং কাকে বলে জানো?’
‘না।’ বউয়ের অকপট স্বীকার।
*
‘ধরো, আমি অবিবাহিত। একদিন এক পার্টিতে গিয়ে খুব সুন্দরী একটা মেয়েকে দেখলাম এবং তার কাছে গিয়ে বললাম, “আমি অনেক ধনী, আমাকে বিয়ে করো।”
এটাকে বলে ডাইরেক্ট মার্কেটিং।’
*
‘ধরা যাক, অনেকগুলো বন্ধুর সঙ্গে আমি ওই পার্টিতে গেলাম। আমার এক বন্ধু সেই মেয়েটার কাছে গেল এবং আমাকে দেখিয়ে বলল, “ও অনেক ধনী, ওকে তুমি বিয়ে করো।”
একে বলে বিজ্ঞাপন।’
*
‘ধরা যাক, আমি মেয়েটাকে দেখে উঠে দাঁড়ালাম, টাইটা ঠিক করলাম, মেয়েটার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার প্লেটে খাবার তুলে দিলাম, গ্লাসে পানি ঢেলে দিলাম। তার ব্যাগটা গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গাড়ির দরজাটা খুলে দিলাম। তারপর বললাম, “বাই দ্য ওয়ে, আমি বেশ ধনী। তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?”
এটা হচ্ছে গণযোগাযোগ।’
*
‘ধরো, আমি মেয়েটার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম, “আমি বেশ ধনী, আমাকে বিয়ে করো।” তারপর মেয়েটা আমার গালে কষে একটা চড় মারল।
এটাকে বলে কাস্টমার ফিডব্যাক।’
*
‘আমি মেয়েটার কাছে এগিয়ে গেলাম, তারপর বললাম, “তুমি অনেক সুন্দরী একটা মেয়ে। আমি বেশ ধনী একটা ছেলে। তোমার সৌন্দর্যের মূল্য কেবল আমিই দিতে পারব। তাই তোমার উচিত আমাকে বিয়ে করা।”
একে বলে ব্র্যান্ড রিকগনিশান।’
*
‘ধরা যাক, আমি মেয়েটার কাছে গিয়ে বললাম, “আমি বেশ ধনী, আমাকে বিয়ে করো।” এর পরপরই মেয়েটা সবার সঙ্গে আমাকে তার স্বামী বলে পরিচয় করিয়ে দিল।
এটাকে বলে ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাই।’
*
‘আমি মেয়েটার কাছে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম। কিছু বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তার আগেই অন্য একজন এসে মেয়েটাকে বলল, “আমি অনেক ধনী, তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?” তারপর মেয়েটা সেই ছেলেটার হাত ধরে চলে গেল।
একে বলে প্রতিযোগিতা।’
‘কিন্তু তুমি তো অবিবাহিত নও।’ বউ খুব হাসি হাসি মুখে বলল।
‘বিবাহিতকে নিয়েও আছে। এই ধরো, আমি মেয়েটার কাছে গেলাম। তাকে বলার চেষ্টা করলাম—“আমি বেশ ধনী, আমাকে বিয়ে করো।” কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই সেখানে আমার স্ত্রী, মানে তুমি এসে উপস্থিত হলে। একে কী বলে বলো, জানো?’
‘কী?’
‘একে বলে প্রতিবন্ধকতা।’
‘প্রতিবন্ধকতা! আমি…!’
কিছুটা উত্তেজিত হওয়া বউকে থামিয়ে দিই আমি, ‘ঘরে বউ থাকার পরও স্বামী যদি আরেকটা বিয়ে করতে চায়, এটা কিন্তু সংসারের সুখের জন্য প্রতিবন্ধকতাই। ঠিক তেমনি ঘন ঘন থ্রিপিস আর নতুন নতুন অর্নামেন্ট কেনাও কিন্তু সংসারের সুখের জন্য একধরনের প্রতিবন্ধকতা। সংসারে কত রকমের কত গল্প আছে, ক্ষুদ্র আয়োজনে কত বৃহৎ আনন্দ, চাওয়া আর না পাওয়ার মাঝে অনাগত সুখ, হাত রেখে হাতে আকাশে তাকানো, পথের চটপটিতে তৃপ্তিময় ঢেকুর, নীল ঘাসফুলে বিমোহিত চোখ—এসবে কিন্তু কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। এসবেই তৃপ্তি, সংসারে আলো; ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো।’
ইলাস্ট্রেশন: দিদারুল দিপু