ফিচার I অন্দরের অবয়বে
যেকোনো উৎসব-পার্বণে শুধু নিজেরা পরিপাটি থাকলেই তো চলে না। নিজেদের সাজপোশাকের সঙ্গে যদি ঘরের সজ্জাতেও নান্দনিকতা আনা যায়, তবেই উৎসব হয়ে উঠবে আরও রঙিন ও উপভোগ্য
দুর্গাপূজা হলো শক্তির অধিষ্ঠাত্রী পার্বতীদেবীর দুর্গা রূপের উপাসনার উৎসব। পূজার আয়োজন শুধু মন্দিরে নয়, বাঙালি হিন্দুদের অনেকের ঘরেও অনুষ্ঠিত হয়। তাই ঘর সাজানো গুরুত্বপূর্ণ। যদি ঘরে পূজা না-ও হয়, তবু উৎসব উপলক্ষে অন্দরের অবয়বে বদল আনা গেলে মন্দ কি! তা ছাড়া দুর্গোৎসবে দল বেঁধে মণ্ডপে মণ্ডপে বিচরণের পাশাপাশি আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধব বাড়িতে বেড়াতে আসতেই পারেন। নতুনত্ব ও নান্দনিকতা আনতে পারলে চেনা অন্দরমহলকে নতুন লাগবে।
পূজার পরিবেশের সঙ্গে মানানসই সজ্জা ঘরের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তোলার পাশাপাশি একটি প্রশান্তিময় আবহ তৈরি করে। নান্দনিক রূপ দিতে গৃহসজ্জায় নতুন কিছু সংযোজন করতে পারেন; যা চারপাশকে উৎসবমুখর ও সুশোভিত করে তুলবে।
ঘরের গভীরে
মাটির প্রদীপ: মাটির প্রদীপ সব সময় ঐতিহ্যবাহী। পূজায় ঘর সজ্জায় এমন প্রদীপ থাকবে না, তা ভাবা যায় না! বিভিন্ন আকৃতি ও নকশার প্রদীপ ব্যবহার করে মেঝে, জানালা ও পূজার স্থানে সাজিয়ে রাখুন। সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালিয়ে নিলেই ঘরে কোমল আলোর সঙ্গে পবিত্র ভাব ছড়িয়ে পড়বে।
মোমবাতি ও ফেইরি লাইট: মোমবাতি বা ফেইরি লাইট দিয়ে ঘরের কোণে এবং জানালায় হালকা আলোর ছোঁয়া দিতে পারেন। এটি অন্দরের সৌন্দর্য বাড়ানোর পাশাপাশি পরিবেশে উজ্জ্বলতা ও উষ্ণতা এনে দেবে।
টাটকা ফুল: ঘরের কোণ বা টেবিলের ফুলদানিতে সতেজ ফুল রাখতে পারেন। বিশেষ করে শিউলি, গাঁদা, বেলি, গোলাপ ইত্যাদি পুষ্প বয়ে আনবে স্নিগ্ধতা ও সৌন্দর্যের বার্তা।
ফুলের মালা: দরজা, জানালা বা পূজার স্থানে ফুলের মালা ঝুলিয়ে রাখতে পারেন। ফুলের ঘ্রাণ ও রং ঘরে একটি মনোরম অনুভূতি ছড়িয়ে দেবে।
ধূপকাঠি বা সুগন্ধি: ধূপকাঠি, সুগন্ধি মোমবাতি বা ইনসেন্স বার্নার ব্যবহারে ঘরে শান্তিপূর্ণ ও পবিত্র আবহ তৈরি হবে। ধূপকাঠির গন্ধ পূজার পরিবেশকে করে তুলবে আরও মোহনীয়।
বৃক্ষরাজি ও প্রাকৃতিক উপকরণ: ঘরের কোনায় ছোট ছোট ইনডোর প্ল্যান্ট রাখলে পরিবেশে সতেজতা ও প্রকৃতির ছোঁয়া আসবে। তাই পূজা উপলক্ষে নতুন ইনডোর প্ল্যান্ট কিনতেই পারেন। গাছের পাতা, বীজ বা বাঁশের শলা দিয়েও সাজাতে পারেন পূজার স্থান।
পবিত্র প্রতীক ও শঙ্খের ব্যবহার: ঘরের দেয়ালে ও পূজার স্থানে ধর্মীয় প্রতীক যেমন স্বস্তিকা, ওম, দেবদেবীর ছবি কিনে সাজাতে পারেন। এ ধরনের প্রতীক বা ছবি অন্দরমহলে আধ্যাত্মিকতা ও পবিত্রতার অনুভূতি বয়ে আনবে। দেয়ালে কিংবা পূজার স্থানে মাটি বা কাঠের হস্তশিল্প ডিসপ্লে করতে পারেন, যা নান্দনিকতার একটি চমৎকার সংযোজন হয়ে ধরা দেবে। এ ছাড়া শঙ্খ বাজিয়ে ঘরের আবহমণ্ডলে আধ্যাত্মিকতার আবহ বাড়ানো এবং পূজার পরিবেশকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলা সম্ভব।
আলপনার অবর্তমানে
বাংলার ঐতিহ্যবাহী আলপনা দিয়ে পূজার স্থান বা গৃহপ্রবেশের পথে নকশা তৈরি করতে পারেন। সাদা কিংবা রঙিন আলপনা মাটিতে বা দেয়ালে আঁকলে পরিবেশে শুদ্ধতা ও নান্দনিকতা যোগ হবে। তবে শহুরে জীবনে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ইচ্ছা থাকলেও অনেক সময় ঘরে আলপনা করা সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে ঘর সাজাতে আলপনার বিকল্প হিসেবে বেশ কিছু সৃজনশীল পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে, যা একইভাবে পূজার পরিবেশে শুদ্ধতা ও সৌন্দর্য এনে দেবে।
রঙিন রঙ্গোলি পাউডার কিংবা ফুলের পাপড়ি: আলপনার পরিবর্তে রঙিন রঙ্গোলি পাউডার ব্যবহার করা যেতে পারে। এগুলো সহজলভ্য তো বটেই; সুন্দর নকশা তৈরির উপযোগীও। এ ছাড়া ফুলের পাপড়ি দিয়ে মাটিতে নকশা আঁকতে পারেন, যা দেখতে আলপনার মতোই সুন্দর এবং আরও বেশি প্রাকৃতিক মনে হবে।
ফ্লোর স্টিকার বা ভিনাইল রঙিন নকশা: আধুনিক ঘর সাজানোর জন্য বাজারে মেলে ফ্লোর স্টিকার বা ভিনাইল রঙিন নকশা, যা মেঝেতে আলপনার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়। দ্রুত ইনস্টল করা এবং প্রয়োজনে সরিয়ে ফেলা সম্ভব। তাই সময় বাঁচাতে চাইলে এগুলো হতে পারে দারুণ বিকল্প।
ফ্লোর ম্যাট বা আসন: রঙিন কিংবা নকশাকৃত ফ্লোর ম্যাট বা আসন ব্যবহার করতে পারেন। এগুলো আলপনার মতোই মেঝেতে নকশা ও রঙের আভা এনে দেবে। পুনর্ব্যবহারযোগ্য হওয়ায় পরিবেশবান্ধবও।
ফুলের মালায় নকশা: মেঝেতে ফুলের মালা দিয়ে বিভিন্ন নকশা তৈরি করতে পারেন। দেখতে যেমন সুন্দর, পবিত্রতাও প্রকাশ করে। বিশেষ করে পূজার সময় গাঁদা কিংবা শিউলি ফুলের মালা এ কাজে বেশি ব্যবহৃত হয়।
কাগজ বা কাপড়ের নকশা: রঙিন কাগজ বা কাপড় কেটে তার ওপর নকশা তৈরি করে মেঝেতে রাখলে তা আলপনার চমৎকার বিকল্প হতে পারে। সহজে তৈরি করা যায়। প্রয়োজনে পুনর্ব্যবহারও সম্ভব।
কলাপাতা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক উপকরণ: আলপনার পরিবর্তে কলাপাতা কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক উপকরণ যেমন কচি বাঁশের শলা অথবা মাটির প্রদীপ ব্যবহারের মাধ্যমে নকশা তৈরি করা যেতে পারে। এতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বজায় থাকবে; সঙ্গে এটি পরিবেশবান্ধবও।
কুসি-কাঁটা ও হস্তশিল্পে
এ সময়ে বিভিন্ন হস্তশিল্প কিংবা কুসি-কাঁটা পণ্য দিয়ে সাজাতে পারেন ঘর। কুসি-কাঁটা হলো বাংলার একটি প্রাচীন হস্তশিল্প, যা সুতার কাজ ও সুন্দর নকশার মাধ্যমে কাপড়ে শিল্পকর্ম গড়ে তোলে। কুসি-কাঁটা পণ্য বাংলার সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। পূজায় ঘরের পরিবেশে পবিত্রতা ও শিল্পের মিশেল আনতে এ ধরনের পণ্যের ব্যবহার ঐতিহ্যবাহী অবয়ব ছড়িয়ে দিতে বেশ সহায়ক হতে পারে।
আসন বা রাগ: ঘরের মেঝেতে বা পূজার স্থানে রাখার জন্য কুসি-কাঁটা রাগ বা আসন নতুনত্ব এনে দিতে সক্ষম। এর সূক্ষ্ম নকশা ও উজ্জ্বল রং পূজার পরিবেশকে আরও সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলবে।
ওয়াল হ্যাংগিং: দেয়ালে কুসি-কাঁটা ওয়াল হ্যাংগিং ঝুলিয়ে গৃহসজ্জায় একটি ঐতিহ্যবাহী স্পর্শ আনা সম্ভব। দেবদেবীর ছবি কিংবা ধর্মীয় বিভিন্ন মোটিফ ব্যবহার করে তৈরি এসব পণ্য ঘরের সাজে বিশেষ আবহ তৈরি করবে।
বালিশ কভার: পূজার সময় অতিথি কিংবা নিজেদের জন্য ঘরের সোফা বা খাটের ওপর কুসি-কাঁটার বালিশ কভার ব্যবহার করতে পারেন। এর রঙিন নকশা আপনার ঘরের চেহারায় এনে দেবে নতুনত্ব।
পর্দা: সূক্ষ্ম নকশা করা কুসি-কাঁটার পর্দা ঘরে বাঙালির সংস্কৃতির সংযোগ তৈরি করবে।
টেবিল ক্লথ বা রানার: পূজার সময় খাবার বা প্রসাদ পরিবেশনের টেবিলে কুসি-কাঁটার টেবিল ক্লথ বা রানার ব্যবহার করে দিতে পারেন রুচিশীলতার পরিচয়।
ট্রে ম্যাট: প্রসাদ বা উপহার রাখার সময় পূজার থালায় কুসি-কাঁটা কভার ব্যবহার করলে দেখতে যেমন সুন্দর লাগবে, ব্যবহারও সুবিধাজনক।
পর্দার স্পর্ধা
পূজায় ঘর সাজানোর ক্ষেত্রে পর্দা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে; যা ঘরের সৌন্দর্য ও নান্দনিকতা বাড়িয়ে উৎসবের আমেজ ও আভিজাত্য ফুটিয়ে তুলবে।
সিল্ক বা কটনের পর্দা: পূজার গৃহসাজে সিল্ক বা কটন কাপড়ের পর্দা বেশ মানানসই। সিল্কের ঝলমলে রং এবং কটনের হালকা টেক্সচার ঘরে উজ্জ্বলতা ও প্রশান্তি যোগ করবে। বিশেষ করে লাল, হলুদ, সোনালি কিংবা সাদা রঙের সিল্ক বা কটনের পর্দা পূজার পরিবেশকে আরও স্নিগ্ধ ও উৎসবমুখর করে তোলে।
রঙিন ও নকশাকৃত পর্দা: রঙিন এবং ধর্মীয় মোটিফ বা ঐতিহ্যবাহী নকশা করা পর্দা ব্যবহার করে ঘর সাজাতে পারেন। মন্দির বা পূজার মণ্ডপের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রঙিন পর্দা বেছে নিন, যেমন লাল, কমলা বা গাঢ় সবুজ। এতে গৃহে একটি ঐতিহ্যবাহী ও উৎসবের আবহ যুক্ত হবে।
ফুলের মালা: পর্দার ওপরে কিংবা পাশে ফুলের মালা ঝুলিয়ে দিতে পারেন। বিশেষ করে গাঁদা, বেলি কিংবা শিউলি ফুলের মালা ব্যবহার করে পর্দাকে আরও উৎসবমুখর করে তোলা যায়। ফুলের সৌন্দর্য ও ঘ্রাণ ঘরের পরিবেশে পবিত্রতার আবহ ছড়িয়ে দেবে।
মাটির প্রদীপ ও লাইট: পর্দার পাশে ছোট ছোট মাটির প্রদীপ কিংবা ফেইরি লাইট জুড়ে দিতে পারেন। সন্ধ্যায় লাইটগুলো জ্বালালে পর্দার নকশা ও রং আরও ঝলমলে দেখাবে এবং পূজার পরিবেশে উজ্জ্বলতা এনে দেবে।
গামছা বা ঢাকাই জামদানি নকশার পর্দা: এ সময়ে বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই জামদানি বা বাঙালি গামছার নকশাকৃত পর্দা ব্যবহার করা যেতে পারে। এগুলো ঘরে ঐতিহ্যের ছোঁয়া আনার পাশাপাশি সবার দৃষ্টি আকর্ষণে ভূমিকা রাখবে।
স্বচ্ছ ও হালকা পর্দা: অন্দরমহলে স্বচ্ছ ও হালকা পর্দা ব্যবহার করতে চাইলে সাদা কিংবা হালকা রঙের নেট বা শিফনের পর্দা হতে পারে দারুণ বাছাই। এগুলো ভেদ করে ঘরে প্রাকৃতিক আলো প্রবেশ যেমন সহজ হবে, তেমনি পরিবেশকে হালকা ও প্রশান্ত করে তুলবে।
খরচ কমাতে
উৎসবে গৃহসজ্জায় বাড়তি খরচ করতে না চাইলে পূজার আগেই পুরো ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার চেষ্টা করুন। সরিয়ে রাখুন অতিরিক্ত জিনিসপত্র। পরিষ্কার, গোছানো ঘর সব সময় নান্দনিক ও শান্তিময় দেখায়।
পর্দা পরিবর্তন না করতে চাইলে ঘরে থাকা পর্দাগুলোই ভালোভাবে পরিষ্কার ও ইস্ত্রি করে আবার টাঙিয়ে নিন। পর্দার সঙ্গে ফেইরি লাইট দিয়ে সাজিয়ে নিলেই ঘরে নতুনত্ব চোখে পড়বে।
পূজার আগে ঘরের আসবাবপত্র পুনর্বিন্যাস করে নতুনত্ব আনতে পারেন। বড় আসবাবগুলো ঘরের কোনায় রাখুন যেন ঘর খোলামেলা ও প্রশস্ত দেখায়। এতে পূজার সময় অতিথিদের জন্যও আরামদায়ক স্থান তৈরি হবে।
সুবর্ণা মেহ্জাবীন
ছবি: ইন্টারনেট