skip to Main Content

ফুডচেইন I ডানকিন ড্রামা

ডানকিন। আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল কফি ও ডোনাট কোম্পানি। কুইক সার্ভিস রেস্টুরেন্টও। শোনা যাক এর অগ্রযাত্রার গল্প

সুস্বাদু কফি ও ডোনাটের কথা উঠলেই ভোজনরসিকদের অনেকের মনে আনমনে দোলা দেয় বিশ্বখ্যাত ফুড চেইন ডানকিন। যার গোড়াপত্তন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের কুইন্সিতে। এরপর পাড়ি দিয়েছে বহুদূর। ডানকিনের প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম রোজেনবার্গ জন্মগতভাবেই জাত উদ্যোক্তা। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালে ছেড়ে দেন স্কুল। প্রথম দিকে আইস চিপস বিক্রি এবং খাবারের ট্রাক চালানোর উদ্যোগ নেন। পরে কফি ও ডোনাটের জনপ্রিয়তা বুঝতে পেরে ওপেন ক্যাটল নামে একটি রেস্তোরাঁ খোলেন। সেটিই নানা বাঁক পেরিয়ে আজকের ডানকিন।
তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ ফাস্ট ফুড শিল্পে টিকে থাকতে হলে পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৫০ সালে যাত্রা শুরু হলেও টিকে থাকার এ লড়াইয়ে ডানকিনের জন্য টার্নিং পয়েন্ট ২০১৮ সাল। এ সময়ে একের পর এক কৌশলগত পদক্ষেপ একে বিশ্বব্যাপী শীর্ষস্থানীয় ১০ ফাস্ট ফুড চেইনের একটিতে পরিণত করে।
ডিজিটাল ও অনলাইন নেটওয়ার্কিং
ডানকিনের গ্লোবাল মার্কেটিং অ্যান্ড ইনোভেশন বিভাগের প্রেসিডেন্ট জন কস্টেলো বলেছেন, ‘এ শুধু ডোনাট তৈরির যুগ নয়, এখন সময় সামাজিকভাবে সংঘবদ্ধ হওয়ার।’ তাই সোশ্যাল মিডিয়া কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে গ্রাহকদের সঙ্গে যুক্ত থাকছে ডানকিন। বিভিন্ন সম্প্রদায়কে মাথায় রেখে তারা এক্স ও ফেসবুককে যোগাযোগের চ্যানেল এবং অনলাইন স্টোর হিসেবে ব্যবহার করছে। আর তা গ্রাহক ও স্টোরের মধ্যকার সম্পর্ক শক্তিশালী করেছে এবং ডানকিনকে এনে দিয়েছে আরও সফলতা।
বিস্তার, ট্রেন্ড ও টেকসই
ডানকিন সুনাম ও সাফল্যের সঙ্গে ৪৫টির বেশি দেশে ১২ হাজারের অধিক স্টোর পরিচালনা করছে। ফুড চেইনটি স্থানীয় মানুষের পছন্দ অনুসারে মেনু তৈরি করে। সেই সব মেনু নির্ধারণে নিয়োজিত রয়েছে একটি গবেষক দল। স্থানীয় জনগণের পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া এই ফুড চেইনকে প্রতিদ্বন্দ্বী বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলোর চেয়ে এগিয়ে রেখেছে। মূলত এ কারণে বিদেশি আউটলেটগুলোতে সাফল্য নিশ্চিত হয়েছে ডানকিনের। উদাহরণ হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ার স্টোরগুলোর কথা বলা যেতে পারে, যেখানে স্থানীয় কফি সংস্কৃতির মতো করে কফি কিউবসহ একটি ক্যারামেল ম্যাকিয়াটো অফার করা হয়। একইভাবে, হল্যান্ডের কিছু স্টোর ডেলফট টাইলসের মতো স্থানীয় পছন্দনীয় ডিজাইন ব্যবহার করে। ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক ট্রেন্ডের সঙ্গে তাল মেলাতে পিছপা হয়নি ডানকিন। গুরুত্ব দিচ্ছে টেকসই তত্ত্বকে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ ফোম কাপ ব্যবহার না করার এবং পরিবেশবান্ধব ডবল ওয়ালযুক্ত পেপার কাপ ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য ঢাকনা ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তা ছাড়া ওয়ার্ল্ড কফি রিসার্চের মতো সংস্থার সঙ্গে টেকসই কফি সাপ্লাই চেইন নিশ্চিত এবং তাদের পণ্যে গুণগত মানের উপাদান ব্যবহার করার চুক্তি করেছে। পরিবেশ-সচেতনতা নিশ্চিতকরণে এসব উদ্যোগ ভোক্তাদের অনুপ্রাণিত করার পাশাপাশি ডানকিনের দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য নিশ্চিত করে বলেই অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
ক্যাটারিং, রি-ব্র্যান্ডিং ও মেনু উদ্ভাবন
স্বাস্থ্যসচেতন ভোক্তা ডানকিনের ডোনাটের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তাই ফুড চেইনটি এই ক্রমবর্ধমান সেগমেন্টের জন্য বিকল্প স্বাস্থ্যকর মেনু চালু করেছে। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটির আদি নাম ‘ডানকিন ডোনাটস’ থেকে ‘ডোনাটস’ বাদ দিয়ে নিজেদেরকে একটি পানীয়কেন্দ্রিক ব্র্যান্ড হিসেবে রি-ব্র্যান্ডিং করেছে। বলে রাখা ভালো, তাদের বিক্রীত পণ্যের ৬০ শতাংশের বেশি পানীয়। এই রি-ব্র্যান্ডিং শুধু গ্রাহকদের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত উদ্বেগগুলোর সমাধান করেনি, বরং কফির প্রতি ক্রমবর্ধমান চাহিদা তৈরিতেও সহায়তা করেছে।
ডানকিনের রি-ব্র্যান্ডিং প্রচেষ্টা কেবল নাম পরিবর্তনের নয়, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে তাদের কৌতুকের ছলে চালানো প্রচারাভিযান গ্রাহকদের সঙ্গে আরও ব্যক্তিগত সংযোগ স্থাপন করেছে। নতুন নামটি ডোনাটের চেয়েও বেশি পরিচিতি পেয়েছে। এই পরিবর্তন তাদের ইমেজকে আধুনিকীকরণের পাশাপাশি প্রযুক্তিনির্ভর তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছে। ডোনাটস থেকে ফোকাস কিছুটা দূরে সরে যাওয়ার ফলে ক্ষতি তো হয়নি, বরং ডানকিন আরও নতুন গ্রাহক অর্জন এবং কফি বাজারে নিজ অবস্থান মজবুত করেছে। ফলে ইতিমধ্যে স্টারবাকসের মতো জায়ান্টদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দুর্দান্তভাবে টিকে আছে।
রি-ব্র্যান্ডেড স্টোরের মধ্যে স্ট্রিমলাইনিং অ্যাকটিভিটিজও অন্তর্ভুক্ত করেছে ডানকিন। দক্ষতার ওপর ফোকাস দিয়ে মেনু অফার কমিয়েছে ১০ শতাংশ। তার ওপর, তারা স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় ‘ডানকিন গো২এস’ এবং ‘ডানকিন রান ডলার-২’-এর মতো মেনু চালু করেছে, যা ব্যস্ত গ্রাহকদের জন্য সুবিধাজনক উপায় হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিশ্রুতির সাক্ষ্য দেয়। নিখুঁত ও গতিশীল পরিষেবার প্রতি গ্রাহকদের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ডানকিনের রি-ব্র্যান্ডিং প্রচেষ্টার সাফল্যকে আরও বেগবান করেছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, গত তিন বছরে নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে এই ফুড চেইনের স্টক মূল্য বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি, যা একই সময়ে স্টারবাকসের বেড়েছে ২০ শতাংশ। এই আর্থিক উত্থান ডানকিনের রি-ব্র্যান্ডিং কৌশলের সুনিপুণ কার্যকারিতা নির্দেশ করে।
হাতের মুঠোয় পরিষেবা
গ্রাহকের জন্য ডিজিটাল পরিষেবাকে অগ্রাধিকার দিয়ে মোবাইল অ্যাপে গুরুত্ব দিয়েছে ডানকিন। ২০১৬ সালে তাদের সর্বশেষ অ্যাপটি অন দ্য গো মোবাইল অর্ডারিং চালু করেছে, যা ব্যবহারকারীদের লাইনে না দাঁড়িয়ে স্টোর থেকে কিংবা গাড়িতে বসে অর্ডার দিতে সহায়তা করে। এটি তাদের একমাত্র উদ্ভাবন ছিল না। কার্বসাইড পিকআপের ক্রমবর্ধমান ট্রেন্ডকে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন পরিষেবা চালু করেছে ডানকিন, যেখানে অনলাইনে অর্ডার করা পণ্যগুলো প্যাকেটজাত করে সরাসরি গ্রাহকদের গাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়; ফলে গাড়ি থেকে নামার প্রয়োজন পড়ে না তাদের। এই উদ্যোগগুলো তৃতীয় পক্ষ ডেলিভারি সার্ভিসের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রাহকের নানা পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে একটি শক্তিশালী মোবাইল অর্ডারিং অভিজ্ঞতা তৈরি করে।
লয়ালটি প্রোগ্রাম
ডানকিনের লয়ালটি প্রোগ্রাম ‘ডিডি পারকস রিওয়ার্ডস’ প্রাথমিকভাবে পয়েন্ট সংগ্রহের জন্য ফিজিক্যাল কার্ডের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ক্রমবিকশিত ডিজিটাল ল্যান্ডস্কেপকে গুরুত্ব দিয়ে, নির্বিঘ্নে তাদের মোবাইল অ্যাপে প্রোগ্রামটিকে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। গ্রাহকেরা একটি কিউআর কোডের মাধ্যমে ডিডি পারকস আইডিতে প্রবেশ করে নির্বাচিত কেনাকাটার জন্য পয়েন্ট উপার্জন করতে পারছেন। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক হিসাবে দেখা যায়, প্রোগ্রামটি ১২ মিলিয়নের বেশি সদস্য নিয়ে একটি মজবুত ও বিশ্বস্ত গ্রাহক ভিত্তি তৈরি করেছে, যা এই সুবিধার দুর্দান্ত সাফল্য জানান দেয়। তা ছাড়া কার্ডফ্রি ইনকরপোরেশনের সঙ্গে ডানকিন ব্র্যান্ডের অংশীদারত্ব একটি সুরক্ষিত মোবাইল অর্ডার ও পেমেন্ট প্ল্যাটফর্মের জন্য স্থায়ী লাইসেন্স করেছে। এই কৌশলগত পদক্ষেপ তাদের ভবিষ্যৎ ডিজিটাল উদ্যোগগুলোকে শক্তিশালী করবে, যেন তারা গ্রাহক অভিজ্ঞতাকে আরও উন্নত করতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা নিতে পারে।
ডানকিনের ভাইস প্রেসিডেন্ট অব ডিজিটাল অ্যান্ড লয়ালটি মার্কেটিং (আমেরিকা) স্টেফানি মেল্টজার-পল বলেছেন, ‘আমরা সব সময় আমাদের অতিথিদের দৈনন্দিন রুটিনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নতুন ধারার দ্রুততম সুবিধা প্রদান করি।’ অন দ্য গো মোবাইল অর্ডারিং এবং আমাজনের অ্যালেক্সার মিথস্ক্রিয়ায় ডানকিনে অর্ডার করার প্রক্রিয়া আরও সহজ হয়েছে। ডিডি পারকস এবং আমাজন অ্যাকাউন্টের গ্রাহকেরা এখন পছন্দের মেনু ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্টের মাধ্যমে অর্ডার করতে পারেন। ডানকিনের এই উদ্ভাবনী প্রচেষ্টা কৌশলগতভাবে খুবই আলোচিত।
ভবিষ্যতের দুয়ার
দ্রুত পরিষেবার জন্য ডানকিন তাদের নেক্সটজেন স্টোরগুলোতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। যেমন আট ট্যাপযুক্ত কফি মেশিন, পর্যাপ্ত কফি লাইন এবং মোবাইল অর্ডারের জন্য ডেডিকেটেড পিকআপ এরিয়া। ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ ডানকিনের ৫২৫টির বেশি নেক্সটজেন স্টোর ছিল, পরের বছর তা প্রায় ১৪০০-এ পৌঁছেছে; বর্তমানে ১২ হাজার। এই স্টোরগুলো গ্রাহকদের অর্ডার করা পণ্য ডেলিভারিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাকে অগ্রাধিকার দেয়। করোনা অতিমারি চলাকালে কন্টাক্টলেস পেমেন্ট সিস্টেম এবং টু-গো অর্ডার গ্রাহকদের কাছে সুবিধাজনক হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে, যা আপৎকালে ডানকিনকে বেশ ভালোভাবে টিকে থাকতে সহায়তা করেছে।
ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়াকে প্রাধান্য দিয়ে ডানকিন ক্রমাগত প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে এবং গ্রাহকের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে, বিশ্বব্যাপী শীর্ষ ফাস্ট ফুড চেইনগুলোর মধ্যে নিজ অবস্থান দারুণভাবে বজায় রেখেছে। এই প্রতিষ্ঠানের অগ্রযাত্রার গল্পটি উদ্ভাবনী শক্তি এবং গতিশীল ও নিত্য পরিবর্তনশীল বাজারে একটি ব্যতিক্রমী গ্রাহক অভিজ্ঞতা প্রদানের প্রতিশ্রুতির প্রমাণ হিসেবে কাজ করে।

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top