বিশেষ ফিচার I বাংলার খাবার, বাঙালির খাবার
বাংলা এলাকায় কী ধরনের খাবার প্রচলিত ছিল, বা যাদের আমরা বাঙালি বলছি, তারা কী ধরনের খাবারে অভ্যস্ত ছিলেন—এ নিয়ে ইদানীং বিস্তর আলাপ দেখা যায়। বাঙালি আগে কী খেত, তা নিয়ে প্রত্নপ্রমাণ ও ঐতিহাসিক তথ্যের আলোকে আলোচনা করলেও বিস্তর সমালোচনার মুখে পড়তে হয় বিভিন্ন কারণে। আবার এত ছোট পরিসরে খাবার নিয়ে আলাপ, বিশেষত বাংলার খাবার ও তার বিবর্তন নিয়ে, বেশ কঠিন—এই বিষয়ে হাজার পৃষ্ঠার কয়েকখানা ভলিউম বের করা সম্ভব। তবু ঈষৎ সংক্ষিপ্ত আলোকপাত; আল মারুফ রাসেলের লেখায়
বাংলা ও বাঙালি
আমরা এখন যে এলাকাকে ভূরাজনৈতিকভাবে বাংলা (বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ) বলি, আদতেই কি বাংলার বিস্তৃতি এটুকুই? ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম, কামরুপ, মেঘালয়, ত্রিপুরা, আরাকান অঞ্চলগুলোর সীমানা বিভিন্ন সময়ে কখনো কমেছে, আবার কখনো বেড়েছে। তাই ওই সব এলাকায় যেমন বাংলার মূল ভূখণ্ড—বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের প্রভাব পড়েছে, আবার সেসব এলাকার প্রভাবও পড়েছে এখানে। সহজভাবে আমরা এই লেখায় বাংলা বলতে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গকেই ধরে নেব; আর বাঙালি বলতে এই এলাকায় আদিকাল থেকে বসবাসকারীদের ধরে নিচ্ছি।
প্রাক্-ইতিহাসের ও প্রাচীন পর্বের খাবার
বাংলার ভূমির গঠন আর গ্রিক লেখকদের বর্ণনা থেকে ধারণা করা হয়, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল একেবারেই নতুন, বিশেষত বাকেরগঞ্জ-সুন্দরবন এলাকা; আবার হিমালয়ের পাদদেশীয় পাহাড়ের চট্টগ্রাম এলাকা, বরেন্দ্র আর লাল মাটির গড় এলাকা বেশ প্রাচীন। প্রত্নপ্রমাণ সাক্ষ্য দেয়, বাংলায় বসতি স্থাপন হয়েছিল তাম্রপ্রস্তর যুগে; আর আসাম, মুর্শিদাবাদ, নরসিংদী, হবিগঞ্জ, লালমাই, সীতাকুণ্ড এলাকায় পাওয়া পাথরের হাতিয়ার সেই সাক্ষ্য দেয়। জীবাশ্ম কাঠ, প্রাণীর হাড় থেকে তৈরি হাতিয়ার দিয়ে বাংলার দুর্গম অরণ্যে পশু শিকার করে খাওয়ার চল ছিল। বাঙালির আরেকটা বিশেষণ রয়েছে—নামের শুরুতে যেটা ব্যবহার করা হয়—‘ভেতো’। এই ধানের চাষ বাংলায় শুরু হয়েছে অন্তত পাঁচ হাজার বছর আগে। ‘শূন্য পুরাণ’ অন্তত ৫০ ধরনের ধানের বিবরণ দেয়। ধান নিয়ে গোটা একটা বই লেখা সম্ভব; এখানে কেবল এটুকু বলে রাখি, ভারতজুড়ে এককালে ধানের প্রজাতির সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের জিন ব্যাংকে ধানের ৫ হাজার ধরনের জার্মপ্লাজম রয়েছে। দশম থেকে একাদশ শতাব্দীর সাহিত্য ‘ডাকার্ণব’, ‘ডাকের বচন’, ‘খনার বচন’ থেকে বাংলার কৃষিজীবন সম্পর্কে ধারণা মেলে। গাঙ্গেয় অববাহিকায় উদ্ভিদ-প্রত্নতাত্ত্বিকেরা গত চার দশকে খুঁজে পেয়েছেন ধান, বার্লি, গম, আঙুল বাজরা, বাজরা, জোয়ার, মটরশুঁটি, মসুর, খেসারি, ছোলা, মুগ ডাল, ঘোড়া ডাল, তিসি, কুসুম-বীজ, তিল, কালো শর্ষে, ধুন্দল বীজ, বিউলি ডাল, পেঁয়াজ-বীজ, কালোজিরে, হরীতকী ফল ও বীজ, বহেড়া ফল ও বীজ, আমলকী ফল ও বীজ, বরই বীজ, কুল বরই বীজ, ক্যাপারস বীজ, গুরগুরের দানা ও বীজ, উরি ধান, ঘাস বীজ, দুই রকমের ছোলার বীজ, মুথা, মেছুয়া শাকের বীজ, মোরগঝুঁটির বীজ, বিছুটি গাছের বীজ, মাকড়জালি বীজ, মাকড়সা হুড়হুড়ি বীজ, মন্তা দানা, গুল্ম পারিজাতের দানা, দাড়ি ঘাসের দানা, বুরাসামা ঘাসের দানা, পোস্তদানা, ওটস বীজ, শিমুল বীজ, বট বীজসহ আরও অনেক গাছ। এগুলোর সব কটির সময়কাল ২৫০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। ২৫০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নিয়মিত চাষ হয়েছে বেশ কয়েক ধরনের ধান, বার্লি, গম, আখ, বামন গম, কাউন, ঝাড় ভুট্টা, মুক্তা বাজরা, জোয়ার, কডো, মসুর ডাল, অড়হর ডাল, বরবটি, শিম, মেথি, তিল, রাই শর্ষে, শন, মাষকলাই, কুসুম, তুলা, পেঁয়াজ, রেড়ি, ফলসা ইত্যাদি। নির্দিষ্ট করে উয়ারী-বটেশ্বরের কথা বললে সেখানে আড়াই থেকে তিন হাজার বছর আগের পোড়া ধান ও ধানের তুষ, চাল, বার্লি, বাজরা, কাউন, কডো, মাকরা, বুনো ঘাসবীজ, মুগ ডাল, মাষকলাই, জংলি শিম ও শিম, মটরশুঁটি, মসুর ডাল, তিল, কালো শর্ষে আর নারকেলের ছোবড়া পাওয়া গেছে। আবার সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর বিক্রমপুর বিহার থেকে উয়ারী-বটেশ্বরের মতো একই জিনিস মিলেছে। এটা থেকেই একটা ধারণা চলে আসে আমাদের আদ্যিকালের খাবারের।
তবে চোখটা একটু বৈদিক সাহিত্যেও রাখতে হয়। যদিও ব্যাপারটা মৌখিক ছিল, আর সেটা লিখিত হয়েছিল ঐতিহাসিক যুগে; ফলে ভুল-ত্রুটি যে একেবারেই নেই, তা জোর গলায় বলা যাবে না। ‘বেদ’-এ প্রায় ২৫০ ধরনের প্রাণিজ আমিষের উল্লেখ জানান দেয়, আগেকার মানুষের মাংসে অরুচি ছিল না। এর মধ্যে আবার ৫০টির মতো প্রাণী পূজার নৈবেদ্য হিসেবে চিহ্নিত করা। ‘ঋগ্বেদ’-এ ঘোড়া, ষাঁড়, মহিষ, ভেড়া ও ছাগলের নাম পাওয়া যায় দেবতার প্রতি উৎসর্গিত প্রাণীর তালিকায়। আবার হাট-বাজারে মিলত গরু, ভেড়া, শূকর, হরিণ, মুরগি, কুমির আর কচ্ছপের মাংস। ‘বুদ্ধযান ধর্মসূত্র’ জানায়, গন্ডারের মাংস ব্যবহৃত হতো শ্রাদ্ধের আয়োজনে। ‘জাতক’ জানায় কবুতর, তিতির, বানর, হাতি ভক্ষণযোগ্য। ‘বৃহৎ সংহিতা’ তালিকায় যোগ করছে সরীসৃপ ও গবাদিপশু। ‘বিষ্ণুপুরাণ’ বলছে, শ্রাদ্ধে মাংস খাওয়ানো সমাজে মর্যাদার ব্যাপার ছিল; আর এই তালিকায় ছিল খরগোশ, বরাহ, ছাগল, হরিণ, পাহাড়ি ছাগল, মহিষ, গয়াল, ভেড়া। ‘গৃহসূত্র’তে বলা হয়েছে, ভেড়ার মাংস বলদায়ক, তিতিরের মাংস পবিত্রতা, মাছ ভদ্র স্বভাব, আর ভাত ও ঘি গৌরবের। কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’তে ৭০০ গ্রাম (২০ পাল) সারঙ্গ মাংস (চিত্রা হরিণ), এক কুদুবা তেল (২৫০ গ্রাম), এক কুদুবার দুই-তৃতীয়াংশ দই, এক পাল লবণ, আর এক পালের এক-পঞ্চমাংশ মসলা (মসলার বিবরণ নেই) দিয়ে একটি পদের বিবরণ পাই। সুগন্ধি চালের সঙ্গে খাওয়া হতো এই পদ। ‘চড়ক সংহিতা’য় আরও অনেক মাংসের সঙ্গে উল্লেখ রয়েছে কুমির, কচ্ছপ, শিয়াল আর শজারুর মাংসের।
পঞ্চম শতাব্দীর নিরামিশাষী আন্দোলন জোরদার হয়েছিল—এতে অবশ্য ফা হিয়েন আর হিউয়েন সাংয়ের মতো পর্যটকেরা বৌদ্ধ প্রভাবকেই বড় করে দেখেছিলেন। পরে আল-বিরুনি তার ‘ভারততত্ত্ব’তে এই নিরামিষাশী প্রথার বিশদ বিবরণ লিখেছিলেন, আর নানা কারণ দেখিয়ে বলেছিলেন, মৃত গরুর মাংসের চেয়ে জীবিত গরুই অর্থনৈতিকভাবে মূল্যবান হওয়ায় গো-বধ রদ হয়েছিল। বাংলায় মূলত পশ্চিম থেকে আসা আর্যায়ণ সম্পন্ন হয়েছিল সেন শাসনামলে, পাল শাসনামলের সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর।
বাংলার প্রাচীন খাবার নিয়ে আরও কথা বলতে হলে ধান ছাড়াও অন্তত দুটো জিনিসের উল্লেখ টানতে হয়; প্রথমত, মিষ্টান্ন আর দ্বিতীয়ত, মাছ। মিষ্টান্ন নিয়েও কথা শুরু হলে শেষ করা সম্ভব নয়! তবে আগেকার দিনে দুধ ফাটিয়ে ছানা করার ধর্মীয় বিধিনিষেধ পর্তুগিজ আগমনে উঠে গিয়েছিল। ছানা কাটিয়ে তৈরি পর্তুগিজদের ব্যান্ডেল চিজই যে রসগোল্লার আদি অনুপ্রেরণা, তাতে সন্দেহ নেই। আগেকার দিনে মিষ্টান্ন বলতে পায়েস, চিনির তৈরি খেলনা, গজা, লাড্ডু, মোদক আর দুধ ঘন করে জ্বাল দিয়ে তার মাধ্যমে তৈরি রাবড়ি আর ঘন দুধে ময়দা যোগ করে বানানো সন্দেশই বোঝাত; আর ছিল নানা পদের পিঠে। এই পিঠেতেও লেগেছিল ঔপনিবেশিক ছাপ—একটু স্প্যানিশ ক্রিপ আর আমাদের ক্ষীরসা-মালাই দেওয়া পাটিসাপটার স্কুলিং যে অভিন্ন (ইন্দো-ইউরোপীয় নয়, বরং ঔপনিবেশিক) তা অস্বীকার করার উপায় কি! একেবারে শুরু থেকেই বাংলার ব্রাহ্মণেরা মাছ খাওয়ার ব্যাপারে ঔদার্য দেখিয়েছেন। যজ্ঞবল্ক, মনু ও ব্যাসের উল্লেখ করে এগারো-বারো শতকের রাজনীতিক ও বিদ্বান ভট্ট ভবদেব বলেছিলেন, ‘যত নিষেধাজ্ঞা সব নির্দিষ্ট দিনে, যেমন চতুর্দশী ও অন্যান্য…তাই মাছ ও মাংস খেলে কোনো দোষ হয় না।’ বৃহদ্ধর্ম পুরাণ বলছে, রোহিত (রুই), সকুল (বিশদ জানা যায়নি), সাপহার (পুঁটি) ও অন্যান্য সাদা মাছ ও আঁশ নেই—সেগুলো খাওয়া যাবে। শ্রীনাথাচার্যও বাঙালি ব্রাহ্মণদের মাছ-মাংস খাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দেননি; কেবল পার্বণের কটা দিন ছাড়া। শুধু পেঁয়াজ, রসুন আর মাশরুমের মতো কাঁচা ও শুকনো মাছ-মাংসে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছিল। আর ইলিশ মাছ ছিল কালজয়ী, এখনকার মতোই।
মুসলিম অবদান
৭০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে সিন্দে ছোট ছোট আরব রাজ্যের উত্থান হলেও, ১২০৬ সালে দিল্লিতে প্রথম উত্তর ভারতীয় মুসলিম সাম্রাজ্য তথা দিল্লি সালতানাতের শুরু হয়েছিল, যা পুরো ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেয়। একই সময়ে দিল্লির সুলতান বাংলার একটা অংশ দখল করতে পাঠান ইখতিয়ার-উদ-দিন বাখত-ইয়ার খিলজিকে। তার বিহার, গৌড়-লক্ষ্মণাবতী দখলের ভেতর দিয়ে বাংলায় শুরু হয় দিল্লির মুসলিম শাসন। এই খিলজি ছিলেন এখনকার আফগানিস্তানের গরমশির এলাকার। তাদের এই এলাকায় আগমনের ফলে খাবারে ও উপকরণে বেশ কিছু সংযোজন, পরিবর্তন ও পরিমার্জন হয়েছিল। বিশেষত মোগল শাসনামলে রীতিমতো বিপ্লব সাধিত হয়েছিল বলেই ধারণা করা হয়। এ ছাড়া মুসলিম শাসকেরা খাবার পরিবেশন ও গ্রহণের একটি বিস্তৃত নিয়ম-কানুন তৈরি করেছিল, যা আগেকার হিন্দু-রীতির চেয়ে ভিন্ন ছিল। মুসলিম শাসকেরা ফলের বাগান তৈরিতেও ভূমিকা রেখেছিলেন। গুরকানি শাসকেরা তাদের ফল-প্রীতির জন্য পরিচিত ছিলেন, বিশেষত বাবুর হিন্দুস্তানে তরমুজ ও আঙুর চাষের উদ্যোগ নিয়ে, সেটা ফলানোর পর খেয়ে আনন্দ পেয়েছিলেন। এর আগে আম ও পান পাঠিয়ে তাকে ভারত দখলের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন দৌলাত খান লোদি। অবশ্য বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমলেও বেশ গুরুত্ব দিয়ে আম চাষ করা হতো ধারণা করা হয়, বাঘা মসজিদের মিহরাবে আমের নকশা সেটিরই সাক্ষ্য দেয়।
মুসলিম আমলে ভারতে আগে থেকেই পরিচিত খাবারগুলোও সমৃদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি বদলেও গিয়েছিল। যেমন ‘রামায়ণ’-এ বলা আছে সীতার প্রিয় খাবার ছিল হরিণের মাংস দিয়ে তৈরি ‘মাংসদানা’ বা ‘পালাও’ (পোলাও)। মুসলিম পোলাও ও বিরিয়ানি (সূক্ষ্ম যে পার্থক্য, সেটা লেখা হয়েছে ক্যানভাসের আগের এক সংখ্যায়) আরও সূক্ষ্মভাবে রান্না করা হয়। মাংস পুরোপুরি হাড় থেকে খুলে আসার মতো নরম হয়ে চালের সঙ্গে মিশে যাওয়া পর্যন্ত রান্না করা হয়। হলুদ, গোলমরিচ আর জিরার সঙ্গে সুগন্ধি কিছু মসলা—লবঙ্গ, এলাচি ও দারুচিনি যোগ করা হয়। রং ও সুগন্ধের জন্য জাফরানের মতো বিলাসী উপাদানের সঙ্গে কাঠবাদাম, পেস্তাবাদাম ও শুকনো আঙুরও (কিশমিশ) মিশিয়ে দেওয়া হয় চালের সঙ্গে।
খোলা আগুনের ওপর শিকে গেঁথে মাংস পোড়ানোর কথা সংস্কৃত লেখনীগুলোয় অনেক আগে থেকেই দেখতে পাই; ‘রামায়ণ’ থেকে জানি শুল্যপক্ব হরিণের মাংস ছিল রামের প্রিয় খাবার। মুসলিম রন্ধনশিল্পীরা এটাকে পরিবর্তিত করেছিলেন তাদের ছেড়ে আসা ভূমির কাবাবের স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে—শিক কাবাব, শামি কাবাবে; আর সেগুলোর নানা প্রকরণ তৈরি করে। ‘সামোসা’ বা আমাদের চেনাজানা শিঙাড়া তুঘলকের দরবারি খাবার ছিল বলে উল্লেখ করেছেন মাগরিবি পর্যটক ইব্ন্ বাত্তুতা। মূলত পারসিক বণিকদের সংস্পর্শে এই খাবার ভারতবর্ষে তার ঠাঁই করে নিয়েছিল। বিভিন্ন ফলের রস ও আঁশের সঙ্গে গমের ময়দা, চিনি, বিভিন্ন ধরনের বাদাম, ঘি আর রুপার পাতা দিয়ে তৈরি ‘হাল্ওয়া’র (হালুয়া) কথা বলতেই হয়। ইব্ন্ বাত্তুতার বর্ণনায় আমরা ময়দা, চিনি আর ঘিয়ের তৈরি ‘খিস্তি’ এবং তিল, বাদাম ও মধু দিয়ে তৈরি ‘সাবুনিয়া’র কথা জানতে পারি। বিভিন্ন স্বাদের মিষ্টি পানীয়, বিশেষত গোলাপের শরবত বেশ সাধারণ ব্যাপার ছিল। বার্লির পানি দিয়ে তৈরি ‘ফুক্কা’ও বেশ জনপ্রিয় ছিল সুলতানি আমলে। সে আমলেই ঢাকায় নান ও তন্দুর চুলোর আবির্ভাব ঘটেছিল বলে মত প্রকাশ করেছিলেন হেকিম হাবিবুর রাহমান।
বাংলায় আফগান প্রভাব ব্যাপক। মূলত বিভিন্ন সময়ে আফগানদের বাংলায় অভিবাসন, আর এ দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়া এর পেছনে বড় একটি কারণ। আবার বাংলায় মোগল শাসন শুরু হওয়ার আগে আফগান রাজবংশ আর পরে আফগানরাই স্থানীয় জমিদারদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ‘বারোভূঁইয়া’ নামে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। আফগানদের অনেক খাবারই বিবর্তিত অবস্থায় বাংলার হেঁসেলে খুঁজে পাওয়া যায়। অধুনা জনপ্রিয় হয়ে ওঠা কাবুলি পোলাও আসলে ইতিহাস থেকে উঠে আসা বিস্মৃত এক পদ, যা এখনকার ‘বিজ্ঞ’ ইউটিউবাররা তাদের অতি জ্ঞানের কারণে খোঁজার চেষ্টা করেন না; অথচ ঢাকার খাবারের ইতিহাস টানলেই এই পদের নাম চলে আসে।
বাংলায় মোগল আমল শুরু হয়েছে দেরিতে, আবার কার্যত শেষ হয়েছে আওরঙ্গযিবের মৃত্যুর পরপরই। মুর্শিদ কুলি খানের নবাবির সময় থেকে পলাশী পর্যন্ত—নবাবি আমলে কার্যত নবাবেরা স্বাধীন শাসকের মতোই শাসন করেছেন। তবে মোগল রাজপরিবারের সদস্য ও অভিজাতদের বাংলায় আগমনের কারণে বাংলাতেও মোগল খাবারের রায়ট লেগেছিল। মোগল মীর বাকাওয়ালদের কোরমা ঢাকায় এসে আরেক পদের জন্ম দিয়েছিল—রিজালা। মুসলিমরা মাছেরও যে কত ধরনের পদ-প্রকরণ করেছিলেন, তার ইয়ত্তা নেই। হেকিম হাবিবুর রাহমানে কষ্ট করে আরেকবার চোখ বোলাতে পারেন। তবে জয়তুন তেলে রান্না চীনা মাটির পাত্রে বয়ে নিয়ে যাওয়া জাহাজি কালিয়া ঢাকার জাহাজি-খালাসিদের অনবদ্য আবিষ্কার ছিল। আর পর্তুগিজ বালাচাও কারি আমাদের আরাকান সীমান্তে এসে কেমন করে যেন শুষ্ক রূপ পেল, বা পর্তুগিজদের হাত ধরে আসা পাহাড়ি ধানি মরিচ কেমন করে এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামে বহাল তবিয়তে টিকে আছে, সেটা নিয়েও হতে পারে বিস্তর গবেষণা। এমন বহু খাবারের কথা বলা যায়, যা বাংলায় এসে আরও খোলতাই হয়েছে; আরব্য-পারসিক জাহাজে খানাপাকানেওলার চাকরি নেওয়া মগদের অনবদ্য এক পদ কালাভুনা—পারসিক এক মাংসের পদের স্থানিকীকরণ।
১৪০৬ সালে বাংলা ভ্রমণ করা চৈনিক পর্যটক মাহুয়ান সাদা চিনি, দানাদার চিনি, ক্যান্ডি বা সংরক্ষণ করা ফলের উল্লেখ করেছেন। ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এ ক্ষীর, রাবড়ি, মণ্ডা, খাণ্ডু ও নাড়ু, আর ‘চণ্ডীদাস পদাবলী’তে দই, মিষ্ট, মিট্টাই, চিনি ও চাঁপা কলার উল্লেখ রয়েছে শ্রীকৃষ্ণের জন্মের সময়ের ঘটনায়। ‘চৈতন্য চরিতামৃত’-এ, চৈতন্যের মা সাচির সন্দেশ খাওয়ানোর উল্লেখ পাই। ক্ষীর, রাবড়ি, মণ্ডা, খাণ্ডু, নাড়ু, দই, মিষ্ট, মিট্টাই, সন্দেশ—সবই তৈরি হতো দুধ, জ্বাল দেওয়া ঘন দুধ বা দুধের খোয়া দিয়ে।
নতুন পৃথিবী
১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের ভুল ভারত আবিষ্কার পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক কারণেই বিখ্যাত, আর তার থেকেও বেশি কুখ্যাত। তার সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ আবিষ্কারের পর থেকে দক্ষিণ আমেরিকা ও মেক্সিকোর মূল্যবান গাছপালার সন্ধানে ব্যস্ত ছিলেন ফিরিঙ্গি (স্প্যানিশ) ও হার্মাদেরা (পর্তুগিজ)। সেই ঢেউ এসে বাংলায় লাগতেও খুব বেশি দেরি হয়নি; কারণ, পঞ্চদশ শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই ভাস্কো দা গামা (১৪৯৮) কালিকটে, আর তার কিছু বছর পর দুই প্রতিবেশী মোগল দরবার ও পর্তুগিজরা বাংলার সমুদ্রসীমায় শক্ত অবস্থান নিয়ে রেখেছিলেন। তারা সেই সব গাছপালা তাদের পূর্বের বসতিগুলোয় নিয়ে আসতে শুরু করেছিলেন। এভাবেই টমেটো, গোল আলু, পেঁপে, পেয়ারা, সফেদা, আনারস, চীনাবাদাম, কাজুবাদাম আমাদের বঙ্গে এসেছিল। এমনকি আমাদের অনেক সাধের ও স্বাদের লাউ-চিংড়ি পদটাও পর্তুগিজ! আর কাঁচা মরিচ তো রয়েছেই এই তালিকায়। টমেটো অবশ্য লাতিন এলাকা থেকে প্রথমে ইউরোপ জয় করে, ইংরেজদের হাত ধরে ১৭৫০ সাল নাগাদ ভারতীয় উপমহাদেশে ঢুকেছিল; আর এই সবজির উৎস যে বিদেশি, তা উনিশ-বিশ শতকের আধাআধি পর্যন্ত প্রচলিত এর বাংলা নাম থেকেই জানা যায়—বিলাতি বাইগন। আন্দিয়ান এলাকার ‘পাপা’ নামের সবজি, ১৬১৫ সালে আসাফ জাহের দরবারে স্যার থমাস রো আর রেভারেন্ড এডওয়ার্ড টেরি চেখে দেখেছিলেন, যেটাকে আমরা গোল আলু বলেই জানি। ১৫৯০ সালেও দিল্লির বাজারে পেঁপে নামের ফল ছিল না; কিন্তু এর ঠিক আট বছর বাদে ডাচ গুপ্তচর ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী জ্যান হাইন ফ্যান লিনস্কোটেন ভারতে প্রচুর পেঁপের উল্লেখ করেছেন। সতেরো শতকের শেষার্ধে দক্ষিণ আমেরিকার ফল পেয়ারা বাংলায় শক্ত ঘাঁটি করে নিয়েছিল। মেক্সিকোর ফল সফেদা বাংলার হুগলি আর চট্টগ্রামে আনার কৃতিত্ব পর্তুগিজদের। প্যারাগুয়ের ফল আনানাসের উল্লেখ পাই ১৫৯০ সালের দিল্লির বাজারে—চার ‘দাম’-এ (মোগল আমলের তামার মুদ্রাকে বলা হতো দাম) একটা আনারস পাওয়া যেত, বেশ মূল্যবান ফল ছিল সেটা; কারণ, ১০টা আম পাওয়া যেত একই মূল্যে। ‘স্টোরিয়া দি মোগোর’ বইয়ে নিকোলাও মানুচ্চি ১৬৬২ সালের বাংলা ভ্রমণের অভিজ্ঞতার এক প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘…হিন্দুস্তানের আর কোনো অংশে বাংলার মতো এত পরিমাণে এই ফল (আনানাস) দেখিনি, যেখানে এগুলো অনেক বড় ও চমৎকার ফলত।’
বাংলায় পর্তুগিজদের আগমনে ইউরোপীয় খাবার তৈরির এক চল তৈরি হয়েছিল। তারা ইংলিশ ও ডাচ ফ্যাক্টরি, জাহাজ, আর বাড়ির জন্য রুটি ও বিস্কুট তৈরি করতেন, আর সেই সঙ্গে বিভিন্নভাবে জারালেবু, কাগজিলেবু, আম, আদা, আনারস ও আমলকীর সংরক্ষণে দক্ষ ছিলেন। এই পর্তুগিজদের হাত ধরেই বাংলায় ছানার প্রচলন ঘটে। ১৮৬৮ সালে সুতানুটির নবীনচন্দ্র ময়রা চিনির শিরায় ছানা ডুবিয়ে রসগোল্লা আর এর প্রায় ৫০ বছর পর বাদে তারই বংশধর কৃষ্ণচন্দ্র দাস রসমালাই আবিষ্কার করেন।
বর্তমান, ভবিষ্যৎ ও অন্যান্য
বিংশ শতাব্দী থেকেই বদলে যেতে থাকে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের খাবারের রীতি-নীতি। বিশেষত দুটো বিশ্বযুদ্ধ ও দেশভাগের অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে দুর্ভিক্ষ, অনাহার, মহামারি উপমহাদেশের মানুষের শরীরে স্থায়ীভাবে রেখে গেছে বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা। সেই সঙ্গে রামপাখি যেখানে বেশির ভাগ হিন্দু পরিবারে ঢোকা বারণ ছিল, সেই রামপাখিই বা মুরগি হয়ে উঠেছে এই একুশ শতকে প্রোটিনের মূল উৎস। ঢাকার কথা বলতে গেলে গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ফাস্ট ফুড কালচার জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও, সেটা রমরমা হয়েছে এই শতকের প্রথম দশকে। পরের দশকে জমজমাট হয়েছে কফির সংস্কৃতি। ‘অথেনটিক’ ভিনদেশি নানা পদ জনপ্রিয় হচ্ছে, তবে হারাচ্ছে আমাদের নিজেদের খাবার। এই লেখায় একবারও উঠে না আসা আধুনিকায়নের কথা এই বেলায় একবার বলি—বাঙালির রান্নার একটা আলাদা মানচিত্র ছিল, বৈচিত্র্য ছিল। মুখের ভাষার মতোই ৮ কিলোমিটার না হোক, অন্তত ১৬ কিলোমিটার পরপর, নদী-মাটির ধরনের সঙ্গে বদলে যেত এই খাদ্যাভ্যাস। কেউ বাটা মসলা, কেউ কাটা মসলা, কেউবা গোটা মসলায় রাঁধতেন—রংচঙা কোম্পানির ভেজাল গুঁড়ায় সেই আগের স্বাদ কোথায়? চিংড়িবাটা দিয়ে গোটা-থেঁতলানো মসলার গোয়ালন্দি চিকেন কারির সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা ভাতের সামনে মুরগি ভাজার দাঁড়ানোর তাকত কি আছে? নাকি বোস কেবিনের চা ও কাটলেট, ক্যাফে কর্নারের ক্রাম্ব চপ ও চায়ের অ্যাংলো ঐতিহ্যের সামনে দাঁড়াবে অধুনা ব্রিউড কফির দোকান? এখনো ঢাকাই খাবারের অবশেষ নামে যা চলছে, তার সামনেও কদিন আর মুখে রুচবে পশ্চিমা খাবার? সব খাবারই দরকার রয়েছে, প্রয়োজন রয়েছে পরিমিতিবোধেরও; আর সমস্যাটাও এখানে—জাতি হিসেবে বাঙালির পরিমিতিবোধের সুনাম নেই বিশেষ।
ছবি: সংগ্রহ
Good read.