skip to Main Content

টেকসহি I বয়নের বিষক্রিয়ায়

তদন্ত সূত্রে পাওয়া তথ্য। মিলেছে জনপ্রিয় সব লাক্সারি ব্র্যান্ডের জড়িত থাকার প্রমাণ। তারপরও সমস্যার সুরাহায় পিছিয়ে গোটা ইন্ডাস্ট্রি

‘টু ডাই ফর’। প্রথমবার শুনলে মনে হতে পারে, কোনো জমাটি প্রেমের গল্পের বই। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি। বিখ্যাত সাংবাদিক অ্যালডেন উইকার ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির গুরুতর এক সমস্যা নিয়ে লিখেছেন বইটি। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে ফ্যাশনপ্রেমী ও ফ্যাশনকর্মীদের ওপর পরিধেয়র নিরাপত্তাসংক্রান্ত সমস্যা এবং এর বিষাক্ত প্রভাবের বিষয়টি। যারা ফ্যাশনশিল্প নিয়ে কাজ করেন বা ফ্যাশন ভালোবাসেন, তাদের জন্য বইটি ভীষণ জরুরি। যদিও বিষয়বস্তু চট করে ধরে ফেলার উপায় নেই, বুঝতে হলে একটু পেছনে যেতে হবে। ইতিহাস ঘাঁটতে হবে।
সতেরো শতকে সম্রাট আওরঙ্গজেব তার শত্রুদের হত্যায় অস্ত্র হিসেবে বিষযুক্ত খিলাত ব্যবহারের জন্য পরিচিত ছিলেন। এই খিলাত আবার ছিল সম্মানসূচক পোশাক হিসেবে সমাদৃত। কেবল মোগল সম্রাট এ ধরনের কৌশল অবলম্বন করেছিলেন এমন নয়; ষোলো শতকেও এমন ঘটনা ঘটেছে। সেই সময়ের বিখ্যাত, সম্ভ্রান্ত নারী ক্যাথরিন ডি মেডিসিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী নাভারের রানি জিন ডি’আলব্রেট এক জোড়া বিষাক্ত গ্লাভস উপহার দিয়ে হত্যা করেছিলেন। অনেকের মনে হতে পারে, এগুলো বহু পুরোনো কথা। তাদের মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে, ২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের সৎভাই কিম জং-নামকেও ঠিক একইভাবে হত্যা করা হয়। কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে তাকে মারার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল বিষযুক্ত এক টুকরো ফ্যাব্রিক। অনেকের ধারণা হতেই পারে, জীবননাশের এ কৌশলগুলো অন্য যুগের, অথবা কেবল গোপন এজেন্টরা একাই এসব ব্যবহার করে থাকে; সেটাও কিন্তু ভুল। বিষযুক্ত ফ্যাব্রিক বাজারেই বিদ্যমান। অজান্তেই সেগুলো প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত হচ্ছে। মূলত সে কারণেই পড়া প্রয়োজন ইনভেস্টিগেটিভ ফ্যাশন জার্নালিস্ট অ্যালডেন উইকারের বইটি, যেটির পুরো শিরোনাম ‘টু ডাই ফর: হাউ টক্সিক ফ্যাশন ইজ মেকিং আস সিক অ্যান্ড হাউ উই ক্যান ফাইট ব্যাক’।
বইটিতে বলা হয়েছে, এই একুশ শতকে এসেও ফ্যাশন লেবেলগুলো তাদের ভোক্তাদের কীভাবে এমন পোশাক সরবরাহ করছে, যা কার্যত অনেকটা বিষাক্ত অস্ত্রের মতো কার্যকর। অভিজাত ব্র্যান্ড থেকে শুরু করে শিইনের মতো অতিদ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ফ্যাশন প্ল্যাটফর্ম—কেউই এই ধরনের অপব্যবহারের বাইরে নয়। সংক্ষেপে বলা যায়, বইটি ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি যে কত মারাত্মক, তা সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
উইকার অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন ২০১১ সালে আলাস্কা এয়ারলাইনসের কয়েক শ ক্রুর অভিযোগের কারণে। যারা কোম্পানির দেওয়া নতুন ইউনিফর্ম পরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ফুসকুড়ি থেকে শুরু করে অ্যানাফিল্যাকটিক শক আর অটোইমিউন রোগে ক্রমাগত আক্রান্ত হওয়ারও রেকর্ড মিলেছে। রোগের লক্ষণগুলোও ছিল অদ্ভুত। দীর্ঘ মেয়াদে প্রাণঘাতী। পরের বছর, গ্রিনপিসের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তাদের পোশাকের ১৪১ টুকরো স্যাম্পলের মধ্যে ৮৯টিতে পাওয়া গিয়েছিল এন্ডোক্রাইন ডিসরাপ্টার। ভাবা যায়! এখানেই শেষ নয়, গবেষণায় আরও জানা যায়, জর্জিও আরমানি, ক্যালভিন ক্লেইনের মতো শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো তাদের পণ্যে রাসায়নিক এবং নিষিদ্ধ সিনথেটিক ডাই অ্যাজো ব্যবহার করার জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছে বহু আগেই। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
গত এক দশকে এই অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন দেখা যায়নি। উইকারের মতে, এখন মানবদেহের ভেতরে বসবাসকারী কৃত্রিম রসায়নের সেই অদৃশ্য জগৎই অনেকের কাছে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। নতুন একটি শব্দ আবিষ্কৃত হয়েছে—হিউম্যান টক্সোম। এই পর্যন্ত সচেতনতার কিছুই সেভাবে তৈরি হয়নি। তার মতে, প্রতিনিয়ত যে পোশাক পরা হয়, তাতে বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় বাধা হলো নিয়মের মারাত্মক অবহেলা। যেখানে সেফটি চেক বলে কিছু নেই। টেক্সটাইল ম্যানুফ্যাকচাররা তাদের উৎপাদিত অব দ্য শেলফ ক্লিনিং প্রোডাক্টস এবং প্যাকেজ করা পণ্যগুলোর রাসায়নিক গঠন নিয়ে মোটেই স্বচ্ছ নন। ফলে অভিযুক্ত লেবেলগুলোর জন্য গ্রাহকদের ‘ব্যক্তিগত সংবেদনশীলতা’র নাম করে বিষাক্ততার অভিযোগ খারিজ করা সহজ হয়ে পড়ে। অথচ, ল্যাবে পরীক্ষার পর জানা যায়, পোশাকগুলোতে অনুমোদিত মাত্রার রাসায়নিক থেকে শুরু করে ক্যাডমিয়াম, অ্যান্টিমনি, কোবাল্ট বা ক্রোমিয়ামের মতো বিপজ্জনক কেমিক্যাল পর্যন্ত আছে। পরিহাস হলো, কেউ এই জাতীয় পদার্থের প্রভাবের দিকে মনোযোগ দেয় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিরাপদ সীমার মধ্যে থেকেও এমন অনেক রাসায়নিক আছে, যেগুলো অন্যান্য রাসায়নিকের সংস্পর্শে এসে মানবদেহে মারাত্মক ক্ষতি করতে সক্ষম। বিশ্বব্যাপী ফ্যাশন শিল্পের রাজস্ব ক্রমেই বেড়ে চলেছে, কিন্তু সেই তুলনায় কয়েক মিলিয়ন মানুষের জীবন বা ভোক্তার স্বাস্থ্যঝুঁকির মূল্য নিয়ে মাথা ঘামানোর কেউ নেই। আগেও ছিল না।
উইকারের মতে, ইতিহাসই সাক্ষ্য দেয়, ফ্যাশনশিল্প কখনো মানুষের নিরাপত্তাকে তার নিজস্ব লাভের ওপরে রাখেনি। ১৮৬০-এর দশকে, ইংল্যান্ডের কোটিপতিরা তাদের টুপিতে উজ্জ্বল সবুজ পাতা রঞ্জিত করার জন্য আর্সেনাইট তামা ব্যবহার করতেন। এই হেডড্রেসগুলো তৈরিকারী দরিদ্র নারী-কর্মীদের জন্য পরে দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৩০-এর দশকে, গবেষকেরা টুপিগুলোতে ব্যবহৃত পশমের মোট ওজনের ১ শতাংশ পারদ খুঁজে পান। পারদের বিষক্রিয়ার অন্যতম প্রভাব হলো মস্তিষ্কের ক্ষতি, যা উইকার বইটিতে ব্যাখ্যা করেছেন। তার গবেষণা অনুযায়ী, পুরো ব্যাপারটি রীতিমতো হতবাক করার মতো। ভীতিকরও বটে। তা ছাড়া প্রতিদিনই পোশাকশিল্পের জন্য আবিষ্কৃত হচ্ছে নিত্যনতুন রাসায়নিক, যেমন দাগ প্রতিরোধী, পানি প্রতিরোধী, অ্যান্টি-রিঙ্কেল, অ্যান্টি-ফাঙ্গাল, অ্যান্টি-ওডর ইত্যাদি। এই টেক্সটাইলগুলো বাস্তবে এমন সব উপাদান দিয়ে প্রলেপিত থাকে, যা ডিএনএ এবং অর্গান সিস্টেমের মারাত্মক ক্ষতি করে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এর দায়ভার কে নেবে কিংবা করণীয়ই-বা কী। পুরো বিষয়ে উইকার তার বইয়ে প্রতিকারের নানা পরামর্শ দিয়েছেন। ফ্যাশনের এই ট্র্যাজেডিকে প্রশমিত করার জন্য প্রয়োজন সরকারি প্রণোদনা। তা ছাড়া বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলজুড়ে উৎপাদনের মানদণ্ডকে পুনরায় ঢেলে সাজাবার জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টাও জরুরি। তার মতে, নিউইয়র্কের অভিজাত বুটিক থেকে ঢাকার ঘিঞ্জি সস্তা পোশাকের দোকানের দূরত্ব আসলে খুব বেশি নয়। কারণ, ফ্যাশনের এই বিষাক্ত রসায়ন একইভাবে একই পোশাক থেকে মানব রক্তে প্রবাহিত হয়; যা হয়তো কেউ টেরও পান না।
 রত্না রহিমা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top