skip to Main Content

ফিচার I সাউইন সারাংশ

অনেকের মতে, হ্যালোইনের আদি উৎসব। দুয়ের মধ্যে মিল-অমিল উভয়ই রয়েছে। আরও রয়েছে গা ছমছমে উদ্ভাস

কেল্টিক (উচ্চারণভেদে সেল্টিক) ছিল একটি ইন্দো-ইউরোপীয় জাতিগোষ্ঠী। জাতি ও ভাষাগত অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বেশ কয়েকটি কৌমসমাজকে একত্রে ডাকা হতো এ নামে। লৌহযুগে (১২০০-৫৫০ খ্রিস্টপূর্ব) ও রোমান সাম্রাজ্যকালে (২৭ খ্রিস্টপূর্ব-১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ) ইউরোপে বসবাস ছিল এদের। ভাষা ছিল কেল্টিক। এ ভাষারই একটি শাখা গ্যালিক বা গ্যালীয়। মূলত আয়ারল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলের গেল্টাখট অঞ্চলে বসবাসকারীদের ভাষা। ইংরেজির পাশাপাশি, একটি সরকারি ভাষা হিসেবে আয়ারল্যান্ডে প্রচলিত। এ ভাষায় কথা বলেন প্রায় ৫ লাখ আইরিশ। দুনিয়াজুড়ে এই ভাষাভাষীর বর্তমান সংখ্যা ১০ লাখের অধিক। আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও আইল অব ম্যানের (যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি স্বায়ত্তশাসিত দ্বীপ ও অঞ্চল) যে জাতিভাষাগত জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা এটি, তার নাম গ্যালস। এদেরই এক জমকালো বার্ষিক উৎসব ‘সাউইন’। প্রাচীন আইরিশ ভাষায় এর অর্থ ‘গ্রীষ্মের সমাপ্তি’। ফসল ঘরে তোলা সমাপনীর উৎসব। ৩১ অক্টোবর সন্ধ্যায়, সূর্য ডুবে গেলে শুরু। একই সঙ্গে শীতের সূচনারও ইঙ্গিতবাহী। কেল্টিক বা গ্যালিক প্যাগানদের কাছে প্রাচীনকাল থেকেই এই উৎসব গুরুত্বপূর্ণ। এদিন তারা বহ্ন্যুৎসব করতেন তথা আগুন জ্বালাতেন, যা বর্তমানে হ্যালোইন উৎসবেও করা হয়। হ্যালোইনও শুরু হয় একই দিনে; অর্থাৎ ৩১ অক্টোবর। কারও কারও মতে, হ্যালোইন ও সাউইন অভিন্ন উৎসব। এমনকি, উনিশ শতক পর্যন্ত ইতিহাসবিদেরা গ্যালিক হ্যালোইনকে বোঝাতে সাউইন শব্দটি ব্যবহার করতেন। তবে এ দুটির মধ্যে দারুণ কিছু মিলের পাশাপাশি অমিলও রয়েছে।
হ্যালোইন ও সাউইন: মিল-অমিল
শুরুতেই নজর বোলানো যাক মিলের তালিকায়—
সময়
হ্যালোইন ও সাউইনের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল উৎসব শুরুর সময়কাল। আগেই যেমনটা বলেছি, দুটি উৎসবই শুরু হয় অক্টোবরের শেষ দিন, সূর্যাস্তকাল থেকে। আর তা গ্রীষ্মের প্রখরতা পেরিয়ে হিমেল শীতের আগমনী ক্ষণের ইঙ্গিতবাহী। দুই ঋতুর সন্ধিক্ষণে প্রকৃতিতে আসা পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
অতিপ্রাকৃতিকের স্বীকৃতি
দুটি উৎসবই অতিপ্রাকৃতিক বিষয়-আশয় এবং মৃত ও জীবিত সত্তার মধ্যকার আবরণ মিলিয়ে দেওয়ার সঙ্গে যুক্ত। সাউইনের ক্ষেত্রে বিশ্বাস করা হয়, আমাদের পৃথিবী আর আত্মার দুনিয়ার মধ্যকার সীমারেখাটি এ সময়ে একেবারেই পাতলা হয়ে গিয়ে, মৃত আত্মীয়স্বজন ও কাছের মানুষদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের সুযোগ এনে দেয় এই উৎসব। অন্যদিকে, পোশাক-পরিচ্ছদ ও সাজসজ্জায় হরমদই ভূত, প্রেত, ডাইনি ইত্যাদি ভুতুড়ে প্রতীক ধারণ করার মাধ্যমে উৎসবে অংশগ্রহণকারীরা ভীতিকর ও অতিপ্রাকৃতিক বিষয়াদিকে স্বীকৃতি দেন হ্যালোইনে।
ফসল ও ভোজোৎসব
কৃষিজাত চর্চার গভীরে এবং ভোজোৎসবের ভেতর উভয় উৎসবেরই শিকড় নিহিত। ঐতিহাসিকভাবেই সাউইনের সম্পৃক্ততা বছরের সর্বশেষ ফসল উত্তোলনের সঙ্গে, মানুষ যখন আসন্ন শীতকালের জন্য খাবার মজুত করে। অন্যদিকে, হ্যালোইনের ট্রিক-অর-ট্রিটিং এবং পার্টি রেওয়াজেরও কেন্দ্রস্থলে থাকে খাদ্য ও সামাজিক জমায়েত।
উৎসব দুটির মধ্যকার অমিলের তালিকায় নজর দিলে দেখা যায়—
উৎপত্তি ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট
সাউইন একটি কেল্টিক উৎসব, যার শিকড় প্রাচীন প্যাগানে প্রোথিত। এটি উদ্‌যাপন করে কেল্টিক জনগোষ্ঠী, যারা বর্তমানে আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের কিছু অঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছে। এটি ফসলি মৌসুমের সমাপ্তিকে চিহ্নিত করে এবং প্রকৃতি ও ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। অন্যদিকে, হ্যালোইনের উদ্ভব ঘটেছে খ্রিস্টান সম্প্রদায় থেকে। প্রাথমিকভাবে এই উৎসবকে ডাকা হতো ‘অল হ্যালোস ইভ’। পরবর্তীকালে কেল্টিক ও অন্যান্য ঐতিহ্যের উপাদানগুলোর সঙ্গে মিলেমিশে উৎসবটি পেয়েছে একধরনের সর্বজনীন রূপ।
ধর্মীয় গুরুত্ব
একটি প্যাগান হলিডে হিসেবে সাউইনের রয়েছে পারমার্থিক গুরুত্ব; যা জীবন, মৃত্যু ও পুনর্জন্মের চক্রকে ফোকাস করে। পূর্বপুরুষদের সম্মান জানানোর এবং আত্মিক পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের সময় হিসেবে বিবেচিত এটি। অন্যদিকে, হ্যালোইন হলো সন্ত ও মৃতদের স্মরণ করার খ্রিস্টীয় রেওয়াজ, যা দিনে দিনে পৃথিবীর নানা প্রান্তে একটি অধিকতর ধর্মনিরপেক্ষ ও বাণিজ্যিকীকৃত হলিডেতে পরিণত হয়েছে।
আধুনিক চর্চা ও বাণিজ্যিকীকরণ
অনেক দেশেই একটি ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিকীকরণ ছুটির দিনে রূপ নিয়েছে হ্যালোইন; যা ঘিরে পোশাক-আশাক, সাজসজ্জা ও ক্যান্ডির রমরমা ব্যবসা চলে। প্যারেড, পার্টি ও ট্রিক-অর-ট্রিটিংয়ের মাধ্যমে উদ্‌যাপন করা হয় একে। অন্যদিকে, সাউইন যেহেতু প্যাগান উৎসব, তাই এটি সাধারণত অধিকতর আধ্যাত্মিক ও আত্মদর্শী রীতিনীতিতে উদ্‌যাপিত হয়। তাতে যুক্ত হয় আচারনিষ্ঠতা, বহ্ন্যুৎসব; আর, অংশগ্রহণকারীদের মনোযোগ থাকে প্রকৃতি ও অতিপ্রাকৃতিকের সঙ্গে সংযোগ ঘটানোর।
সাউইনের শাখা-প্রশাখা
অধ্যাত্মবাদ ও রূপান্তরের এই উৎসবের সময়ে প্রাকৃতিকভাবে বৃক্ষরাজির পাতা সবুজ থেকে চমৎকার হলুদ ও লাল রঙে রূপ নেয়। বাতাস হয়ে পড়ে সতেজ শীতল। প্রকৃতির পালাবদলের এসব রহস্যকে আলিঙ্গন করে নেওয়ার প্রেরণা জোগাতেই মূলত এই প্রাচীন কেল্টিক উৎসবের সূত্রপাত।
সংযোগে সম্মান
সাউইনের শিকড় খুঁজতে চলে যেতে হবে প্রাচীন কেল্টিক ভূখণ্ডগুলোতে; যেগুলো প্রাথমিকভাবে ছিল আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসে। গ্রীষ্মের উজ্জ্বল দিবারাত্রিকে বিদায় জানিয়ে আসন্ন শীতের অন্ধকারাচ্ছন্নতাকে স্বাগত জানানোর এই উৎসব। এর মূলে মৃত পূর্বপুরুষদের প্রতি সম্মান নিবেদন। কেল্টদের বিশ্বাস, সাউইনের সময় মৃতরা জীবিতদের পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারে। আগুন জ্বালানোর মাধ্যমে সেই আত্মাগুলোকে পথ দেখানোর পাশাপাশি তুষ্ট করা এবং তাদের কাছ থেকে আশীর্বাদ পাওয়া নিশ্চিত করার এই আয়োজন। এতে অংশগ্রহণকারীরা হরদমই মোমবাতির আলোয় ঘেরা টেবিলে বসে মৃতদের স্মরণ করেন। তাদের বিশ্বাস, এ সময়ে মৃতদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের এবং তাদের কাছ থেকে গোপন জ্ঞান ও বার্তা গ্রহণের সম্ভাবনা প্রবল হয়।
পুকা প্রকাশ
পুকা হলো কেল্টিক লোককাহিনির একটি মনোমুগ্ধকর ও রহস্যময় চরিত্র। চাতুর্যপূর্ণ সত্তা হিসেবে একে গণ্য করা হয়। সাউইনের সময়ে এর উপস্থিতি কেল্টিক ঐতিহ্যে ভীষণ অর্থবহ। এটি অংশগ্রহণকারীদের মনে ঋতুর গুপ্তরহস্যমূলক ও রূপান্তরধর্মী বৈশিষ্ট্যের কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে জীবিত ও মৃতদের পৃথিবীর মধ্যকার সীমারেখা বিলীন হয়ে গিয়ে অচেনাকে শ্রদ্ধাচিত্ত ও রোমাঞ্চ—উভয় বোধেই ধারণ করতে পারেন অংশগ্রহণকারীরা। লোককাহিনিমতে, পুকা বিভিন্ন রূপে আবির্ভূত হতে পারে। এর রূপ ও আকার বদলে যেতে পারে হরদম। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটি জ্বলন্ত চোখের অধিকারী একটি মসৃণ ত্বকের কালো ঘোড়া হিসেবে চিত্রিত হয়।

কোনো কোনো কাহিনিতে পুকাকে বর্ণনা করা হয়েছে একটি বিরাট কালো পাখি, খরগোশসদৃশ জন্তু কিংবা ভুতুড়ে গবলিন বা অপদেবতা রূপেও। অনিষ্টকর স্বভাবের জন্য কুখ্যাতি রয়েছে পুকার, যে হরদমই মানুষের সঙ্গে নির্মম রসিকতা করে; তবে এটি একই সঙ্গে ভালো কিংবা মন্দ—দুই ধরনের ভাগ্যই বয়ে আনতে পারে। বলা হয়, জীবিত ও মৃতদের পৃথিবীর মধ্যকার দূরত্ব ঘুচে যাওয়ার কারণেই সাউইন উৎসব চলাকালে পুকা সক্রিয় ও প্রভাববিশিষ্ট থাকে। এ সময়ে লোকালয়জুড়ে ছুটে বেড়ায় এটি; বিবিধ দাঙ্গাহাঙ্গামা বাধায়। তবে এর মুখোমুখি যারা দাঁড়াতে পারে, তাদের জীবনে এটি অন্তর্দৃষ্টি ও সঠিক দিকনির্দেশনাও এনে দিতে সক্ষম। সাউইন চলাকালে পুকা লোককাহিনির সবচেয়ে বিখ্যাত দিকগুলোর একটি হলো ‘পুকা নাইট রাইড’। বলা হয়, এই উৎসব চলাকালে পুকার মুখোমুখি পড়ে গেলে বিশেষ সতর্ক থাকা চাই। এর পিঠে চড়ার লোভ সামলানো না গেলে মহা বিপদ! পুকা ওই অংশগ্রহণকারীকে নিয়ে যেতে পারে একটি বুনো, ত্রাসজনক ও অনির্দেশ্য ভ্রমণে, যেটি সাধারণত শেষ হয় যেখান থেকে ও যখন শুরু হয়েছিল, তার চেয়ে ভিন্ন সময় ও স্থানে। উৎসব চলাকালে পুকার দেখা পেলে খাবার ও পানীয় দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করার রেওয়াজ রয়েছে কেল্টিক ঐতিহ্যে। তাতে পুকার অনিষ্টকারী প্রবণতাগুলো থেকে রক্ষা পাবেন পরিবেশনকারী।
মুখোশে ছদ্মবেশে
সাউইন উৎসবে মুখোশ ও বিশেষ ধরনের পোশাক পরার রেওয়াজের নেপথ্যে রয়েছে এই বিশ্বাস—এমন পোশাক-পরিচ্ছদ ও সাজসজ্জার মাধ্যমে এ সময়ে একজন জীবিত মানুষের পক্ষে মৃতদের আত্মার সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়া সম্ভব; ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত মুখোমুখি হয়ে পড়া কিংবা অনিষ্টের শিকার হওয়া থেকে সুরক্ষা মিলবে। বলা বাহুল্য, হ্যালোইনেও এই চর্চার দেখা মেলে, যেখানে ভূত, প্রেত, ডাইনি ইত্যাদি থেকে শুরু করে হালের সুপারহিরো ও পছন্দের ফিকশন ক্যারেক্টারের মতো সাজার চল রয়েছে।
আপেলে আপ্যায়ন
বিশেষ ভোজোৎসবেরও সময় এটি। সুনির্দিষ্টভাবে, এই মৌসুমে আপেল বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। আপেল-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন রেসিপি উপভোগের ধুম পড়ে পায় সাউইনে।
কেল্টিক ঐতিহ্যে শিকড় প্রোথিত হলেও আধুনিক প্যাগান ও নিউপ্যাগান উদ্‌যাপনগুলোতে জায়গা করে নিয়েছে সাউইন। তাতে, আপনি প্যাগান হন বা না হন, প্রকৃতির সঙ্গে আত্মিক সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে, ঋতু পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণ উপভোগে, আঁধার সরিয়ে আলোকিত হতে, নিজের মৃত পূর্বপুরুষ তথা প্রকৃত শিকড় সন্ধানে এই উৎসব হয়ে উঠতে পারে আপনারও।

দায় স্বীকার: অস্ট্রাল অরাস ডট কম; সেলটিক ফিউশন অনলাইন
 লাইফস্টাইল ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top