ফরহিম I এজিং লাইক আ ওয়াইন
ইনস্টাগ্রাম, পিন্টারেস্টের এই দুনিয়ায় জনপ্রিয় এই ইন্সপিরেশনাল কোটেশন চোখ এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল বটে। পরিচিত মনে হচ্ছে?
বয়স। অনেকের কাছে কেবলই সংখ্যাসূচক। বয়স বৃদ্ধিতে অবসাদ নেই; বরং প্রজ্ঞার উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত তারা। তাদের বয়সের পাল্লা ভারী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা বাড়ে। ওয়াইনের সঙ্গে মিলটাও ঠিক এখানে। সমঝদারেরা বলেন, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে ওয়াইনের স্বাদ। পুরোনো ওয়াইনের চাহিদা তাই ঈর্ষণীয়। এজিং লাইক আ ওয়াইন—এই প্রবাদে সেই গল্পই লুকানো।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের বুদ্ধি, দর্শন, চিন্তার গভীরতা বাড়ে; যা তাকে অন্য সময়ের চেয়ে বিশেষ করে তোলে। কৈশোর, তারুণ্য, যৌবনের পরেই মধ্যবয়সের হাতছানির যে প্রচলিত ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠিত, তাকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো সেসব মানুষকেই তুলনা করা হয়েছে ওয়াইনের সঙ্গে। এরা সেসব পুরুষ, যারা মধ্যবয়সেই নতুন করে আবিষ্কার করেন নিজেকে। অনুপ্রেরণা হয়ে থাকেন হাজার জনের।
পরিবর্তন সুন্দর
মধ্যবয়সে চুলে পাক ধরে, টাক তৈরি হয়, চামড়া কুঁচকে যায়, ভুঁড়ি উঁকি দেয়—এমন অনেক রকম কথার প্রচলন আছে। সবার ক্ষেত্রে যে ঠিক একই বয়সে এমন হয়, তা নয়। আবার হলেই জীবন থেমে যাবে, তা-ও নয়। তবু কী এক অশনিসংকেত এই বয়সকে ঘিরে! যেন মধ্যবয়স মানেই ফুরিয়ে যাওয়া। আশার কথা হচ্ছে, এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়। কেউ কেউ দারুণভাবে বয়সকে উদ্যাপন করেন। তাদের কাছে বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে যে পরিবর্তন আসে, তা সুন্দর।
বয়স বাড়লে মন যেমন পরিবর্তিত হয়, তেমনি শরীরও। এই পরিবর্তনকে ভয় পাওয়ার প্রবণতা মানুষকে দমিয়ে রাখে। একসময় বিশ বছরকে মেয়েদের জন্য অনেক বয়স হিসেবে গণ্য করা হতো। ছেলেদেরও ঘিরে রাখত ফুরিয়ে যাওয়ার ভয়। মেয়েদের তুলনায় দেরিতে আসত সেই ক্ষণ; কিন্তু আসতই। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যে পরিবর্তন আসে, তার নামকরণ করা হয়েছিল বয়সের ছাপ। এ যেন এক অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি; যাকে কেউ চায় না। এমন ধারণার সঙ্গী হয়ে ছিল বয়স লুকানোর প্রবণতা। নিজের সত্যিকারের বয়স জানাতে কী ভীষণ অস্বস্তিতে ভুগতে দেখা যেত মানুষকে! এমন ধারণা পরিবর্তিত হচ্ছে। ধীরে ধীরে বয়স উদ্যাপন করতে শিখছে মানুষ। প্রতিটি আলাদা বয়সের সৌন্দর্য, স্বাদ আস্বাদন করতে শিখেছে। নতুন বছর, জন্মদিনসহ বিশেষ উপলক্ষে প্রাণচঞ্চল এসব মানুষকে দেখা যায় জীবনযাপনের নানা দিক নিয়ে উচ্ছ্বসিত হতে। স্বপ্ন দেখতে। অন্যকে স্বপ্ন দেখাতে। মনের সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বলতা ছুঁয়ে যায় তাদের দেহকেও। যাকে বলা হয় এজিং গ্রেসফুলি। এ জন্য মূল উপাদান মাত্র তিনটি—শারীরিক সুস্থতা, মানসিক প্রশান্তি এবং সামাজিক যোগাযোগের দক্ষতা। চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেলজয়ী চিকিৎসক এলিজাবেথ ব্ল্যাকবার্ন প্রদত্ত মতবাদ পাওয়া গেছে অন্তর্জালে। তিনি বলেছেন, এজিং বলতে শুধু সংখ্যার হিসাবকে বোঝায় না; বংশগতি, জীবনযাপনের ধরন, পরিবেশও এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শুধু সময়ের হিসাব নয়, এতে যোগ হবে জীবনযাপনের মানও। স্বাস্থ্যের প্রতি মনোযোগ, জীবনীশক্তির যথাযথ ব্যবহারও এ ক্ষেত্রে জরুরি বটে। আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও কথা বলেছে বিষয়টি নিয়ে। এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মত অনুযায়ী, হেলদি এজিং একটি প্রক্রিয়া; যা জীবনের শেষ পর্যন্ত সুস্থ থাকার শক্তি হিসেবে কাজ করে। সাহস দেয়।
আমেরিকান মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত একটি আর্টিকেলের মাধ্যমে জানা যায়, বয়সের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাবসম্পন্ন মানুষের বড় একটি সুবিধা হচ্ছে, তারা সুস্থ থাকেন বেশি সময় ধরে। সাধারণত বাঁচেনও বেশি দিন।
স্নিগ্ধ সরল
মন আর স্বাস্থ্য ভালো রাখার সঙ্গে সঙ্গে সৌন্দর্য নিয়েও ভাবনার অবকাশ চাই। তাতে নিজের এই ভালো থাকার চেষ্টা আরও জোরালো হবে। মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার জরুরত নেই। তবু অন্যের ইতিবাচক মূল্যায়ন অনেক সময় প্রেরণার উৎস হতেই পারে। সঙ্গে সহজ-সরল ত্বকচর্চা ধরে রাখতে পারে সুন্দরতা।
একেক বয়সে ত্বকের চাহিদা একেক রকম। তবে সব বয়সে প্রয়োজন যত্নের। আয়নায় মনোযোগ দিয়ে তাকালে ত্বকের প্রয়োজন বেশ খানিকটা বোঝা যায়। আবার সাধারণ কিছু চাহিদাও আছে। আলাদা করে ব্যক্তিগত চাহিদা স্কিন স্পেশালিস্টকে জানিয়ে সমাধান খুঁজে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। সূচনা ত্বক পরিষ্কারেই করা যাক।
ক্লিনজার নির্বাচনের ক্ষেত্রে ত্বক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হাইড্রেটিং ক্লিনজার বেছে নেওয়ার। ত্বককে রুক্ষ করবে এমন সবকিছুকেই বিদায় জানানো চাই। বয়সী ত্বকের যত্নে হায়ালুরনিক অ্যাসিডের প্রয়োজনীয়তা অনেক। তাই নিয়মিত ব্যবহার করা যেতে পারে। রেটিনল বয়সী ত্বকের উপকারী বন্ধু। যেকোনো বিউটি প্রোডাক্ট কেনার ক্ষেত্রে রেটিনলের উপস্থিতি খুঁজে দেখা যেতে পারে। পেয়ে গেলে বাজিমাত! সূর্যের আলোর প্রভাব থেকে ত্বককে সুরক্ষা দেওয়া অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আলট্রা ভায়োলেট রে ত্বকে বয়সের ছাপ প্রকট করে।
ত্বকের যথাযথ যত্নে নিয়মিত হলে সজীবতা দৃশ্যমান হয়। ত্বকের নিজস্ব সৌন্দর্য বয়সের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। সে কথা মাথায় রেখে যত্নের গুরুত্ব বুঝতে হবে। তবে এ বয়সে বেশির ভাগ মানুষ ত্বকে ভাঁজ খুঁজে পেয়ে থাকেন। টান টান ত্বকের বিভিন্ন জায়গায় আসে পরিবর্তন। এর মূল কারণ চামড়ার নিচের চর্বির প্রলেপের পরিবর্তন। কপালে বলিরেখা, চোখের পাশে ভাঁজ, গাল বসে যাওয়া, ফেশিয়াল হেয়ার, মেছতার উপস্থিতির মতো অনেক কিছু হতে দেখা যায়। এগুলোকে অনাকাঙ্ক্ষিত হিসেবে না দেখে প্রাকৃতিক পরিবর্তন হিসেবে গণ্য করলে মনের ওপর চাপ কম পড়বে। আর মনের সঙ্গে ত্বকের যে নিগূঢ় সম্পর্ক, তা তো অজানা নয়। তাই মন ভালো রাখা খুব প্রয়োজন। এ বিষয়ে ডারমাটোলজিস্ট অ্যালেক্সা কিম্বালের অভিমত, প্রাকৃতিক পরিবর্তনকে সাদরে গ্রহণ নিজস্বতাকে আরও আপন করে নেওয়ার দিকে এক ইতিবাচক পদক্ষেপ; যা মানসিক সুস্থতা বাড়িয়ে তোলে।
সিলভার লাইনিং
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চুলে পরিবর্তন আসে। চুলের বৃদ্ধি ধীর হয়ে যায় এবং ঘনত্ব কমে আসতে পারে। কপালের দিকে চুল কমে গিয়ে তৈরি হতে পারে টাক। সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা দেয় যে পরিবর্তন, সেটা হচ্ছে চুলের রং বদল। কালো চুলের মাঝে উঁকি দেয় একটি-দুটি রুপালি চুল, তখন হতাশা পেয়ে বসে অনেককে। যদিও কয়েক বছর ধরে এ ব্যাপারে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। অনেকে প্রাকৃতিক পরিবর্তন মেনে নিচ্ছেন সাদরে। পাকা চুল তাদের কাছে সিলভার লাইনিং। কৃত্রিম কালো রং ব্যবহারে চুলকে বদলে দেওয়ার কোনো তাড়া নেই তাদের; বরং চুলের এই বদলে যাওয়া উদ্যাপন করছেন নানাভাবে। হেয়ার কালারের বিভিন্ন শেড নব্বইয়ের দশক থেকে জনপ্রিয়। চুলের রং বদলে নেওয়া যেতে পারে যেকোনো বয়সেই। ব্যক্তিগত ইচ্ছা হিসেবে যে কেউ যেকোনো শেড বেছে নিতে পারেন। তবে তা সামাজিক চাপে না হলেই ইতিবাচক।
চুল পড়ে যাওয়ার সমস্যা দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি। আধুনিক প্রযুক্তি চিকিৎসাব্যবস্থাকে উন্নত করেছে। চুল কেন ঝরে যাচ্ছে, তার কারণ খুঁজে বের করতে গেলে দেখা যাবে, পুষ্টিহীনতার দায় শীর্ষে। দায়ী থাকতে পারে বংশগতিও। আবার অনেকের চুল বাহ্যিক কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন পানিতে রাসায়নিকের উপস্থিতি। ঠিক কোন কারণে সমস্যাটি হচ্ছে জানা গেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে।
টুকিটাকি টিপস
শরীর আর মন—দুয়ের উদ্দীপনা জিইয়ে রাখতে ছোট ছোট কিছু বিষয় খেয়াল রাখলে মধ্যবয়স দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারে।
পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাদ্যতালিকা
নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম
চাপ সামলানোর কৌশল আর মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বের সমন্বয়
সামাজিক যোগাযোগ বৃদ্ধি
বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ত্বকের যত্ন
বয়স বৃদ্ধির প্রাকৃতিক পরিবর্তনগুলো সহজভাবে নেওয়া; যেমন চুলের রং বদলে যাওয়া এবং চামড়ার ভাঁজ
শখকে গুরুত্ব দেওয়া
নিয়মিত জরুরি চিকিৎসা গ্রহণ
চাকরি-পরবর্তী অবসর যাপনের জন্য অর্থ সংরক্ষণ
আইনগত বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান
জীবনবিমার মতো দীর্ঘস্থায়ী সঞ্চয় পরিকল্পনা
বাস্তব জীবনে যারা বয়সকে দারুণভাবে উপভোগ করেন, তাদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ।
প্রতিটি মুহূর্ত বাঁচার প্রেরণায় তরুণ থাকুক মন। সুন্দরতা ঘিরে থাকুক প্রতিদিন। প্রতি মুহূর্তে।
সারাহ্ দীনা
মডেল: সাদাত
মেকওভার: পারসোনা মেনজ
ছবি: কৌশিক ইকবাল