টেকসহি I রিথিঙ্কিং রিসাইকেল
অসচেতনতা নাকি অব্যবস্থাপনা? বিশ্বব্যাপী সৌন্দর্যবর্জ্যরে বোঝা সমন্বয়ে মূল অন্তরায় আসলে কোনটা। পরিবেশ রক্ষায় এখন না জানলেই নয়
বিউটি প্রোডাক্ট ব্যবহার শেষে খালি কৌটা, টিউব বা বক্সগুলো দিয়ে কী করা হয়? জমিয়ে রাখেন, তো কেউ কেজি দরে হকারদের কাছে বিক্রি করে দেন। অনেকে আবার কিছুই করেন না। সেগুলোর জায়গা হয় ময়লার বাক্সে। এসবই কিন্তু পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তাহলে সঠিক উপায় কী? বিশ্বজুড়ে বিউটি প্যাকেজিং-সংক্রান্ত এ সমস্যা ক্রমেই প্রকট আকার ধারণ করছে। যা নিয়ে প্রচুর আলোচনা, সমালোচনা, বাদ-বিবাদও হয়ে গেছে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিউটি ব্র্যান্ডগুলো যদিও এ ধরনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কিন্তু প্রতিবছর উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ বিউটি প্যাকেজিং মোকাবিলায় সেই প্রতিশ্রুতির অগ্রগতি খুবই ধীর; যা পরিবেশের জন্য রীতিমতো হুমকি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সাধারণ ভোক্তাদের মনে হতে পারে, এটি তেমন জটিল সমস্যা নয় কিংবা এর সমাধানে আমাদেরই-বা কী করার আছে? দুটো ধারণাই ভুল। সমস্যাটি জটিল এবং ভোক্তাদের অনেক কিছু করণীয় রয়েছে। বাজার গবেষণা বিশ্লেষক ইউরোমনিটরের মতে, সৌন্দর্যশিল্প—সৃষ্ট প্যাকেজিংয়ের পরিমাণ প্রতিবছর ১৫১ বিলিয়ন, যার বেশির ভাগই প্লাস্টিক। এর অধিকাংশ পুনর্ব্যবহার করা খুব কঠিন কিংবা সম্পূর্ণরূপে পুনর্ব্যবহৃত হওয়ার উপযোগী নয়। এলেন ম্যাকআর্থার ফাউন্ডেশনের নিউ প্লাস্টিক ইকোনমি প্রজেক্টের প্রোগ্রাম ম্যানেজার সারা উইংস্ট্র্যান্ড বিষয়টি নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। ভোগ ম্যাগাজিনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বেশির ভাগ বিউটি প্যাকেজিংই সত্যিকার অর্থে রিসাইক্লিং প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার জন্য ডিজাইন করা হয়নি। কিছু প্যাকেজিং এমন উপকরণ থেকে তৈরি, যেগুলোর পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্রবাহ নেই। সেগুলো নষ্ট করে ফেলাই পরিবেশের জন্য মঙ্গলজনক।’ প্রশ্ন হচ্ছে, কাজটি করবে কে?
পরিবেশবাদীদের চাপে পড়ে জনপ্রিয় বিউটি ব্র্যান্ডগুলো অবশ্য ইদানীং এ শিল্পের প্লাস্টিক সমস্যা মোকাবিলার আশ্বাস জুগিয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে তারা তাদের প্যাকেজিংগুলোর শতভাগ পুনর্ব্যবহারযোগ্য বা জৈবভিত্তিক করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ইউনিলিভার, কোটি ও বায়ার্সডর্ফ তাদের প্লাস্টিক প্যাকেজিং পুনর্ব্যবহারযোগ্য বা কম্পোস্টযোগ্য কি না, তা ২০২৫ সালের মধ্যে নিশ্চিত করার কথা দিয়েছে। এস্টি লডার তো আরও এক ধাপ এগিয়ে। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই প্যাকেজিংয়ের অন্তত ৭৫ শতাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য ও পুনরুদ্ধারযোগ্য করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে ব্র্যান্ডটি। কিন্তু পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মত, অগ্রগতি এখনো মন্থর। কারণ, পরিসংখ্যান অনুযায়ী আজ পর্যন্ত পেট্রোলিয়াম থেকে প্রাপ্ত প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়েছে ৮ দশমিক ৩ বিলিয়ন টন, যার ৬০ শতাংশই ল্যান্ডফিল বা প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করতে যথেষ্ট। বাকি ৪০ শতাংশের কথা তো বাদই!
সারা উইংস্ট্র্যান্ডের মতে, সৌন্দর্য প্যাকেজিং বর্জন এবং পুনর্ব্যবহার করার লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো গেলে তবেই সত্যিকারের অগ্রগতি সম্ভব। যার জন্য বিউটি ব্র্যান্ডগুলোর পুনর্ব্যবহারযোগ্য চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক প্যাকেজিংয়ের মাত্র ১৪ শতাংশ রিসাইকেল করার জন্য সংগ্রহ করা হয়। পরের ধাপে বাছাই ও রিসাইক্লিং প্রক্রিয়া চলার সময় ক্ষতির কারণে সেই উপাদানগুলোর মাত্র ৫ শতাংশ পুনরায় ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া কিছু প্যাকেজিং বিভিন্ন ধরনের উপাদানের মিশ্রণ দিয়ে তৈরি, যা এর পুনর্ব্যবহার কঠিন করে তোলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে সাধারণত প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়াম স্প্রিংয়ের মিশ্রণে তৈরি প্যাকেজিংগুলোর কথা। এ ক্ষেত্রে রেন ক্লিন স্কিন কেয়ারের সিইও আর্নড মেইসেলের মত, বিউটি কোম্পানির জন্য কোনো সহজ সমাধান নেই; কারণ, বিশ্বজুড়েই রিসাইক্লিং করার প্রক্রিয়া অনেক আলাদা। এমনকি ফুল রিসাইক্লেবল প্যকেজিংও পুরোপুরি পুনর্ব্যবহারযোগ্য না হওয়ার ৫০ শতাংশ সম্ভাবনা থাকে। এ কারণে ব্র্যান্ডটি পুনর্ব্যবহারযোগ্যতায় জোর না দিয়ে বরং প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রে রিসাইকেলড প্লাস্টিক ব্যবহারের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। ভার্জিন প্লাস্টিক তৈরি করছে না ব্র্যান্ডটি। সম্প্রতি তাদের জনপ্রিয় সৌন্দর্যপণ্য এভারকাম গ্লোবাল প্রোটেকশন ডে ক্রিমের প্যাকেজিংয়ে নতুন ইনফিনিটি রিসাইক্লিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে তাপ ও চাপ প্রয়োগে এটি রিসাইকেল করে বারবার ব্যবহার করা যাবে। প্যাকেজিংয়ের ৯৫ শতাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য; যেখানে বর্তমানের বেশির ভাগই পুনরায় ব্যবহার করা যায়। সমস্যা হলো বাকি বিউটি ব্র্যান্ডগুলো এখনো এই ইনফিনিটি রিসাইক্লিংয়ের মতো প্রযুক্তি ব্যবহারের ব্যাপারে তেমন আগ্রহী নয়।
উইংস্ট্র্যান্ডের মতে, আখ ও ভুট্টার স্টার্চ দিয়ে তৈরি জৈবভিত্তিক প্লাস্টিক তৈরি করাও সহজ সমাধান নয়। যদিও প্রায়শ একে বায়োডিগ্রেডেবল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার মতে আসল সমাধান হলো, যেখানে সম্ভব, যত দূর সম্ভব প্যাকেজিং পুরোটাই বাদ দেওয়া; যা প্রথমেই পুনর্ব্যবহার ও কম্পোস্টিংয়ের প্রয়োজনীয়তা কমায়। শুধু সুগন্ধি সুরক্ষিত রাখার জন্য প্লাস্টিকের আবরণ ব্যবহার করা যেতে পারে; অন্যথায় নয়।
রিফিলেবল পণ্য কেনায় ভোক্তাদের আগ্রহ বাড়ানো চাই, যেখানে বাইরের মোড়ক সংরক্ষণ করা যায়। ভেতরটা ফুরিয়ে গেলে শুধু রিফিল কিনে আগের প্যাকেজিংয়ে পুরে আবার ব্যবহার করা যেতে পারে। বিশ্বজুড়ে ইতিমধ্যে রিফিল করার ধারণাটি গ্রহণ করা শুরু হয়েছে। তবে উইংস্ট্র্যান্ড বলেছেন, এখানেও কথা আছে! স্যাশে প্যাক ব্যবহার করা যাবে না রিফিল করার সময়। এতে হিতে বিপরীত হবে।
তার মতে, ভোক্তাদের আরও দায়িত্ব আছে। পরিবেশবান্ধব প্যাকেজিংয়ের দাবি করে এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে সহায়তা করা যেতে পারে। এই দাবি কোম্পানিগুলোকে আরও উদ্ভাবনী সমাধানে বিনিয়োগ করতে বাধ্য করবে। তা ছাড়া প্রয়োজন লাইফস্টাইলের সহজ সব পরিবর্তন।
রত্না রহিমা
ছবি: সংগ্রহ