পাতে পরিমিতি I আহারে ফুরফুরে
দেহ-মনে চাঙা থাকার বাসনা খুবই স্বাভাবিক ও আকাঙ্ক্ষিত। এ জন্য চাই সঠিক খাদ্যাভ্যাস। রইল পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশির পরামর্শ
খাবার হলো শরীর ও মন—দুটোই ভালো রাখার মৌলিক চাহিদা। তবে শুধু খাবার গ্রহণ করলেই হয় না, হজমপ্রক্রিয়ার পরবর্তী ধাপগুলোও যেন যথাযথ কার্যকরী হয়, দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় সে রকম ডায়েট রাখা প্রয়োজন। বর্তমান সময়ের ব্যস্ত জীবনচরিতে অনেক ধরনের স্ট্রেস আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। ফলে অনেক সময় মন-মেজাজ খারাপ হওয়ার পাশাপাশি ধীরে ধীরে শারীরিক দুর্বলতাও বাড়তে থাকে। বিকেলে খোলা মাঠে দৌড়ানো কিংবা উন্মুক্ত আকাশের নিচে এক কাপ চা হাতে যখন পড়ন্ত সূর্যালোক দেখার কথা, তখনো আমরা কেউ কেউ রাস্তায় বসে থাকি ট্রাফিক জ্যামে। এতে দেহ-মন চাঙা রাখা বেশ মুশকিল হয়ে পড়ছে দিন দিন। তাই শরীর রাখা চাই টক্সিক মুক্ত। এ জন্য প্রয়োজন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার। এগুলো দেহকে করে ডিটক্সিফাই। সারা দিনের টক্সিক উপাদানগুলো আমাদের শরীর তথা জীবনকে করে তোলে যন্ত্রণাময়। তাই যারা ম্যাল-নিউট্রিশনে ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে মাথা ঝিমঝিম করা, শরীরে দুর্বলতা অনুভব, শরীরব্যথা, মাসল পেইন আর হেয়ার ফলের মতো সমস্যা বারবার আবির্ভূত হতে দেখা যায়। শরীরকে ঠিকঠাক ডিটক্সিফাই করা গেলেই আমরা হয়ে যেতে পারি চাঙা।
শরীর থেকে টক্সিক উপাদান সরাতে খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন ডিটক্স ওয়াটার। তাই সারা দিনে পর্যাপ্ত পানি ও পানিজাতীয় খাবার রাখা প্রয়োজন ডায়েটে। কেননা পরিমিত পানির অভাবে শরীর ডিহাইড্রেট থাকে। ডিটক্স ওয়াটারগুলো পানি ও মিনারেলের চাহিদা পূরণে যথেষ্ট কার্যকরী। এ ক্ষেত্রে ডিটক্স হিসেবে রাখতে পারেন এ ধরনের পানীয়—
ফলে সারাই
সব ধরনের ফলেই রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। বলা হয়, প্রতিদিন যারা ফল গ্রহণ করেন, তাদের কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। তাতে দেহ থেকে টক্সিক উপাদানগুলো বের হয়ে যায় সহজে। আর নানা রঙের ফলের সমাহার থাকলে তো কথাই নেই। সে ক্ষেত্রে ৫০০ থেকে ১০০০ মিলিলিটার পানিতে মাল্টা, তরমুজ ও শসার স্লাইস দিয়ে তৈরি করা সম্ভব দারুণ রিফ্রেশিং ডিটক্স ওয়াটার।
জবর জিরা
জিরায় রয়েছে অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল উপাদান। এর ব্যবহার আমাদের যেকোনো সবজি বা তরকারিতে সাধারণত থাকেই। এতে রয়েছে কিউমিনালডিহাইড, থায়মল ও ফসফরাস। এগুলো শরীর থেকে টক্সিন দূর করে। সে ক্ষেত্রে পানি যোগে ২ টেবিল চামচ জিরা একটু জ্বাল দিয়ে তারপর ঠান্ডা করে রাখা যেতে পারে। আবার সরাসরি সারা রাত ভিজিয়ে রাখলেও বেশ উপকার মেলে। এটি সকালে খালি পেটে অথবা দিনের যেকোনো সময় গ্রহণ করা যেতে পারে। এই পানীয় দেহকে ডিটক্স করার মাধ্যমে শরীর রাখে দারুণ চাঙা।
আদায় আস্থা
সুদূর অতীতকাল থেকে বিভিন্ন গুণের জন্য প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় আদার ব্যবহার রয়েছে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে এই মসলার উপকারিতার জুড়ি নেই। জিনজার ডিটক্স তৈরি করতে দুই থেকে তিন টেবিল চামচ কাঁচা আদা কুচি ৫০০ মিলিলিটার পানিতে সারা রাত ভিজিয়ে রাখতে পারেন। এর সঙ্গে লেবু ও পুদিনাপাতা দিয়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখলে তৈরি হয়ে যাবে দারুণ জিনজার ডিটক্স। এটি ইনফ্লামেশন দূর করতে সাহায্য করবে এবং শরীরকে হেলদি রাখবে। এ ছাড়া লেবু, অ্যাপল সিডার ভিনেগার ও মধু মিশিয়েও তৈরি করা যায় ডিটক্স ওয়াটার।
শরীর ডিটক্সিফাই করলেই দায়িত্ব শেষ নয়! চাঙা থাকতে প্রয়োজন ম্যাক্রো নিউট্রিয়েন্ট। যেমন—
গ্লুকোজ গ্লোরি
অনেক সময় শরীরে পর্যাপ্ত পানি থাকলেও থাকে না গ্লুকোজ। এর ঘাটতি দেখা দিলে শরীর চাঙা থাকার সম্ভাবনা একেবারেই থাকে না। নিয়মিত ও পরিমিত খাবার গ্রহণের অভাবেও শরীরে গ্লুকোজের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। মনে রাখা চাই, শরীরকে যথাযথ কাজে লাগাতে গ্লুকোজের বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে খাদ্যতালিকায় রাখা চাই ন্যূনতম কিছু কার্বোহাইড্রেট। অনেকে সকালের নাশতা পরিহার করে অফিস, স্কুল বা কাজে চলে যান। ফলে শুরুতে গ্লুকোজের ঘাটতি থাকায় মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করে না; এমনকি দিন শেষে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে।
তাই যারা ঘুম থেকে উঠে একদমই কিছু খেতে চান না, তারা অন্তত সকালের নাশতা এড়িয়ে না চলে তাতে বরং রাখতে পারেন এগুলো—
ব্রাউন ব্রেড
এক টুকরো ব্রাউন ব্রেডই হতে পারে সকালের হালকা নাশতা। অনেকে এ সময় শুধু চা-বিস্কুট পছন্দ করেন। তাদের ক্ষেত্রে একটু হেলদি আর ভিটামিন বি কমপ্লেক্স ও ফাইবারসমৃদ্ধ বেস্ট চয়েজ হতে পারে ব্রাউন ব্রেড। যারা সকালে হেভি ব্রেকফাস্ট পছন্দ করেন না, তারা শরীর-মন চাঙা রাখতে বিস্কুটের পরিবর্তে খেতে পারেন এই রুটি।
ভেজিটেবল এগ স্যান্ডউইচ
ঝটপট খাবার তৈরির প্ল্যান না থাকলে অনেক সময় সকালের ব্রেকফাস্ট মেইনটেইন করা সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে আগের রাতেই সবজি ও ডিম দিয়ে তৈরি করে রাখা যায় ভেজিটেবল এগ স্যান্ডউইচের পুর, যা সকালে শুধু বাকি উপাদান যোগ করে নিয়ে টোস্টারে দিলেই খাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ রেডি। এতে যথেষ্ট পরিমাণে ব্যালেন্স নিউট্রিশন থাকায় শরীর দুর্বল হওয়া থেকে রক্ষা পায়।
শরীর চাঙা রাখতে সারা দিনের খাদ্যতালিকায় আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান রাখা জরুরি—
অ্যাসকরবিক অ্যাসিড
ত্বকের সুস্থতায় ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে অ্যাসকরবিক অ্যাসিড বা ভিটামিন সি-এর জুড়ি নেই। এটি আমাদের দেহের ফ্রি র্যাডিক্যাল ধ্বংস করে শরীরকে হেলদি রাখতে কাজে দেয়। গরমে শরীর চাঙা রাখতে খাবারের তালিকায় রাখা যেতে পারে এক টুকরো লেবু। এ ছাড়া কিউই, টমেটো, স্ট্রবেরি, ব্রকলি, পেঁপে ইত্যাদি ভিটামিন সি-এর ভালো উৎস।
পটাশিয়াম
সুস্থ থাকতে হলে ম্যাক্রো-নিউট্রিয়েন্টের পাশাপাশি মাইক্রো-নিউট্রিয়েন্টের দিকেও খেয়াল রাখা চাই। গরমে যখন আমাদের শরীর থেকে প্রচুর ঘাম বের হয়ে যায়, তখন বিভিন্ন ধরনের খনিজ উপাদানের পাশাপাশি নিঃসৃত হয় পটাশিয়াম; ফলে চাঙা শরীর হয়ে পড়তে পারে দুর্বল। এতে টায়ার্ডনেস, মাসেল ক্র্যাম্পিং শুরু হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ডাবের পানি রাখতে পারেন খাদ্যতালিকায়। এ ছাড়া কলা, অ্যাভোকাডো, ড্রাই ফ্রুটস, বিভিন্ন ধরনের ডালও পটাশিয়ামের দারুণ উৎস।
ম্যাগনেশিয়াম
চিনাবাদাম, কাজুবাদাম, চিয়া সিড, ডার্ক চকলেট প্রভৃতি ম্যাগনেশিয়ামের ভালো উৎস। শরীর চাঙা রাখতে এ ধরনের খাদ্য রাখা যেতে পারে ডায়েটে।
জিংক
রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে, মুখের রুচি ঠিক রাখতে, ক্ষত নিরাময়ে এমনকি শরীর চাঙা রাখতে জিংক সাহায্য করে। কর্নফ্লেক্স, হোল গ্রেইন, পামকিন সিডস, মিক্সড নাটসে প্রচুর জিংক রয়েছে। তাই চাঙা থাকতে খাদ্যতালিকায় ব্যালেন্স ডায়েটের পাশাপাশি এ ধরনের পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারও রাখা চাই।
মনে রাখা চাই, যার পরিশ্রম যতটুকু, তার ক্যালরি ও পুষ্টি চাহিদাও সেই অনুপাতে। আপনি সারা দিন কী ধরনের পরিশ্রম করছেন, তার ভিত্তিতে ডায়েটারি মডিফিকেশন করে নিতে হবে। সারা দিনে পাঁচ থেকে ছয়বার খাওয়া হেলদি হ্যাবিট। এ ক্ষেত্রে ক্যালরি ভাগ করে নিয়ে বারবার খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস আমাদের মুটিয়ে যাওয়া থেকে মুক্তি দেবে, শরীরও চাঙা রাখবে।
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান
পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট