skip to Main Content

দৃশ্যভাষ্য I ফ্লাওয়ার পাওয়ার

গুলির জবাবে ইটপাটকেল নয়, ফুল ছুড়ে দেওয়া! আন্দোলনের এমন জাদুবাস্তবতার নজির হয়ে আছে এই বিশেষ আলোকচিত্র

গেল শতকের ষাটের দশকের অসংখ্য আলোকচিত্র ওই প্রজন্মের রাজনৈতিক ও সামাজিক মতবিরোধ এবং প্রতিবাদের ধ্রুপদি প্রতিনিধিত্বের উদাহরণ হয়ে রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্র যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধ, রাজনৈতিক নেতাদের গুপ্তহত্যার শিকার হওয়া এবং নাগরিক অধিকার নিয়ে লড়াইয়ে হিমশিম খাচ্ছিল, কিছু মানুষ অজান্তেই পরিণত হয়েছিলেন শান্তির প্রতীকে। এমনই এক প্রতিমাতুল্য, তবে তুলনামূলক কম পরিচিত আলোকচিত্রে দেখা মেলে গলাবদ্ধ সোয়েটার পরিহিত, সোনালি চুলের এক যুবকের, যিনি ওয়াশিংটন ডিসির ন্যাশনাল মলে যুদ্ধবিরোধী এক প্রতিবাদ কর্মসূচিতে শিরস্ত্রাণপরিহিত ন্যাশনাল গার্ডসম্যানের বন্দুকের নলে গুঁজে দিচ্ছিলেন কারনেশন ফুল।
ঘটনাটি ১৯৬৭ সালের ২১ অক্টোবরের। প্রতিবাদ প্রকাশের এই জাদুবাস্তবধর্মী মুহূর্তকে ক্যামেরাবন্দি করেছেন আমেরিকান আলোকচিত্রী বার্নি বোস্টন [১৯৩৩-২০০৮]। প্রতিবাদ বা বিক্ষোভে ধ্বংসাত্মক কিছু না করে বরং ফুল দেওয়ার এমন কালজয়ী আইডিয়া প্রথমবার ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বিটনিক সাহিত্যিক অ্যালেন গিন্সবার্গ [১৯২৬-১৯৯৭]। ১৯৬৫ সালে ‘হাউ টু মেক আ মার্চ/স্পেকটেকল’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, উৎপীড়কদের হাতে ফুল তুলে দেওয়া হতে পারে শান্তিবাদী আন্দোলনের একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রতীক। এর নমুনা বিশেষত তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে কালে কালে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশেও এমন উদাহরণ দেখেছি আমরা। আর এ ধরনের প্রতিবাদের আলোকচিত্রীয় নজির হিসেবে বার্নির তোলা ছবিটি বহুল আলোচিত; যার শিরোনাম ‘ফ্লাওয়ার পাওয়ার’। ছবিটি ১৯৬৭ সালে পুলিৎসার পদকে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে।
২০০৫ সালে ‘কুরিয়ো’ ম্যাগাজিনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে, ছবিটি তোলার মুহূর্তের স্মৃতিচারণায় বার্নি বলেন, ‘তখন দুপুরের প্রথম ভাগ। লিংকন মেমোরিয়াল থেকে পদযাত্রা করে এগিয়ে আসছিল তারা।’ এই ‘তারা’ মানে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভকারী। ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে প্যান্টাগন যাদের লক্ষ্যস্থল। এ ছিল যুদ্ধরাষ্ট্রের ইতিহাসে কোনো যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভে সবচেয়ে বেশি মানুষের সমাহার। সংখ্যায় আড়াই লাখের বেশি। সব বয়সী, সব বর্ণের। সবাই জড়ো হয়েছিলেন ওয়াশিংটন ডিসিতে। বার্নি তার ক্যামেরা নিয়ে ছিলেন প্রস্তুত। তিনি তখন ‘ওয়াশিংটন স্টার’ (অধুনালুপ্ত) পত্রিকার চিত্রসাংবাদিক। নিজ কার্যালয়ে সম্পাদককে টেলিফোন করে জেনে নিয়েছিলেন করণীয়। সম্পাদক যদিও নির্দেশনা দিয়েছিলেন বিক্ষোভকারীদের অনুসরণ করার; কিন্তু নিজের গাড়ির কাছে ফিরে আসতে হয়েছিল তাকে। কেননা, গাড়িটির তিনটি চাকার টায়ার ফেটে গিয়েছিল, আর উইন্ডশিল্ড ওয়াইপারসের নিচে কেউ আটকে দিয়েছিল এক তোড়া ফুল। সেখান থেকেই তিনি তুলে ফেলেছিলেন এই ঐতিহাসিক আলোকচিত্র।
‘বিক্ষোভকারীদের সমুদ্রটিকে যখন দেখতে পেলাম, জানতাম, কিছু একটা ঘটবেই,’ স্মৃতিচারণায় বলেছেন বার্নি। পেন্টাগনের পাশের মল এন্টারেন্সের একটি দেয়ালের সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি। জনতাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ডাকা হয়েছিল সেনাদল মিলিটারি ডিস্ট্রিক্ট অব ওয়াশিংটনকে। বিক্ষোভকারীরা যেন প্রবেশপথ মাড়াতে না পারেন, তার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েছিলেন সৈন্যরা। ‘মানুষের সেই সমুদ্রের দিকে পদযাত্রা করে এগিয়ে যেতে দেখলাম সেনাবাহিনীকে,’ বলেছেন বার্নি, ‘আর, এর জন্য প্রস্তুত ছিলাম আমি।’ একজন সৈনিক তার রাইফেল খোয়ালেন। আরেকজন খোয়ালেন হেলমেট। বাকিরা অস্ত্র তাক করে রেখেছিলেন বিক্ষুব্ধ জনতার দিকে। এরই মধ্যে হুট করে একজন তরুণ হিপি বাম হাতে এক তোড়া ফুল নিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন সৈন্য ও জনতার মাঝখানে। ডান হাত দিয়ে তিনি একটি একটি করে ফুল গুঁজে দিচ্ছিলেন সৈন্যদের বন্দুকের নলে। ‘যেন হাওয়া থেকে এসেছেন তিনি,’ বলেছেন বার্নি, ‘তার পরিচয় শনাক্ত করতে বহু বছর লেগে গেছে আমার।… নাম তার হ্যারিস।’ পুরো নাম জর্জ এজারলি হ্যারিস থ্রি [১৯৪৬-১৯৮২], যিনি পরবর্তীকালে হিবিস্কাস ছদ্মনামে অভিনেতা ও পারফরম্যান্স আর্টিস্ট হিসেবে অল্পবিস্তর খ্যাতি পেয়েছিলেন।
এই ছবি বার্নির ক্যারিয়ারে সিগনেচার ওয়ার্ক হয়ে উঠলেও শুরুতে দেখে খুব একটা পছন্দ করেননি তার পত্রিকার সম্পাদক। তাই ভেতরের পাতায় ছাপা হয়েছিল। এমনকি পুলিৎসারে নাম ওঠার আগে ছবিটি নিয়ে তেমন আলোচনাও হয়নি।
বার্নি ছবির তরুণটিকে নিউইয়র্কবাসী হ্যারিস বললেও তার মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর, ২০০৮ সালে নিউজ ওয়েবসাইট ‘হাফিংটন পোস্ট’-এ লেখা আর্টিক্যালে আমেরিকান লেখক পল ক্রেসনার [১৯৩২-২০১৯] দাবি তোলেন, ছবিটি ষাটের দশকে ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলিতে বসবাসকারী এবং যুদ্ধবিরোধী ও বাক্‌স্বাধীনতার প্রতিসাংস্কৃতিক বৈপ্লবিক গোষ্ঠী ‘ইয়ুথ ইন্টারন্যাশনাল পার্টি’ বা ‘দ্য ইপিস’-এর [অধুনালুপ্ত] নেতা জোয়েল টর্নাবেনের। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত আত্মজীবনী ‘কনফেশনস অব আ রেভিং, আনকনফাইন্ড নাট: মিসঅ্যাডভেঞ্চারস ইন দ্য কাউন্টারকালচার’-এ ক্রেসনার যাকে বর্ণনা করেছেন ‘সুপার-জুয়েল নামে খ্যাত একজন অঘোষিত ইপি সংগঠক’ হিসেবে। ‘মাফিয়া বস স্যাম জিয়ানকানা তার দাদা ছিলেন বটে; তবে পারিবারিক এই কর্মকাণ্ড থেকে সুপার-জোয়েল নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। এর বদলে, নিজের চুল বড় হতে দিয়েছিলেন এবং এলএসডি (মাদকবিশেষ) বিপণন করতেন। শিকাগো পুলিশ ডিপার্টমেন্টের গোয়েন্দা বিভাগ জিয়ানকানাকে সতর্ক করে দিয়েছিল, সুপার-জোয়েল যেন আমার সঙ্গে মেলামেশা না করে। ওই মাফিয়াকে পুলিশ বলে দিয়েছিল, আমার সঙ্গ নিলে ওর ওপর খারাপ প্রভাব পড়বে!’
তত দিনে হ্যারিস, জোয়েল ও বার্নি—এদের কেউই বেঁচে নেই বলে ছবিতে থাকা তরুণটির পরিচয় ঘিরে ওঠা এ বিতর্কের সুরাহা করা যায়নি। সে যা-ই হোক, ‘ফ্লাওয়ার পাওয়ার’ বার্নির তো বটেই, চিত্রসাংবাদিকতার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসেরও একটি ঋদ্ধ ও সূক্ষ্ম প্রতিবিম্ব। ‘বার্নি বোস্টন: আমেরিকান ফটোজার্নালিস্ট’ গ্রন্থের রচয়িতা থেরেস মালিগানের মতে, ষাটের দশক সম্পর্কে বহু মানুষের ভাবনার একটি সারাংশ হয়ে আছে এই ছবি। চিত্রসাংবাদিকতার নিরিখে, ‘যখন সবকিছু একসঙ্গে ধরা দেয়—এমন নিষ্পত্তিমূলক মুহূর্তের’ রেফারেন্স এটি।
‘ফ্লাওয়ার পাওয়ার’ শুধু আলোকচিত্রই নয়, একটি আন্দোলনেরও শিরোনামে রূপ নিয়েছিল। ষাটের দশকের শেষ ভাগ ও সত্তরের শুরুর ভাগে অহিংস প্রতিরোধের স্লোগানে পরিণত হয় এটি। শান্তিবাদী আন্দোলনে বিক্ষোভকারীরা শুধু ফুল নয়; খেলনা, পতাকা, ক্যান্ডি, সংগীত ইত্যাদিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন। ‘ফ্লাওয়ার পাওয়ার’ মুভমেন্টের সাংস্কৃতিক গুরুত্বও অসীম। তাতে বার্নির তোলা ছবিটি ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এখনো নানা আন্দোলন বা বিক্ষোভে বিশেষত তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিদের দেখা যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দিকে ফুল বাড়িয়ে দিতে।

দায় স্বীকার: কুরিয়ো ম্যাগাজিন, ডিজাইন অবজারভার ডট কম, হাফিংটন পোস্ট, লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস
 লাইফস্টাইল ডেস্ক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top