পাতে পরিমিতি I ডিনার ডায়েট
রাতের আহারে পাতে রাখা চাই কেমন খাবার? রইল পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশির পরামর্শ
কোন বেলায় কেমন খাবার গ্রহণ করা প্রয়োজন, তা নির্ভর করে ব্যক্তিমানুষের বয়স ও কাজের ধরনের ওপর। সারা দিনের খাদ্যাভ্যাস যা-ই হোক না কেন, রাতের খাবার নিয়ে অনেকেই খুব বেশি ভাবতে নারাজ। কেউ কেউ ওজন বাড়ার ভয়ে ডিনার এড়িয়ে চলেন। কেউ আবার সারা দিনে খুব বেশি না খেলেও রাতের আহার সারেন জম্পেশ ভূরিভোজে। অথচ মনে রাখা চাই, সুস্থ থাকতে হলে প্রতি পর্বের খাদ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং তাতে ভারসাম্য থাকা জরুরি।
প্রাকৃতিকভাবেই রাতে আমাদের মেটাবলিক সিস্টেম স্লো হয়ে যায়। তাই—
রাতের খাবার হওয়া চাই সহজপাচ্য। অর্থাৎ অতিরিক্ত ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার এ সময়ের বদলে অন্য যেকোনো বেলায় পাতে রাখাই মঙ্গল। সে ক্ষেত্রে রাতে শাক এড়িয়ে যাওয়া ভালো।
সারা দিনের চেয়ে রাতে পানি গ্রহণের পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে ফেলা প্রয়োজন। বিশেষ করে ঘুমাতে যাওয়ার সময় এক থেকে দেড় গ্লাস পানি পানের অভ্যাস রয়েছে অনেকের। অথচ এতে ইউরিন তৈরি হয়ে ঘুম নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি ইউরিন জমে থাকার কারণে পরবর্তীকালে ব্লাডারে সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
অনেকে রাতে চা বা কফি পান করতে পছন্দ করেন। এমনতিও সারা দিনে ক্যাফেইন যথাসম্ভব কম গ্রহণই শ্রেয়; আর রাতে তো অবশ্যই পরিহার করা উচিত।
সারা দিনের সব ঘাটতি রাতের আহারে একবারে পূরণ করতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত মারাত্মক ভুল। ডিনারের মেনু হওয়া চাই প্রয়োজন অনুযায়ী; যেমন একজন ডায়াবেটিস রোগীর মেনু কখনোই ওয়েট লস ডায়েটে থাকা ব্যক্তির সঙ্গে মিলবে না। আবার যারা গৃহিণী, তাদের সঙ্গে কর্মজীবী নারীর মেনুর মধ্যে ভিন্নতা থাকা বাঞ্ছনীয়। তবে বাড়িতে থাকা প্রত্যেক সদস্যের চাহিদা ভিন্ন হলেও অনেক সময় আলাদা খাবার তৈরি করা মুশকিল। সে ক্ষেত্রে কুকিং প্রসেস ঠিক রেখে একই আইটেম রাখতে পারলে সুবিধা। কী ধরনের খাবার প্রস্তুত করা যেতে পারে, সেই ভাবনার অবসান ঘটাতে ডিনারে রাখতে পারেন এ সব মেনু—
ওটস খিচুড়ি রেসিপি
অনেকে রাতে সবজি কম খান কিংবা বাদ দেন। আবার অনেক সময় প্রোটিন বাদ দিয়ে শুধু ভাত-সবজি গ্রহণ করেন। সে ক্ষেত্রে ওটস খিচুড়ি রেসিপি একটি সেরা বাছাই হতে পারে। এটি ডায়াবেটিস রোগী তো বটেই, এমনকি যারা ওজন কমানোর ডায়েটে আছেন, তারাও অনুসরণ করতে পারেন। আর এটি ঝটপট তৈরি করতে পারা যায় বলে বাড়তি কাজেরও তেমন ঝামেলা নেই। ওটস নিতে হবে পরিমাণমতো। তাতে কালারফুল ক্যাপসিকাম আর টমেটোসহ অন্যান্য সবজি মিক্স করে সামান্য চিকেন জুড়ে দিলে দেখতেও দারুণ হবে, পুষ্টিগুণেও ভরপুর। এতে কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট, জিংক, প্রোটিন, ফাইবার মিলবে সহজে।
এগ-ভেজিটেবল কুইনোয়া
নিউট্রেশনে ভরপুর কুইনোয়া অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, জিংক, প্রোটিন, ফোলেট আর ফাইবারসমৃদ্ধ। খাবার গ্রহণে সাধারণত বাচ্চাদের অনীহা বেশি। ভাতের থালা দেখলে তাই অনেক সময় দৌড়ে পালায় বাড়ির ছোটরা! তবে বিরিয়ানি বা ফ্রাইড রাইস শুনলেই তাদের জিভে আসে জল, আর অতিরিক্ত ক্যালরির কথা ভেবে মায়েরা বন্ধ করতে চান এ ধরনের ডিনার। এর আছে দারুণ সমাধান! বাসায় যথাসম্ভব কম তেল ব্যবহার করে ঝটপট বানিয়ে নেওয়া যেতে পারে এগ-ভেজিটেবল কুইনোয়া। যাদের প্লেটে ভেজিটেবল ভাবাই যায় না, কোনো রকম বাড়তি মসলার ব্যবহার ছাড়াই কেটে নেওয়া সবজিগুলোকে হালকা বয়েল শেষে কুইনোয়া মিক্স করে তৈরি করা যায় এই রেসিপি। এ ক্ষেত্রে ডিম ও এক চা-চামচ তেল ব্যবহার করে হালকা ফ্রাই করলেই ঝটপট ডিনার রেডি।
ডালিয়া
ভাত বাদ দিতে বললেই রুটি বা ওটস খাওয়ার কথা মাথায় আসে অনেকের। সে ক্ষেত্রে ডিনারে ভিন্নতা আনতে পাতে রাখা যেতে পারে ডালিয়া। ভিটামিন, মিনারেলস, প্রোটিন আর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ এ খাবার রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্সের কারণে এটি খাওয়ার পরে রক্তে দ্রুত সুগার বাড়ে না। ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে তো বটেই, যেকোনো ব্যক্তিই সপ্তাহে দু-এক দিন মেইন মিল হিসেবে ডালিয়া রাখতে পারেন ডিনারে। এটি চিকেন বা সবজি দিয়ে খেতে দারুণ সুস্বাদু।
রাতের মেনু যা-ই হোক, অনেকের রয়েছে রাত জাগার বদভ্যাস। কেউ কেউ বাধ্যও হন নানা কারণে। ডিনারের পরও দীর্ঘ সময় জেগে থাকার কারণে বিভিন্ন খাবারের প্রয়োজন শুরু হয়। তাতে ওজন বাড়তে থাকে, আর দেখা দেয় ডায়াবেটিসসহ নানা শারীরিক জটিলতা। রাত জাগলে যাদের কিছু না কিছু খেতে ইচ্ছা করে, তারা চকলেট বা মিষ্টি বাদ দিয়ে এমন সব বিকল্প খাবার রাখতে পারেন, যেন ক্ষুধায় কাজের মনোযোগ ব্যাহত না হয়; স্ট্যামিনাও ভালো থাকে। এমন সময়ে বেস্ট চয়েস হতে পারে এগুলো—
মিক্সড নাটস
ভিটামিন ই, এ, বি কমপ্লেক্স আর এনার্জেটিক স্ন্যাকস হিসেবে রাখা যেতে পারে বাদাম। ওজন কমাতে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে আর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে এর জুরি নেই। কাঠবাদাম, কাজুবাদাম, আখরোটসহ কিছু চিপস যেমন সানফ্লাওয়ার বা পামকিন সেট দিয়ে তৈরি করা যেতে পারে নেক্সট নাটস। তবে এ ক্ষেত্রে ভাজা চিনাবাদাম না রাখাই মঙ্গল।
প্রোবায়োটিক ড্রিংকস
রাত জাগলে অনেকের আইসক্রিম কিংবা মিষ্টিজাতীয় খাবার খাওয়ার ক্রেভিং শুরু হয়। সে ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক ড্রিংকগুলো বেশি হেলদি। টক দই দিয়ে তৈরি সুইট কিংবা সল্টি ইয়োগার্ট ড্রিংকস সুপারশপে সহজে মেলে। চাইলে নিজেই তৈরি করে নিতে পারেন বাসায়।
ইসবগুল-তোকমা মিক্সড ওয়াটার
রাত জাগলে অনেকের কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এ ধরনের ড্রিংকস বারবার ক্ষুধা লাগার সমস্যা দূর করার পাশাপাশি স্টুল সফট করতে উপকারী। এতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইবার ও প্রোটিন মেলে।
সেলারি
এতে রয়েছে ফাইটোকেমিক্যাল, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও পলিফেনল। এগুলো শরীর থেকে টক্সিক পদার্থ বের করতে সাহায্য করে। ধ্বংস করে দেয় ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিক্যাল। সেলারিতে অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি উপাদান থাকায় দেহকে ডিটক্সিফাই করতে কাজে দেয়। তাই বাড়তি ক্ষুধা নিরাময়ে রাতের খাদ্যতালিকায় সেলারির স্যুপ কিংবা স্যালাদ রাখা যেতে পারে। এ ছাড়া রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, লিভার ও হৃৎপিণ্ড ভালো রাখতে এটি খাদ্যতালিকায় রাখা মঙ্গল।
ফল
সুস্থ থাকতে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা যথেষ্ট থাকা চাই। ভালো খাবারগুলো খাদ্যতালিকায় না থাকলে নানা রোগ এমনিতেই শরীরে বাসা বাঁধে। ডিনারে কিংবা ডিনার-পরবর্তী বাড়তি ক্ষুধায় ফ্রুটস হতে পারে বেশ উপযোগী। প্রায় সব ফলেই রয়েছে ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, ফোলেট, পটাশিয়াম আর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। সে ক্ষেত্রে দুটি খেজুরও হতে পারে স্ন্যাকসের অলটারনেটিভ। তবে অনেকের রাতে ফল খেলে অ্যাসিডিটি কিংবা বদহজমের ঝুঁকি তৈরি হয়। তাদের অবশ্যই এ সময়ের খাদ্যতালিকা থেকে বিশেষত অতিরিক্ত টক বা লেমনজাতীয় ফল বাদ দেওয়া চাই।
চিয়া সিড ওয়াটার
ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ চিয়া সিড বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়। তবে এটি ঠিক কখন গ্রহণ করা প্রয়োজন, তা নিয়ে অনেকে দ্বিধায় ভোগেন। ব্যাড কোলেস্টেরল কমিয়ে হার্টের সুস্থতায় এটি কার্যকরী। এ ছাড়া কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণে এবং পেটের মেদ কমাতে এটি সকালে কিংবা রাতে গ্রহণ করা যেতে পারে। ডিনারে কম খাবার গ্রহণ করলে অনেকের মধ্যরাতে ক্ষুধার প্রবণতা থাকে। বেড টাইমে ইয়োগার্টের সঙ্গে চিয়া সিড গ্রহণে তা অনেকাংশে কমে যায়।
মোটকথা, সুস্থ থাকতে চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত কম কিংবা বেশি খাদ্য গ্রহণ করা অনুচিত। ডিনার সারা দিনের মিলের মধ্যে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। রাতের খাবার সন্ধ্যার পরপর গ্রহণ করতে পারলে মঙ্গল। সে ক্ষেত্রে বেড টাইমে হালকা নাশতা খেয়ে সারা দিনের গ্রহণ করা খাদ্যের মধ্যে ক্যালরির সামঞ্জস্য করা যেতে পারে। আর শারীরিক কোনো কো-মরবিডিটিস থাকলে ডিনার ডায়েট কেমন হওয়া চাই, তা বিশেষজ্ঞ পুষ্টিবিদের পরামর্শ মেনে নির্ধারণ করে নেওয়া জরুরি।
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট