যাপনচিত্র I ফিটনেস যখন লাইফস্টাইল
বাংলাদেশে বিশেষত ঢাকায় ফিটনেস ইন্ডাস্ট্রির উত্থানে যাদের ভূমিকা রয়েছে, রুসলান হোসেইন তাদের অন্যতম। শীর্ষস্থানীয় জিম রুসলান’স স্টুডিওর স্বত্বাধিকারী। উঁকি দেওয়া যাক তার একান্ত জীবনে
শুধু শুক্রবারে একটু অবসর পান তিনি। সেদিন সকালে করপোরেট উইকেন্ড ক্রিকেট খেলায় মেতে ওঠেন। আগের রাতে অনেকটা সময় জেগে থাকা সত্ত্বেও এমন দিনে সকাল ৬-৭টায় বিছানা ছাড়েন। ব্রেকফাস্ট সারেন রাস্তায়। পরে খাওয়ার জন্য সঙ্গে কিছু খাবার রাখেন। অবসরে নিজেকে গ্রুম করেন। তবে ছুটির দিনে সবকিছুর আগে পরিবার। এ দিন নিজের স্ত্রীর সঙ্গে কোথাও ডিনার করতে কিংবা স্ত্রীকে নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে ভালোবাসেন।
রুসলানের বাসার আসবাব থেকে শুরু করে সবকিছুতে সাদা ও কালো রঙের আধিক্য। রয়েছে পোষা বিড়াল। প্রথমে একটি পার্শিয়ান ক্যাট দিয়ে বিড়াল পোষার শখ পূরণ করেছেন। এরপর বাসায় আনেন দুটি দেশি বিড়াল। সেখান থেকে সেগুলোর তিনটি বাচ্চাসহ মোট ছয় বিড়ালের বাস তার বাসায়—ফোনিয়া, ডিংকি, ক্যাসপার, স্নুপি, তাতাম ও হ্যালমেট। রুসলান বিশ্বাস করেন, চারপাশের নেতিবাচক শক্তিকে দূরীকরণে বিড়াল ভূমিকা রাখে। শুধু তা-ই নয়, তার বাসায় আছে দুটি পোষা কুকুর—ডলার ও রাস্টি। পোষা প্রাণীর সঙ্গ তার ভালো লাগে।
রুসলানের কর্মঘণ্টা অনেকের চেয়ে ভিন্ন। কর্মস্থলে থাকেন সপ্তাহে ৬ দিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। জিমের অবস্থান বনানী ও ধানমন্ডিতে হওয়ায় অলটারনেট দিন করে দুই জায়গাতেই থাকেন। ফিটনেস আইকন বলে তার খাদ্যাভ্যাস ঘিরে কৌতূহল রয়েছে কারও কারও। রুসলান প্রতিদিন পাঁচবার খাবার খান। সকালের নাশতা ১০-১১টায়; তালিকায় থাকে ১০-১২টি ডিমের সাদা অংশ, চিজ, বাটার আর ওটস। মধ্যাহ্নভোজ ২-৩টায়; মেনুতে রাইস ও চিকেন। এরপর নিজের ওয়ার্কআউট সম্পন্ন করেন। শারীরিক কসরত শেষে প্রোটিন শেক নেওয়া চাই তার; মাঝেমধ্যে সঙ্গে থাকে স্ন্যাকস ও ফ্রুটস। এর খানিক বাদে আবারও রাইস ও চিকেন আহার করেন। দিনের শেষ খাবার অর্থাৎ ডিনারে থাকে ভাত বা আলু এবং মুরগির মাংস। চিট ডে বাদে অন্য দিনগুলোতে গরুর মাংস এড়িয়ে চলেন। খাদ্যতালিকায় রাখেন পর্যাপ্ত শাকসবজি আর মাছ। স্বাস্থ্য বিবেচনায় তার রান্নার ধরন কিছুটা ভিন্ন। সল্ট ও পেপার দিয়ে সেদ্ধ করে খেতে পছন্দ করেন; ঝাল ও তেল এড়িয়ে চলেন পুরোপুরি। খাবারে কার্বোহাইড্রেটের সঙ্গে উচ্চ প্রোটিন ও লো ফ্যাটের ভারসাম্য রাখেন।
ক্রিকেট খেলার কারণে রুসলানের কার্ডিও এক্সারসাইজ অনেকটুকু আপনাআপনি পূরণ হয়ে যায়। এর পাশাপাশি বেসিক হাঁটাহাঁটি করেন ২০-৩০ মিনিট। তিনি মনে করিয়ে দেন, আমাদের জন্য প্রতিদিন ১০ হাজার স্টেপ হাঁটা গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া রুসলান প্রতিটি বডি পার্ট ২ দিন করে ৬ দিনে সম্পন্ন করেন। জানালেন, ফিটনেস তার কাছে লাইফস্টাইল। প্রতিযোগিতামূলক সময়ে স্বাস্থ্যের পাশাপাশি লুক, অর্থাৎ একজন মানুষ নিজেকে কীভাবে উপস্থাপন করেন, তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দেহভাষা, আত্মবিশ্বাস অনেকটাই বাড়তি সুবিধা দেয় বলে অভিমত তার। পাশাপাশি, নিজের চিন্তাভাবনার প্রতি স্বচ্ছ থাকা বাড়তি খোরাক জোগায়। রুসলান বলেন, ব্যায়ামের সঙ্গে সঙ্গে যেকোনো ধরনের ক্রিয়াকলাপ, খেলাধুলা স্বাস্থ্যগত দিকের পাশাপাশি মানসিক নানা সুবিধা দেয়। স্ট্রেস রিলিভার হরমোন, ফিল গুড হরমোন নিঃসরণ করে বলে বিষণ্নতা ও দুশ্চিন্তা দূর হয়।
ভ্রমণ সম্পর্কে জানালেন, সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রিতে সময় বের করা কষ্টসাধ্য। কমফোর্ট জোন ও কাজের বাইরে গিয়ে বছরে দু-একবার বিদেশে ঢুঁ মারেন। তবে বিভিন্ন বডি বিল্ডিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন বেশ কয়েকবার। এভাবে ভ্রমণ করতে পারলে তাতে কাজ ও পরিবারকে সময় দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখাও হয়ে যায়। ভারত, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, সৌদি আরব, চীন ও তুরস্কে ভ্রমণ করেছেন এ পর্যন্ত। থাইল্যান্ড সবচেয়ে প্রিয় হওয়ার কারণ—স্বল্প যাত্রা সময়, পছন্দসই স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ও সাপ্লিমেন্টের সহজলভ্যতা, জিম কালচার, শপিংয়ের নানা বৈচিত্র্য। যুক্তরাষ্ট্র আর ফিলিপাইনও বিশেষ ভালো লেগেছে।
রুসলান বেশ সংগীতানুরাগী। একসময় নিবিড়ভাবে সংগীতচর্চাও করতেন। মন-মর্জির ওপর নির্ভর করে হেভি মেটাল, পপ, রক, ইলেকট্রনিক, টেকনো, টেকহাউসসহ নানা ধরনের সংগীত শুনতে পছন্দ করেন। দেশে ক্রিপটিক ফেইট, অর্থহীন, মাইলস ও অর্ণবের মিউজিক বেশ ভালো লাগে; তবে সবচেয়ে বেশি পছন্দ ওয়ারফেজ ও আর্টসেল। দেশের বাইরে ড্রিম থিয়েটার, মেটালিকা, আয়রন মেইডেন, ডিও, আরমিন ভ্যান বুরেন ও টিয়েস্টো। সময় পেলে বাসায় টিভি সিরিজ ও সিনেমা দেখতে পছদ করেন। থ্রিলার, ক্রাইম ও অ্যাকশন পছন্দের জনরা। পছন্দের টিভি সিরিজ হাউস অব ড্রাগন; সিনেমা টার্মিনেটর টু। রোল মডেল হিসেবে আর্নল্ড শোয়ার্জেনেগারকে সামনে রাখেন। পছন্দের অভিনেতা অ্যান্থনি হপকিন্স। সেলিব্রিটি ক্রাশ প্রসঙ্গে মজার ছলেই বললেন, ‘এটা তো সময়ের সঙ্গে বদলাতে থাকে। তবে পছন্দের তালিকায় আছেন জেসিকা আলবা, অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, মেগান ফক্স।’
ফুটবলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ডাই হার্ড ফ্যান তিনি। ডেভিড বেকহামের দারুণ ভক্ত। ইতালিয়ান তারকা রবার্তো ব্যাজিও এবং ইতালি ফুটবল দলেরও ফ্যান। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ অনুসরণ করেন বলে ইংল্যান্ডের প্রতি সমর্থন রয়েছে। অন্যদিকে, ক্রিকেটের ভক্ত হয়েছেন শচীন টেন্ডুলকারের ব্যাটিং ক্যারিশমার জন্য।
অ্যাকসেসরিজ, জুতা, পারফিউমের ক্ষেত্রে খানিকটা ব্র্যান্ড ফোকাসড রুসলান। জর্ডান স্নিকারস, প্রোজেক্ট রকের স্পোর্টসওয়্যার, হাবলেট ওয়াচ ও অ্যারাবিয়ান উড পারফিউম আছে পছন্দের তালিকায়। এই ফিটনেস আইকনের ফ্যাশন সিলেকশনের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে তার জীবনসঙ্গিনীর পছন্দ। তবে তিনি সিমপ্লিসিটি পছন্দ করেন; এমন কিছু যা পরে স্বচ্ছন্দবোধ হয়। অফ শোল্ডার টি-শার্ট, সোয়েট প্যান্ট, স্নিকার তার পছন্দের পরিধেয়। পছন্দের রং কালো ও নীল।
ছোটবেলায় টার্মিনেটর ও ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন বুনতেন রুসলান। ২০০৯ থেকে মহাখালী ডিওএইচএসে ছোট পরিসরে তার গড়ে তোলা রুসলান’স স্টুডিও আজ দেশের জিম ও ফিটনেস ইন্ডাস্ট্রিতে শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড। জানালেন, কখনো এটিকে জিম হিসেবে ভাবেননি। একজন ভাস্কর যেমন শিল্প প্রয়োগ করে ভাস্কর্য বানান, জিমের ব্যাপারটিও তেমন। এখানে একজন মানুষের শরীর ও মনকে শৈল্পিক পন্থায় পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাওয়ার তাড়না ছিল। প্রথমে মাত্র একজন সহকারীকে নিয়ে নিজেই শুরু করেছিলেন। রুসলান’স স্টুডিওতে এখন রয়েছেন ৩০ জন ট্রেইনার, যাদের বেশির ভাগই তার অধীনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। সকলের জন্য ওয়ার্কআউট প্ল্যান ও ডায়েট প্ল্যান রুসলান নিজের হাতেই সামলান।
জীবনদর্শন বলতে তিনি বোঝেন আত্ম-উন্নয়ন। তার মতে, নিয়মিত নিজ উন্নয়নের নিমিত্তে কাজ করা আবশ্যক। পরিবার, সমাজ, ব্যবসা, মনস্তত্ত্ব—সবকিছু নিয়ে আগের চেয়ে ভালো কাজ করার অভিপ্রায় থাকা উচিত। ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল যেমন সাগর পাহাড় গড়ে তোলে, তেমনি আত্ম-উন্নয়নে যেকোনো ছোট উদ্যোগ বড় সাফল্যের প্রাথমিক ধাপ বলে অভিমত এই ফিটনেস কোচের।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন