ফিচার I দ্য ডিভা ডুয়ো
লাইক মাদার, লাইক ডটার—ভারতের রাজবংশীয় দুই নারীর জন্যই যেন প্রবাদটির প্রণয়ন। বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিতে অনাপোসী আর ফ্যাশনে পথিকৃৎ। সবেতেই প্রথিতযশা
গেল বছরের মিলান ফ্যাশন উইকের ফল-উইন্টার সিজনের আসর। পর্দা নামাতে মঞ্চে উপস্থিত ৫৩ বছর বয়সী নাওমি ক্যাম্পবেল। পরনে ডলশে অ্যান্ড গ্যাবানা। লেইসি ব্রালেট, সঙ্গে স্বচ্ছ ক্যুলট আর ফিনফিনে সিল্ক শিফনের র্যাপ অ্যারাউন্ড স্কার্টের সঙ্গত। নারীত্বের গাঁথা বয়ানের এমন পোশাকি প্রদর্শনে মন্ত্রমুগ্ধ গোটা ফ্যাশন বিশ্ব। সেই মিলান ফ্যাশন উইকেরই এ বছরের আসনে কুইন অব গাউন খ্যাত ইতালিয়ান ডিজাইনার আলবেত্তা ফেরেত্তির কালেকশনে পষ্ট শিফনের আবেশ। তবে একদম বিপরীত রূপে। এক রাজকুমারীর নেতিবাচকতায় ঝোঁকের বশকে শ্রদ্ধা জানাতে তৈরি এই কালেকশন নিয়েও কম চর্চা হয়নি। ঠিক এর কিছুদিন আগেই নিউইয়র্ক মেতে উঠেছিল নারীত্বের জয়গানে। ক্যারোলিনা হেরেরার শোতে গোলাপি আর বেগনিলাল শিফনের বল গাউনে রাফল জুড়ে দিয়ে, পিওনি ফুটিয়ে। ফ্যাশন সমঝদারদের জন্য তো এতটুকু ইশারাই যথেষ্ট এটা বোঝার জন্য যে, পাশ্চাত্যে আজ অব্দি শিফনপ্রীতিতে ভাটা পড়েনি।
এ তো গেল পশ্চিমা প্রেমের নমুনা, প্রাচ্যের সমাচার কী? তার আগে জানা জরুরি পাশ্চাত্য উদ্ভাবিত এ ফ্যাব্রিকের প্রাচ্যায়ননামা। আর তখনই উল্লেখ করতে হয় ভারতের রাজোচিত ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী দুই নারীর নাম। শিফনের সঙ্গে তাদের সংযোগের সূত্রটা কিন্তু বেশ ইন্টারেস্টিং।
ভারতবর্ষের ফ্যাশন ম্যাপে শিফন প্রবেশ করে নয় গজের ফ্যাব্রিক রূপে। রাজকীয়তার প্রতীক হিসেবে। ওজনে পলকা, স্বচ্ছ স্বরূপ আর অতীন্দ্রি ঔজ্জ্বল্য যুক্ত বস্ত্রখণ্ড রাজ ঘরানার নারীদের মন জয়ে খুব বেশি সময় নেয়নি। পরবর্তী সময়ে পরিণত হয় উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত রাজাধিকারে। যার চর্চা চলে বংশপরম্পরায়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম। হয়ে ওঠে ফ্যাশনসচেতন নারীদের শাড়ি ওয়্যারড্রোবের অংশ। তবে প্রচলনটা কার হাত ধরে?
দ্য ইন্দিরা ইনফ্লুয়েন্স
সূত্রের জট খুলতে শুরু করে একটি পোর্ট্রেেটর হাত ধরে। ১৯২৭ সালে। মাস্টার অব এলিগেন্স খ্যাত অ্যাংলো হাঙ্গেরিয়ান পেইন্টার ফিলিপ দ্য লাজলোর বিখ্যাত সেই চিত্রকর্মে দেখা যায় এক নারীকে। চিকন সোনালি পাড়ের স্বচ্ছ সাদা শাড়িতে। পোর্ট্রটেটি ছিল কোচবিহারের মহারানি ইন্দিরা দেবীর। ভারতবর্ষ সেবারই প্রথম শিফনের সঙ্গে পরিচিত হয়। কিন্তু কে এই ইন্দিরা দেবী? ভারতবর্ষের বারোদার গেকওয়াদ রাজবংশে জন্ম তার, ১৮৯২ সালে। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন আত্মবিশ্বাসী আর চোখধাঁধানো সৌন্দর্যের অধিকারী। ভারতীয় রাজবংশগুলোর মধ্যে প্রথম রাজকন্যা, যিনি উচ্চশিক্ষিতও ছিলেন। মাত্র আঠারোতেই ইন্দিরা রাজের বাগদান সম্পন্ন হয় গোয়ালিয়রের রাজা মাধো রাওয়ের সঙ্গে। কিন্তু ঘটনার মোড় ঘুরে যায় অন্যদিকে। ইন্দিরা মন দিয়ে বসেন কোচবিহারের মহারাজার ছোট ভাই জীতেন্দ্র নারায়ণকে। তাতে স্বাভাবিকভাবেই বাদ সাধে পরিবার। সম্পর্ক ভাঙার নানামুখী প্রচেষ্টাও চালানো হয় ইন্দিরার পরিবার থেকে। কিন্তু বিচক্ষণ রাজকন্যার সামনে তা বেশি দিন ধোপে টেকেনি। এক চিঠিতেই সম্পর্ক শেষ করে দেন মাধো রাওয়ের সঙ্গে। বিয়ে করেন জীতেন্দ্রকে। বারোদার রাজকন্যা ইন্দিরা রাজে হয়ে যান কোচবিহারের রাজকন্যা ইন্দিরা দেবী। বিয়ের কিছুদিনের মাথায় মহারাজের মৃত্যু ঘটে। রাজাসনের দায়িত্ব নেন জীতেন্দ্র। ইন্দিরা দেবী হয়ে যান মহারানি। অবশ্য এক দশক না পেরোতেই মৃত্যু হয় জীতেন্দ্রর। এস্টেটের যাবতীয় দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন ইন্দিরা দেবী। আর দশজন বিধবার মতো জীবন কাটাননি তিনি; বরং দারুণ সক্রিয় সামাজিকতার মধ্যেই পার করেছেন পুরোটা। সাদা শাড়ি পরেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন নানা ধরনের আয়োজনে শামিল হওয়ার জন্য। হয়ে উঠেছিলেন ফ্যাশন আইকনও। নানা দেশে ঘোরার সুবাদে এক ইউরো ট্রিপের সময় ফ্রান্সের লিওনে তার চোখ পড়ে শিফনে। ব্যস, আর যায় কোথায়! মুহূর্তেই বুঝে ফেলেন, শাড়ির জন্য দারুণ ম্যাটেরিয়াল হতে পারে এটি। নয় গজ সাদা শিফন ফ্যাব্রিক অর্ডার করে সঙ্গে নিয়ে তবেই ফেরেন দেশে, ভারতে। ইন্দিরা সেই ফ্যাব্রিকে পছন্দসই পাড় জুড়ে তৈরি করে ফেলেন পুরোদস্তুর শাড়ি। লুক কমপ্লিট করার জন্য তার প্রথম পছন্দ ছিল হীরাখচিত জুতা আর মুক্তার ছড়ার মালা। যা দেখে যে কারও আক্কেলগুড়ুম হতে বাধ্য। মহারানি ইন্দিরা দেবীর সেই আইকনিক লুকই তাকে পরিণত করে ফ্যাশনের ট্রেইল ব্লেজারে। ভারতে তো বটেই, বিশ্বব্যাপী চর্চিত হতে শুরু করেন তিনি। নাম তালিকাভুক্ত হয় বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরী দশ নারীর মাঝে। ইন্দিরা দেবীর ওয়্যারড্রোবের প্রতিটি শাড়ি ছিল ফ্রেঞ্চ লুমে তৈরি, কাস্টম-মেড। বেসপোক এসব শাড়িতে বরাবরই প্রাধান্য পেয়েছে সাদা আর প্যালেটের প্যাস্টেল শেডগুলো। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, ফ্রান্স থেকে ফ্যাব্রিক রূপে আসা শিফনগুলোর ফিনিশিং অর্থাৎ এমব্রয়ডারি অথবা পাড় বসানো হতো ভারতে বসেই।
গ্লোরিফাইড থ্রু গায়ত্রী
জীতেন্দ্র নারায়ণ আর ইন্দিরা দেবীর পাঁচ সন্তানের মধ্যে চতুর্থ গায়ত্রী। ১৯১৯ সালে জন্ম। খুব ছোটবেলায় বাবার মৃত্যুর দরুন গায়ত্রীর জীবনে মা ইন্দিরা দেবীর প্রভাব ছিল গভীর। তিনি ছিলেন উজ্জ্বল, চনমনে। খেলাধুলা আর শিকারে অদম্য আগ্রহ। মাত্র ১২ বছর বয়সে প্রথম চিতাবাঘ শিকার করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সবাইকে। বালিকা বেলা পেরিয়ে নিজের সময়ের সবচেয়ে সুন্দরী নারী হয়ে ওঠেন, ঠিক তার মায়ের মতো। ব্যক্তিত্বেও সে ছাপ ছিল সুস্পষ্ট। তাই মা আর ভাইদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও বিয়ে করেন জয়পুরের মহারাজ, দ্বিতীয় সওয়াই মান সিংকে। সে সময় গায়ত্রীর বয়স মাত্র একুশ আর মহারাজের আরও দুই স্ত্রী বিদ্যমান। তা সত্ত্বেও পিছিয়ে আসেননি; বরং স্বামীকে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, অন্য মহারানিদের মতো প্রাসাদে অন্তঃপুরবাসিনী হয়ে জীবন কাটতে মোটেই রাজি নন তিনি। ঘটেছিলও তাই। ১৯৬০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন রাজনীতিতে। শুধু কি তাই, ভারতীয় রাজপরিবারের ফ্যাশন ল্যান্ডস্কেপের ভোলটাই পাল্টে দেন গায়ত্রী। শাড়িকে পুনরায় নতুন রূপ দেন, আধুনিক নারীদের জন্য। আর শিফনপ্রীতি তো ছিলই, বংশপরম্পরায়, মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। ব্যস, ফ্যাশনসচেতন নারীদের কাছে হয়ে ওঠেন অনুকরণীয়। তার আমলে শুধু প্যাস্টেল শেডেই আটকে ছিল না শিফনের সৌন্দর্য; ফ্লোরাল প্রিন্টেডগুলোরও রমরমা বাড়তে শুরু করে। শাড়ির সঙ্গে মডেস্ট ডিজাইনের লং স্লিভ ব্লাউজে সাজ সারতেন তিনি। তাতে সেলানো থাকত হাতে তৈরি বোতাম। গয়নায় মুক্তা আর পান্নাই ছিল গায়ত্রী দেবীর প্রথম পছন্দ। তার অটোবায়োগ্রাফি ‘আ প্রিন্সেস রিমেম্বার’-এ তিনি লিখেছিলেন, ‘পান্না কখনোই সবুজ শাড়ির সঙ্গে পরা উচিত নয়; কারণ, গোলাপি শাড়ির সঙ্গে এটি আরও বেশি মানায়।’
স্বতন্ত্র ফ্যাশনভাবনা আর দুঃসাহসিকতার সঙ্গে তা নিজস্ব স্টেটমেন্ট হিসেবে উপস্থাপন করায় পারদর্শী এই দুই নারীর দূরদর্শিতা আজও অনুপ্রেরণা গোটা ফ্যাশন বিশ্বের কাছে। ঐতিহ্যবাহী পোশাক দিয়ে সাজে যে আভিজাত্য তারা তৈরি করেছিলেন, তা যুগান্তকারী ছিল বলেই আজকের আধুনিকাদের কাছে শিফনের আবেদন এখনো অমলিন।
জাহেরা শিরীন
মডেল: আনসা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: নাইমুল ইসলাম