skip to Main Content

এডিটর’স কলাম I বিশের বাঁশি

সিদ্ধান্ত নিজেই নেওয়ার মতো দৃঢ়তা থাকা চাই তার অন্তস্তলে ও চিন্তা-চেতনায়। বাকি সিদ্ধান্তগুলোতে বিজ্ঞজনদের অভিজ্ঞতাই পাথেয় হয়ে ধরা দেবে। তবে অন্তত নিজের জীবনপথ ও কর্মকাণ্ডের দায়ভার নিজেরই—এটুকু উপলব্ধি করা শ্রেয়

‘আমার বক্ষের মাঝে/ প্রভাতের অস্ফুট কাকলি, হে তারুণ্য,/ রক্তে মোর আজিকার বিদ্যুৎ-বিদায়/ আমার প্রাণের কণ্ঠে দিয়ে গেল গান;/ বক্ষে মোর পৃথিবীর সুর। উচ্ছ্বসিত/ প্রাণে মোর রোমাঞ্চিত আদিম উল্লাস’—বাংলা সাহিত্যের কিশোর কবি খ্যাত সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার এই পঙ্ক্তিগুলোর মতোই স্পর্ধা ও প্রাণোচ্ছ্বাসের এক দুর্মর সময় তারুণ্য। জাতিসংঘের সংজ্ঞায় ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের তরুণ বলা হলেও, তারুণ্য নিরূপণে ২০ বছর বয়স অন্যতর মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। কেননা, একজন মানুষ কৈশোর অর্থাৎ ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সের সময়ব্যাপ্তি পেরিয়ে এই বিশেষ বয়স-রেখায় প্রবেশ করেন এ সময়ে। তাই ২০ বছর বয়স বিশেষ অর্থবহ; বিশেষত তারুণ্যের স্পৃহায়।

দুই
সদ্য কৈশোর পেরিয়ে আসা বয়সে, সামনে অবারিত জীবনদ্যুতির নানা রূপ ও রস যখন বিমোহিত করে, রোমাঞ্চকর অভিযাত্রার হাতছানি দেখায় যেকোনো দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়ার প্রেরণা, তখন একই সঙ্গে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হিসেবে বেশ কিছু দায়বোধেরও পায়ে পায়ে ঘটে হাজিরা। শুধু কল্পরাজ্যে ভেসে বেড়ানোর বেলা এ নয়; সৃষ্টিমুখর ও কল্যাণকর কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের বোঝাপড়ারও। তাই তো কেবল পারিবারিক গণ্ডিই নয়, সমগ্র জাতি তথা বিশ্ব এ বয়সী তরুণদের দিকে তাকিয়ে থাকে আশা নিয়ে। ফলে ২০ বছর বয়স নিজেকে যথাযোগ্যভাবে গড়ে তোলার এক সূচনাপর্বও। এ বয়সের একজন মানুষ হয়তো সকল দায়ভার নিতে পুরোপুরি প্রস্তুত নন, তবু কোনো কোনো সিদ্ধান্ত নিজেই নেওয়ার মতো দৃঢ়তা থাকা চাই তার অন্তস্তলে ও চিন্তা-চেতনায়। বাকি সিদ্ধান্তগুলোতে বিজ্ঞজনদের অভিজ্ঞতাই পাথেয় হয়ে ধরা দেবে। তবে অন্তত নিজের জীবনপথ ও কর্মকাণ্ডের দায়ভার নিজেরই—এটুকু উপলব্ধি করা শ্রেয়। নিজেকে গড়ে তুলতে এবং নিজের প্রাত্যহিক সিদ্ধান্ত নিজেই গ্রহণে সক্ষমতা অর্জন করতে ২০ বছর বয়সীরা যেসব দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিতে পারেন, সেগুলোর মধ্যে কয়েকটির উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন নিজের পোশাক কেনার, ফ্যাশন ও স্টাইল অনুষঙ্গ বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ। পুষ্টিসমৃদ্ধ আহার গ্রহণ, শরীরচর্চা, প্রয়োজনে চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া—এসবের ভার বড়দের ওপর আর না চাপিয়ে, নিজেই সেরে ফেলা। এ এমনই এক বয়স, যখন সদ্য অনুভব করা বিশেষ অধিকার অর্জনের বোধ থেকে তাড়িত হয়ে অনেকে ভুল বা নেতিবাচক, এমনকি বিপজ্জনক উসকানির শিকার হতে পারেন খুব সহজে; যা তার নিজের তো বটেই, পরিবার, সম্প্রদায় তথা আরও বৃহত্তর অর্থে মানবজাতির জন্য হানিকর হতে পারে। তাই সুস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো মাথায় রেখে ধূমপান, পানাহার, মাদক সেবন, অনিরাপদ ও অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, বিপথগামীদের সঙ্গে আড্ডাবাজি প্রভৃতি যতই লোভনীয় মনে হোক, এড়িয়ে যাওয়া চাই। এমন কিছুতে অজান্তে জড়িয়ে গেলে, বেরিয়ে আসার জন্য নেওয়া চাই গুরুজনদের পরামর্শ। কেননা, ২০ বছর বয়সে একজন মানুষ যদিও প্রাপ্তবয়স্ক, তবু এতটা বিজ্ঞ নিশ্চয় নন যে, যেকোনো বিপদ নিজে নিজে সামলে উঠতে পারবেন।

তিন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ বয়সীদের মানসিক সুস্থতার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছে। সংস্থাটির মতে, আবেগগত বিশৃঙ্খলা, আচরণগত ত্রুটি, সাইকোসিস, আত্মহনন ও আত্মনিগ্রহের প্রবণতা, অকারণ ঝুঁকি নেওয়ার তাড়না প্রভৃতি মনোব্যাধি এ সময়ে হানা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণের পাশাপাশি সৃজনশীলতা হতে পারে নিয়ামক। ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার গড়ে তোলার সোপান হিসেবেও এ বয়স গুরুত্বপূর্ণ। একজন মানুষ নিজেকে যেখানে দেখতে চান, সে পথে এগোনোর জন্য এ এক মোক্ষম সময়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সৃজনশীলতা-সম্পর্কিত ধারণায় এসেছে পরিবর্তন। শুধু শিল্প-সাহিত্য নয়, এমনকি আপাতদৃষ্টে যেকোনো নীরস পেশাতেও সৃষ্টিশীলতা সরাসরি সম্পৃক্ত, এমনটাই অনুভব করেন আধুনিক মানুষ। তাই যদি ক্যারিয়ারের লক্ষ্য নির্ধারণ ইতিমধ্যে করে থাকেন, তাহলে সে পথে এগিয়ে যাওয়ায় বাজাতে পারেন ২০ বছর বয়সের সৃষ্টিমুখর বাঁশি। আর নির্ধারণ করা নিয়ে এখনো দ্বিধায় থাকলে এখনই ভাবতে বসে পড়ুন, সময় যে বয়ে যায়!

চার
কথায় আছে, তরুণ প্রজন্মের অন্তরে দুর্বার তারুণ্য সদা জাগ্রত থাকে। তাই তারা একটি রাষ্ট্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র। এমনকি তরুণদের একটি রাষ্ট্রের মেরুদণ্ডও বলা চলে। কেননা, তাদের হাতেই গড়ে উঠবে ভবিষ্যতের উদাত্ত পৃথিবী। জাপানি দার্শনিক দাইসাকু ইকেদার মতে, ইতিহাস সব সময় তারুণ্যের শক্তির জোরে রূপ নিয়েছে। আমরা তার জলজ্যান্ত প্রমাণ দেখেছি বহুবার; বিশেষ করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে। তাই তরুণ প্রজন্ম যেন ভুল পথে চালিত না হয়, যেন হেলায় নষ্ট না হয় তারুণ্যের প্রাণস্পন্দন, তা খেয়াল রাখার দায়িত্ব শুধু তরুণদেরই নয়, সবার। অন্যথায় ‘বিশের বাঁশি’ বেজে উঠবে ‘বিষের বাঁশি’ হয়ে, যা কারও কাম্য নয়।

পাঁচ
শুধু ২০ বছর বয়স নয়, জীবনের প্রতিটি বয়সই নিজস্ব রূপ-রসে সৃজনশীল, সুন্দর ও তাৎপর্যপূর্ণ। তাতে তারুণ্য বিশেষভাবে অর্থবহ, সে কথা বলা বাহুল্য। বিশের বাঁশি সুর তুলুক জীবনের সকল পর্যায়ে। সুন্দর ও নিরাপদ হোক সবার জীবন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top