ফিচার I বেসিক ব্ল্যাক
অক্টোবরের পয়লা দিনটা কফির। ইন্টারন্যাশনাল কফি অর্গানাইজেশন ২০১৪ সালে পানীয় হিসেবে কফির প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে এই দিনকে আন্তর্জাতিক কফি দিবস ঘোষণা করেছে। পরের বছর থেকেই এটা পালিত হয়ে আসছে কফির ফেয়ার ট্রেডের প্রচার আর কফি-চাষিদের দুর্দশার বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে
স্বাধীন বাংলাদেশে কফির চল ছিল খানিকটা অভিজাত গণ্ডির ভেতরেই। গত শতকের শেষ দশকে মূলত কফি-বিপ্লবের শুরু, অবশ্য সেটা কেবল ইনস্ট্যান্ট কফি। ঢাকায় যখন কফি বাজারজাত শুরু হয়েছিল, তখন এর চাহিদা ছিল অল্প। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ২০০৩ সালে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার কেজি কফি আমদানি করা হয়েছিল, যার ৬৭ শতাংশই ছিল নেসক্যাফের, অর্থাৎ ইনস্ট্যান্ট কফির। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রায় ৮ শতাংশ হলেও এই শতাব্দীর প্রথম দশকেও কফির বাজার তেমন বাড়েনি। তবে ঢাকা শহরে ইনস্ট্যান্ট কফির পাশাপাশি এসপ্রেসোভিত্তিক অর্থাৎ বিন-টু-কাপ কফির আগমন এ সময়েই। এই শতকের প্রথম দশকের মাঝামাঝি সময়ে কফি ওয়ার্ল্ড, বাস্কিন রবিন’সসহ কয়েকটি পাঁচ তারকা হোটেল এসপ্রেসোভিত্তিক কফি বিক্রি শুরু করে। সে সময়ে খুব বেশি জনপ্রিয় না হলেও পরের দশক থেকে মূলত কফির চাহিদা ও জনপ্রিয়তা—দুটোই আকাশচুম্বী হতে থাকে। ফলে বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠতে থাকে বিন-টু-কাপ কফি পরিবেশনের নতুন সব আউটলেট বা ক্যাফে। কফি ওয়ার্ল্ড, বারিস্তা লাভাজ্জা, নর্থ এন্ড, স্মোক ক্যাফে, গ্লোরিয়া জিনস, কিভা হান, ক্রিমসন কাপ, তাবাক ইত্যাদি সবই এই শতকের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কফিসংস্কৃতি গড়ে ওঠার পরিচয় দেয়।
তবে দেখা গেছে, আমাদের এখানে কালো কফির (অর্থাৎ এসপ্রেসো বা আমেরিকানো) চেয়ে দুধের কফির চল বেশি। প্রশ্ন হতে পারে—কেন? সাধারণভাবে একটা ঔপনিবেশিক মনোভাবের দোহাই দিয়ে এই প্রশ্ন পাশ কাটানো যেতে পারে। চৈনিক বা আসামের আদিবাসীদের রীতিতে পান করা চা যেমন আমাদের মুখে রোচেনি, ব্রিটিশদের দেওয়া দুধ-চা নিয়েছি, সেটার প্রভাব একটা কারণ হতে পারে। তবে সেই কারণের আড়ালে গিয়ে আমাদের সমস্যা কি ধামাচাপা দেওয়া ঠিক হবে? দুধ বা চিনি অথবা দুটোই কেন কফিতে যোগ করা হচ্ছে, এই প্রশ্ন আসলে আমাদের আরেকটি মৌলিক প্রশ্নের সামনে নিয়ে যায়। আমাদের ক্যাফেগুলো কি কফিপ্রেমীদের ‘যথাযথ’ কফি পরিবেশন করছে? উত্তর হলো—না। পেপার কাপে কফি দিয়ে হয়তো পরিবেশনের অজ্ঞতা ঢাকা যায়; কিন্তু যে কফি মুখে যাবে, তার বেলা?
সোজা কথায়, এসপ্রেসো হলো সব বিন-টু-কাপ কফির কেন্দ্রবিন্দু। এসপ্রেসো-বেজড কফি তেতো বা টক নয়। এর নিজস্ব মিষ্টি নোডের সঙ্গে একটা দারুণ ব্যালেন্সড স্বাদ রয়েছে। ভালো কফিতে অতিরিক্ত চিনি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আন্তর্জাতিক কফি দিবস ২০২৪-এ চলুন, আমরা কালো কফির ঠিকঠাক স্বাদ বোঝার চেষ্টা করি খানিকটা, সেই সঙ্গে ক্যাফেতে বসে কফি খাওয়ার কিছু তরিকা।
কীভাবে ভালো এসপ্রেসো বুঝবেন? কফি মুখে দেওয়ার পর আফটার-টেস্ট (এর ভালো বাংলা কী হবে, খাওয়ার পর স্বাদের রেশ!)-এর দিকে মনোযোগ দিলেই সহজে শনাক্ত করা যায় ভালো আর খারাপ কফি। ভালো মানের এসপ্রেসো সব সময় একটি মিষ্টি স্বাদের রেশ দিয়ে শেষ হবে। এটাকে তুলনা করা যেতে পারে পাকা আমলকী বা গুজবেরির মিষ্টি স্বাদের সঙ্গে। জিভে তেতো বা টক স্বাদ থাকে না।
কোয়ালিটি এসপ্রেসো কখনোই জিহ্বা স্পর্শ করবে না। মাথায় রাখা চাই, এসপ্রেসো সব সময় কাউন্টারে দাঁড়িয়ে বা বার স্টুলে বসে পান করার জিনিস। অর্ডার দিয়ে রয়ে-সয়ে খাওয়ার পানীয় নয় এটা। আর এর পারফেক্ট স্বাদ পেতে শেষ করতে হবে দুই মিনিটের মধ্যে। এসপ্রেসোর স্ট্যান্ডার্ড হলো ডাবল শট। যদি কেউ কোয়ালিটির তুলনা করতে চান, তাহলে ডাবল এসপ্রেসোকেই মানদণ্ড বলে ধরে নেওয়া হয়।
কোয়ালিটি ডাবল শটের কিছু বৈশিষ্ট্য জানা যাক। প্রথমেই তাপমাত্রা। পরিবেশন করার সময় এসপ্রেসো বেশ গরম হওয়া উচিত। গরম কফি তো পড়ছেই এসপ্রেসো মেশিন থেকে, কিন্তু বারিস্তাকে কাপও গরম করতে হয় সেটা পোর্টাফিল্টারের নিচে ও ড্রিপ ট্রের ওপরে রাখার আগে। পরিবেশনের সময় কফির তাপমাত্রা হতে হবে বেশি, অন্তত পান করার মতো তাপমাত্রার চেয়ে বেশি; আর এটা আপনার হাতে আসার দুই মিনিটের বেশি না রাখাই বাঞ্ছনীয়।
এরপর ক্রেমা। এসপ্রেসোর ওপরে ক্রেমার কয়েক মিলিমিটার পুরু একটি সুন্দর স্তর থাকতে হবে, যা এসপ্রেসোকে সম্পূর্ণভাবে ঢেকে রাখবে। যখন প্রচণ্ড চাপে পোর্টাফিল্টার দিয়ে স্পাউট বেয়ে এসপ্রেসো বের করা হয়, তখন এটি সেখান থেকে বেরোনো কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে তৈরি হয়। ডাবল শটের জন্য ক্রেমার রং সোনালি-বাদামি থেকে হালকা বাদামি হওয়া উচিত। বিনের উৎস আর রোস্টিং গ্রেডের ওপর নির্ভর করে রং পরিবর্তিত হতে পারে। কফিতে ক্রেমা কমপক্ষে তিন থেকে পাঁচ মিনিটের জন্য থাকা চাই।
কফির স্বাদ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এটি খুব তেতো হওয়া উচিত নয়, আর দীর্ঘ আফটার-টেস্টও থাকা অনুচিত। যদি এটি তেতো হয়, তবে পরিবেশন করার আগে খুব বেশিক্ষণ রেখে দেওয়া থাকতে পারে অথবা অতিরিক্ত সময় ধরে এক্সট্র্যাক্ট করার জন্যও হতে পারে। এটা বেশি পানসে বা টক হওয়া উচিত নয়; যদি তা হয়ে থাকে, তাহলে সেটা কম সময় ধরে এক্সট্র্যাক্ট করা হয়েছিল বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
এসপ্রেসোর গন্ধ বর্ণনা করা কঠিন। যারা এর সঙ্গে পরিচিত, কেবল তারাই ধরতে পারবেন; এ হলো অভিজ্ঞতালব্ধ একটি ব্যাপার। আর অ্যারোমা কফির উৎপত্তিস্থল ও রোস্টিংয়ের কারণে এদিক-ওদিক হবে। তবে কফিতে টক গন্ধ হলে সেটা এড়িয়ে যাওয়া চাই।
আর শেষ ব্যাপারটি হলো এর ঘনত্ব। এসপ্রেসো রেগুলার ঘরোয়া ড্রিপ কফির চেয়ে ঘন এবং আরও আঠালো ভাবের হবে; তবে কোনোভাবেই সিরাপের মতো অতটা ঘনও হবে না।
কালো কফির কথা বলতে গিয়ে কেবল এসপ্রেসোতে থেমে গেলে তো আর হয় না; আমেরিকানোও আছে। আমেরিকানোর ইতিহাস ক্যানভাসের আগের এক সংখ্যায় (ডিসেম্বর, ২০২০) বলা হয়েছিল। আমেরিকানো হলো এসপ্রেসোরই আরও মসৃণ আর কোমল সংস্করণ; এর সঙ্গে গরম পানি যোগ হওয়ার কারণে। যাদের এসপ্রেসোর ইন্টেনসিটি পছন্দ না, তারাই মূলত এটা নিয়ে থাকেন। এসপ্রেসোতে গোলমাল হলে তার সমস্ত প্রভাব পড়বে আমেরিকানোর ওপর। এসপ্রেসো যেখানে দুমিতাসে অর্থাৎ অর্ধকাপে পরিবেশিত হয়, সেখানে আমেরিকানো পরিবেশিত হয় ২০০ মিলি কাপে। এসপ্রেসো কাপ নিচের দিকে সরু হলেও ওপরের দিকে তুলনামূলক চওড়া হয়। এসপ্রেসো কাপ বেশি বড় হলে ক্রেমা পাতলা হবে, দ্রুত ছড়িয়ে ঝটপট মিলিয়ে যাবে। আর বড় কাপ তাপমাত্রায়ও প্রভাব ফেলে, এসপ্রেসো দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যায়। আমেরিকানোতে এক-চতুর্থাংশ এসপ্রেসোর সঙ্গে বাকি তিন-চতুর্থাংশ পানি যোগ হওয়ার কারণে ক্রেমা তুলনামূলক কম সময় স্থায়ী হয়; তারপরও অন্তত এসপ্রেসোর অর্ধেকটা সময় সেটা বহাল থাকবে—এমন আশা করাই যায়। কফির কারিগরের চেয়ে আমার মতো ব-কলম বেশি জানবে—এমনটা ভাবার কারণ নেই! তবে ওই যে আগেই বলা হয়েছে ‘যথাযথ’ভাবে কফি পরিবেশিত হচ্ছে কি না! অনেক ক্যাফেতেই দেখেছি আমেরিকানোতে ক্রেমা নেই, ওপরটা পুরো বাদামি-কালো; বা থাকলেও না থাকার মতোই। এর কারণ দুটো হতে পারে, (তিন নম্বর বলছি না; কারণ, ইউটোপীয় ধারণায় ধরেই নিচ্ছি একটা ক্যাফে খারাপ বিন পরিবেশন করতে পারে না!) কাউন্টার থেকে আপনার টেবিল পর্যন্ত আসতে সেটা যথেষ্ট সময় নিয়েছে; নয়তো কফির কারিগর সেটা তৈরির সময় ধারাবাহিকতা ভঙ্গ করেছেন।
ওপরের ব্যাপারগুলো ভালো এসপ্রেসো চেনার উপায় হলেও প্রতিটি ক্যাফেই ভিন্ন ভিন্ন কফি বিন ব্যবহার করে, যা ওপরের প্রতিটি ব্যাপারকেই প্রভাবিত করবে। মোদ্দাকথা, ভালো এসপ্রেসো চিনতে পারা একধরনের অভিজ্ঞতা অর্জনের যাত্রার মতোই। কফি ‘খেতে খেতেই’ শিখতে হবে ভালো কফির মাজেজা। তবে ভালো কফির স্বাদ নিতে হয় ভালো জায়গায় বসে—গুরু সৈয়দ সাহেব বলে গেছেন বারোয়ারি রেস্টুরেন্টে অনেক রকম খাবারের গন্ধ নাকে আসবে, তাতে কফির মৌতাতটাই নষ্ট হয়—তাই কফির স্বাদ নিতে হয় ক্যাফেতেই; আমিও সেটাকে বেদবাক্য মানি—‘জিভে কফি, নাকে ঘ্রাণ/ সেই কফি অমৃত সমান।’
আল মারুফ রাসেল
ছবি: ইন্টারনেট
Perfect description of Coffee in simple words.