ফিচার I নাম বিড়ম্বনা
শতভাগ স্বদেশি সৌন্দর্যপণ্যেও লেগে যেতে পারে বিদেশি তকমা। শুধু নামের বরাতে। যত জনপ্রিয়ই হোক না কেন, ব্যবসার বারোটা বাজিয়ে দিতে যথেষ্ট। অতীত সাক্ষী
সমগ্র ভারত তখন আন্দোলিত স্বদেশি ঝড়ে। বিদেশি সব পণ্য যেন চক্ষুশূল। ব্রিটিশ উৎপাদিত হতে হবে, তা-ও নয়; শুধু বিদেশি নাম থাকলেই খেল খতম। সেই রোষানলে পড়ে মার খেতে বসেছিল একদম নতুন আনকোরা এক ব্যবসা।
আফগান রূপকথা
সে মজার এক গল্প। একদম অপ্রত্যাশিত। ১৯১৯ সালের ঘটনা। ভারত ভ্রমণে আসেন আফগানিস্তানের রাজা মোহাম্মদ জহির শাহ। তাকে অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত হয়েছিলেন তৎকালীন মুম্বাইয়ের বহু তরুণ ব্যবসায়ী। তাদের মধ্যে ছিলেন দাউদি বোহরা মুসলিম পরিবারের যুবক ইব্রাহিম সুলতানালি পাঠানওয়ালা। দারুণ দূরদর্শী হওয়ায় রাজস্থানজুড়ে নামডাক ছিল এ সুগন্ধি দ্রব্যের ব্যবসায়ীর। তাই তো সুগন্ধির পাশাপাশি রাজার দিলখুশ করতে সঙ্গে নিয়ে যান সদ্য উদ্ভাবিত ছোট্ট এক কৌটা সফেদ ক্রিম। গোলাপি ঢাকনা দেওয়া কাচের সে কৌটা আসে জার্মানি থেকে, ওপরের নাম লেখা লেবেল আসে জাপান থেকে। যা খুলতেই জহির শাহের চোখে ভেসে ওঠে তুষারাচ্ছাদিত কাবুলের অপরূপ সৌন্দর্য। আফগানি তুষারের সঙ্গে তুলনীয় সুরভিত মলম। রাজার মুখে এমন নস্টালজিয়ার কথা শুনে এক মুহূর্তও দেরি করেননি পাঠানওয়ালা। জার্মান কিংবা জাপান নয়, ভারতের প্রথম বিউটি ক্রিমের নাম ‘আফগান স্নো’ রাখার প্রস্তাবটা দিয়েই ফেলেন অকপটে। অনুমোদন মিলে যায় খোদ রাজার কাছ থেকেই। ইতিহাসে পাতায় নাম উঠে যায় সাধারণ একটি ক্রিমের, তা-ও আবার রাজসিক পদমর্যাদা নিয়ে। অভাবনীয় সূচনাই বটে। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত আফগান স্লোর কৌটার গায়ে লেখা থাকত আফগানিস্তানের রাজার কথা।
ক্রিমের চেয়ে বেশি কিছু
ভারতের প্রথম বিউটি ক্রিমের তকমা জিতে নেওয়া আফগান স্নো সে সময়কার বিউটি স্ট্যান্ডার্ডকে যেন নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে। অভিজাতদের মধ্যে তো বটেই, দেখতে দেখতে ভারতের অন্দরমহল দখল নিয়ে নেয় এই ক্রিম। সব জায়গায় বিপণন কেন্দ্রের সুবিধা না থাকলেও এই স্নো বিক্রির ক্ষেত্রে সামান্যতম ব্যাঘাত ঘটেনি। বিক্রি তো কমেইনি, বরং দিন যত পেরিয়েছে, চাহিদা বেড়েছে হু হু করে। গ্রাম-মফস্বল থেকে শহরে এসে নারীরা কিনে নিয়ে যেতেন এই ক্রিম। কারও কারও পরিবারে পুরুষেরাই ছিলেন ভরসা। তাদের দিয়ে দূরদূরান্ত থেকে আফগান স্নো আনিয়ে নিতেন বাড়ির নারীরা। হাজার রকমের প্রসাধন ব্যবহারের চল ছিল না তখন। এক আফগান স্নো দিয়েই একাধারে ময়শ্চারাইজার, মেকআপ-বেইজ আর সানস্ক্রিনের কাজ সেরে নেওয়া হতো। ত্বকরঙে পরিবর্তন আনা নয়, বরং এই ক্রিমের লক্ষ্য ছিল ত্বক পরিপূর্ণ পুষ্টির জোগান আর দাগছোপ মুক্ত করে ফেলা।
স্বদেশি আন্দোলনের প্রভাব
ভারতজুড়ে স্বদেশি ঝড় তখন তুঙ্গে। শুধু নামে আফগানিস্তানের উল্লেখ থাকায় স্বদেশিদের বিষ নজরে পড়ে যায় শতভাগ ভারতীয় এ স্নো। উপায়ান্তর না পেয়ে শেষ পর্যন্ত খোদ মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন কোম্পানির কর্ণধার ইব্রাহিম পাঠানওয়ালা। তিনি পুরো বিষয়টা শোনেন। উপায়ও বাতলে দেন বিপদ থেকে উদ্ধারের। সিদ্ধান্ত হয়, মহাত্মা গান্ধী নিজেই এই ক্রিমের বিজ্ঞাপন লিখে দেবেন। সেখানে সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকবে, এই ক্রিম শতভাগ স্বদেশি। তাহলেই তো আর কারও আপত্তি থাকবে না। হলোও তাই। লোকসান থেকে আবার উতরে উঠতে শুরু করল ক্রিমটি। ক্রমশ সারা দেশে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে গেল আফগান স্নো। আজ থেকে পাঁচ দশক আগেও বিউটি ক্রিমকে ভারতীয়রা স্নো নামেই বেশি চিনতেন। এই স্নো আর কিছু না, আফগান স্নোর ডাকনাম।
স্নোর সোনালি যুগ
স্বাধীনতা-পরবর্তী রমরমা ছিল স্নোর বাজার। আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে ওঠে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। সে সময় ভারতীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়বদ্ধতা বেড়েছিল অনেকটা। ১৯৫২ সালে প্রথম মিস ইন্ডিয়া প্রতিযোগিতার আয়োজনের পেছনে ছিল পাঠানওয়ালার এই কোম্পানি। সেই সময় প্রথম সারির অভিনেত্রীদের দেখা গেছে আফগান স্নোর বিজ্ঞাপনে। দেবিকা রানী, পদ্মিনী কোনাপুরি থেকে পুনম ধিলন—সবাই ছিলেন সে তালিকায়। উনিশ শতকের আশির দশক পর্যন্ত গোটা দেশে একচ্ছত্র বাজার ছিল এই স্নোর।
পতন পর্ব
শুরুর দিককার একচ্ছত্র আধিপত্য আর জনপ্রিয়তার প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও আধুনিক সৌন্দর্যবিশ্বে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতার বাজারে মার খেয়ে যায় আফগান স্নো। আশির দশকের পরবর্তী সময় রমরমা বাড়তে শুরু করে বহুজাতিক সব ব্র্যান্ডের। বিপুল বাজারজাতকরণ বাজেট আর আনকোরা সব মোড়কের উদ্ভাবন এ ক্ষেত্রে হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাতে শুরু করে কোম্পানিগুলো। পাল্টে যেতে থাকে চিরচেনা বিউটি ইন্ডাস্ট্রির গতিপথ। বিউটি স্ট্যান্ডার্ড সেট হতে শুরু করে গায়ের রঙের ওপর নির্ভর করে। ফলাফল—কেয়ারনেস ক্রিমের উত্থানের ধাক্কায় বাজার পড়তে থাকে আফগান স্নোর। এখন অস্তিত্ব প্রায় বিলীনই বলা চলে। তবে স্মৃতিপটে হয়তো এখনো উজ্জ্বল কারও কারও, ফিকে হয়ে যায়নি নাম, যা যুগের পর যুগ মনে করিয়ে দেবে, সামান্য একটি ক্রিমও পুরো সমাজের সৌন্দর্যভাবনার প্রতিফলন হয়ে উঠতে পারে। সাক্ষ্য হয়ে থাকতে পারে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের। রয়ে যেতে পারে বাণিজ্য ও জাতীয়তাবাদের ঐতিহাসিক আন্তপ্রক্রিয়ার প্রমাণ হিসেবে।
বিউটি ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট